Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

ফোনালাপ ফাঁসে নেই শাস্তির নজির

প্রিন্ট সংস্করণ॥শরিফ রুবেল

ডিসেম্বর ১১, ২০১৯, ০৬:৩৬ পিএম


ফোনালাপ ফাঁসে নেই শাস্তির নজির বিশ্বেজুড়েই কল রেকর্ড ফাঁসের ঘটনা হরহামেশাই ঘটছে। বাংলাদেশেও প্রায়ই ঘটছে এমন জঘন্য ঘটনা। কারো ব্যক্তিগত কথোপকথন জনসম্মুখে প্রকাশ করে দেয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গোটা বিশ্বের সব দেশেই ফোনে আড়িপাতা বড় ধরনের অপরাধ বলে গন্য। আর এ জন্য শাস্তিও পেতে হয়। বাংলাদেশের আইনেও কারো ফোনে আড়িপাতা, কল রেকর্ড ফাঁস করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দেশে ফোনালাপ ফাঁসের প্রথম ঘটনা ঘটে ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর। উত্তপ্ত রাজনৈতিক সংকট উত্তরণে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ফোন দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাদের মধ্যে প্রায় ৩৭ মিনিট কথোপকথন হয়। একদিন পরই একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ওই কথোপকথনটি সমপ্রচার করে। এতে দুই নেত্রীই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েন। শুধু দুই দলীয় প্রধানই নয়, অতি সম্প্রতি কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তির টেলিফোনের কথোপকথনও ফাঁস হয়েছে। কিন্তু এসব ফোনালাপ ফাঁসের উৎস সম্পর্কে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য জানা যায়নি। কেউ এর দায়-দায়িত্ব নেননি এবং কারা এসব ফাঁস করছে তাও জানা যায়নি। সর্বশেষ ডাকসু ভিপি নূরুল হক নূরের ১৩ কোটি টাকার কথোপকথন ফাঁস হওয়ায় বিষয়টি ফের তুমুল আলোচনায় আসে। মোবাইল বা মুঠোফোনে আড়িপাতার বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অনেক বিষয়ই জনসমক্ষে নিয়ে আসা হচ্ছে। সুস্পষ্ট নীতিমালার অধীনে বিষয়টি পরিচালিত না হওয়ায় অনেক ক্ষেত্রেই ক্ষমতার অপপ্রয়োগ হচ্ছে। সুস্পষ্টভাবে কেউই বলছে না কারা আড়িপাতছে, কারাই বা তা ছড়াচ্ছে। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পরও এখনো যারা এর সাথে জড়িত তাদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। তবে এসব ফোনালাপ ফাঁস করা বা কারো ফোনে আড়িপাতা কতটুকু আইনসিদ্ধ? এ বিষয়ে আইনজ্ঞরা বলছেন, ফোনে আড়িপাতা এবং ফোনালাপ প্রকাশ নিয়ে আইনে সুস্পষ্ট কিছু আইনে উল্লেখ নেই। আর এখন পর্যন্ত ফোনালাপ ফাঁসের সাথে জড়িত কারোর সাজা হয়েছে এমন কোনো নজিরও নেই। সুতরাং এই আইন করেও কোনো ফায়দা হয়নি বলে মত বিশেষজ্ঞদের। তাদের দাবি, কল রেকর্ড ফাঁসের মতো জঘন্য অপরাধের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন আইন-২০১০ সংশোধীততে যে সাজার কথা উল্লেখ রয়েছে সেটা নামমাত্র। এ আইনে সাজা আরও বেশি হওয়া উচিত ছিলো। বিশেষজ্ঞরা আরও মনে করেন, কেউ যদি মনে করেন এ ধরনের ঘটনার জন্য তার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে সেক্ষেত্রে তিনি আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, আড়িপাতার মাধ্যমে অন্যের টেলিফোন কথোপকথন রেকর্ড করার অধিকার সংশ্লিষ্ট সংস্থা ছাড়া অন্য কারো সুযোগ নেই। তাই এর উৎস খুঁজে বের করতে সরকারেরই ভূমিকা নেয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি বিরোধী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের কয়েকজনের টেলিফোন আলাপ ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ গত কয়েক মাস আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের সঙ্গে সাংবাদিক আব্দুর রব মজুমদারের কথোপকথন ফাঁস হয়। এরপর বিএনপি নেতা তারেক রহমান ও শমসের মবিন চৌধুরী, সাদেক হোসেন খোকা ও মাহমুদুর রহমান মান্না, মাহি বি চৌধুরী ও মাহমুদুর রহমান মান্না, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী- এরকম বেশ কয়েকটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে। আড়িপাতা আইন ও সাজা : বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন আইন-২০০১ এ টেলিফোনে আড়িপাতার দণ্ড সংক্রান্ত ৭১ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি অপর দুজন ব্যক্তির টেলিফোন আলাপে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়িপাতেন তাহলে প্রথমোক্ত ব্যক্তির এই কাজ হবে একটি অপরাধ এবং তার জন্য তিনি অনধিক ৬ মাস কারাদণ্ডে বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। ২০০৬ সালে এ ধারায় সংশোধনী এনে এর সঙ্গে অপর একটি প্যারা জুড়ে দিয়ে বলা হয়েছে, ‘তবে শর্ত থাকে যে, ধারা ৯৭(ক)-এর অধীন সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থা, তদন্ত সংস্থার মতো সরকারি সংস্থাগুলোকে এই আইনের বাইরে রাখা হয়। পরবর্তীতে ২০১০ সালে আবার সেই আইনটি সংশোধন করা হয়। এ আইনে ফোনে আড়িপাতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। তবে, কোনো ব্যক্তির কথোপকথন আড়ি পেতে রেকর্ড করলে বা প্রচার করলে দুই বছর কারাদণ্ড এবং পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু সরকারি সংস্থাগুলো তদন্তের স্বার্থে বা রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে কোনো নাগরিকের ফোনে আড়িপাততে চাইলে কি তাদের কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে? এদিকে সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের ও যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনতা রক্ষার অধিকার থাকিবে।’ সংবিধানের এ অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে, শুধু মোবাইল ফোনই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে যোগাযোগের গোপনীয়তা সংরক্ষণও করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে টেলিকম বিষয়ে অভিজ্ঞ একজন আইনজীবী বলেন, আইনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কারো টেলিফোনে আড়িপাততে হলে সরকার তথা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিতে হবে। এ সংক্রান্ত অনুমতিপত্রে কাকে, কি কারণে এবং কতক্ষণের জন্য আড়িপাতার আওতায় রাখা হবে তা উল্লেখ থাকতে হবে। ফোনে আড়িপাতা এবং ফোনালাপ প্রকাশ নিয়ে আইনে কি বলা আছে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, আইনে ফোনে আড়িপাতাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করা হয়েছে। আবার কতিপয় ক্ষেত্রে শাস্তি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৭, ৩১, ৩৫ ধারায় আড়িপাতার কোনো বিধানই নেই। নির্দিষ্ট কোনো নাগরিকের কর্মকাণ্ড যদি রাষ্ট্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বা হুমকি না হয়, তাহলে আদালতের নির্দেশনা ছাড়া কারো ফোনে কেউ বৈধভাবে আড়িপাততে পারবে না। তবে এদের বাইরে যেকোনো ব্যক্তির কথোপকথন আড়ি পেতে রেকর্ড করলে বা প্রচার করলে সেক্ষেত্রে দুই বছর সাজা ও পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে বলে জানান মোরশেদ। এ বিষয়ে গত অক্টোবরে আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া আমার সংবাদকে বলেছেন, ফোনে আড়িপাতা এবং ফোনালাপ প্রকাশ নিয়ে বাংলাদেশের আইনে অস্পষ্টতা আছে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনে একটি ধারা আছে যেখানে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা সংস্থা যদি প্রয়োজন মনে করে, তদন্তের স্বার্থে বা মামলার স্বার্থে হতে পারে, তাহলে টেলিফোন সেবাদাতা সংস্থা তাদের সব রকমের তথ্য দিতে বাধ্য থাকবে। কিন্তু তারা যে কারো ফোনে আড়িপাততে পারবে— এমন কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা বা ক্ষমতা দিয়ে কোনো আইনি বিধান নেই। বরং উল্টোটা আছে। যেকোনো নাগরিকের ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিচ্ছে বাংলাদেশের সংবিধান। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান আমার সংবাদকে বলেন, কারো ফোনে আড়িপাতা সংবিধানের লঙ্ঘন। সংবিধান প্রত্যেক নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদানের গোপনীয়তার নিশ্চয়তা দিয়েছে। কেউ তা লঙ্ঘন করলে সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি হবে। আর এ ধরনের অপরাধের জন্য আদালতের আশ্রয় নিয়ে প্রতিকার পাওয়া যাবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ ছাড়াও আইনের মাধ্যমে আড়িপাতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না আমার সংবাদকে বলেন, সামপ্রতিক সময়ে বিরোধী দলের যেসব নেতার ফোনালাপ ফাঁস হচ্ছে, তার দায়-দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। যদি সরকার বা রাষ্ট্র এ ধরনের আড়ি পেতে না থাকে তাহলে কারা করছে তাও খুঁজে বের করার দায়িত্বও সরকারের। ব্যক্তিগত ফোনে এভাবে আড়িপাতা আইনগতভাবেও অনুচিত। সরকার অসৎ উদ্দেশ্যেই এ ধরনের ষড়যন্ত্র করছে। তাছাড়া শুধু বিরোধী দল-মতের ফোনালাপ ফাঁস করা হচ্ছে। ক্ষমতাসীন দলের কোনো নেতার ফোনালাপ ফাঁস হয়নি। ‘শুধু রাষ্ট্রের নিরাপত্তা হুমকি ছাড়া কারো ব্যক্তিগত ফোনে আড়িপাতার বিধান নেই। এক্ষেত্রে রাষ্ট্র কারো ফোনে আড়ি পেতে থাকলেও তা প্রকাশ করা যাবে না। গত দুই বছরে ধারাবাহিকভাবে বিএনপির অন্তত দেড় ডজন শীর্ষ নেতার ফোনালাপ ফাঁস করা হয়। এ ছাড়াও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ সরকারবিরোধী নেতাদের ফোনালাপেও আড়িপাতা হয়। পরে তা ফাঁসও করে দেয়া হয়। এ জন্য তাকে জেলও খাটতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতারা এখন ফোনালাপে খুবই সতর্ক। এমনকি গণমাধ্যমের সঙ্গেও অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কথা বলছেন তারা। কল রেকর্ড ফাঁসের বিষয়ে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল আহসান বলেন, যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবে বিভিন্ন ব্যক্তির ফাঁস হওয়ার টেলিযোগাযোগ কথোপকথন এনটিএমসি সরবরাহ করেনি। এসব কল রেকর্ড বিক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি কথা বলার সময় রেকর্ড করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়ে দিচ্ছে। এখন কেউ যদি মনে করে, তার সম্মানহানি হয়েছে তাহলে তিনি সংশ্লিষ্ট থানায় অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। এসটিএমএ