Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

নরকে পরিণত সড়ক

নুর মোহাম্মদ মিঠু

আগস্ট ২২, ২০২০, ০৬:০৭ পিএম


নরকে পরিণত সড়ক

সড়ক নিরাপত্তায় ব্যাপক আন্দোলনের পরও দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনায় আদৌ ফিরেনি শৃঙ্খলা। গণপরিবহন চালকদের বেপরোয়া দৌরাত্ম্য কমেনি একটুও। প্রায় প্রতিদিনই সড়কে ঝরছে নিরীহ প্রাণ। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না দুর্ঘটনা।

সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি হয়ে উঠলেও নানা অব্যবস্থাপনার কারণে আজ সড়ক পরিণত হয়েছে নরকে। যাত্রী নিরাপত্তায় এখনই সড়ক ও সড়ক আইন বাস্তবায়নে বিদ্যমান অব্যবস্থাপনা নিরসনের কোনো বিকল্প নেই বলে বলছেন অনেকেই।ইতোপূর্বে সড়ক দুর্ঘটনারোধে যাত্রীকল্যাণ সমিতি কয়েকটি সুপারিশও পেশ করে।

সুপারিশগুলো হলো— সড়ক দুর্ঘটনাকে জাতীয় সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে জরুরিভিক্তিতে সড়ক দুর্ঘটনার প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হ্রাসে মালিক-শ্রমিক-যাত্রী-সরকার মিলে সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ, ফিটনেসবিহীন মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কড়ঝক্কড় যানবাহন উচ্ছেদ করে মানসম্মত যানবাহনের ব্যবস্থা, চালকদের আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, চালকদের হাতে দৈনিক চুক্তিভিক্তিক বাস, ট্রাক, হিউম্যান হলারসহ অন্যান্য যানবাহন ইজারা দেয়া বন্ধ, দেশের সব বেহাল সড়ক-মহাসড়ক সংস্কার, ট্রাফিক আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত, বিআরটিএকে শক্তিশালীকরণ, পরিবহন খাতকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত এবং ফুটপাত নির্মাণ ও সংস্কারসহ ফুটপাত দখলমুক্ত করে হাঁটার পরিবেশ নিশ্চিত করা। তবে একাধিকবার চেষ্টা করেও সড়কে নিরাপত্তা ও পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে পারেনি সরকার।

জোরালো অভিযোগ রয়েছে— পরিবহন আইন ও নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে মালিক এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর একচেটিয়া প্রাধান্যের কারণেই শৃঙ্খলা ফিরছে না এ খাতে। এছাড়া সরকার, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সবই একাকার হয়ে গেছে।

ফলে সিদ্ধান্ত হলেও বাস্তবায়ন হয় না। আইন থাকলেও প্রয়োগে আসছে বাধা। এর ফলে রক্ষা হচ্ছে না যাত্রীস্বার্থ। অকাতরে প্রাণ ঝরছে সড়কে। নিরাপদ সড়ক কি তাহলে অলীক কল্পনার বিষয় হয়েই থাকবে? প্রশ্ন বিভিন্ন মহলের।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত কারণে প্রতিবছর দেশের ক্ষতি হচ্ছে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ২ শতাংশ। যানবাহনের উচ্চগতি, নাজুক ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অবকাঠামোগত সমস্যা, পরিকল্পনা ও নীতির দুর্বলতা, অসচেতনতা ইত্যাদি বিষয় সড়ক দুর্ঘটনা ত্বরান্বিত করছে। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষকে সেসব সমস্যা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

১ আগস্ট ঈদুল আজহার দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য হালনাগাদ করে আমার সংবাদ জানতে পারে ২২ দিনে সারা দেশে বাস, ট্রাক, মাইক্রো, মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন যানবাহনের দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১২৪ জন। এর আগের মাস জুলাইয়ে ২৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫ শিশুসহ ৩৫৬ জনের মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।

এদিকে চলতি মাসের দুর্ঘটনার চিত্র থেকে দেখা যায়, সবচেয়ে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটেছে ময়মনসিংহ, চুয়াডাঙ্গা ও টাঙ্গাইলে। তার মধ্যে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায় চালকসহ ১৪ যাত্রী নিয়ে একটি মাইক্রোবাস শেরপুর যাওয়ার পথে ছনকান্দা এলাকায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পুকুরে পড়ে নিহত হয় আটজন। তার মধ্যে দুজন নারী এবং ছয়জন পুরুষ। ঈদুল আজহার পর এটিই ছিলো সবচেয়ে বড়     
দুর্ঘটনা।

এছাড়া চুয়াডাঙ্গায় ছয়জন, টাঙ্গাইলে চারজন ও গতকাল ময়মনসিংহের ভালুকায় বাস-মাইক্রোবাসের সংঘর্ষে ছয়জন নিহতের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও রাজধানীসহ সারা দেশের প্রায় সবস্থানেই কমবেশি ঘটেছে দুর্ঘটনা।  

সারা দেশের সবকটি দুর্ঘটনার খোঁজখবর নিতে গিয়ে আমার সংবাদ জানতে পারে, ফরিদপুরের মধুখালী উপজেলায় স্ত্রী-সন্তানের সঙ্গে ঈদ করতে বাড়ি ফেরার পথে লাশ হয় একব্যক্তি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার ভৈশ্বামোড়া এলাকায় ঈদের দিন দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে প্রাণ হারায় দুই তরুণ, বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার খাজুরা এলাকায় ঈদের দিন যাত্রীবাহী বাস ও মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে প্রাণ হারায় মোটরসাইকেলের আরোহী দুই তরুণ, রাজশাহীতে ঈদের দিন ঘুরতে গিয়ে প্রাণ হারায় এক মোটরসাইকেল আরোহী, মেহেরপুরের গাংনীতে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এটিএন নিউজের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজারসহ নিহত হয় দুইজন, কুমিল্লার চান্দিনায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হিমাচলের একটি বাস খাদে পড়ে প্রাণ হারায় দুইজন, সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জে বাসচাপায় নিহত হয় এক প্রকৌশলী, নীলফামারীতে বাসচাপায় এক মোটরসাইকেলে তিনজন ও এক শিশুসহ চারজন নিহত হয়।

এছাড়া ঢাকার ধামরাইয়ে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে নিহত তিনজনসহ রাজধানীতে প্রাইভেটকার চাপায় প্রাণ হারান পর্বতারোহী রেশমা। এছাড়াও রাজধানীতে এক মোটরসাইকেল আরোহী, বাসের ধাক্কায় এক বৃদ্ধা, বাসচাপায় আরেক মোটরসাইকেল চালক ও এশিয়া এয়ারকন বাসের ধাক্কায় এক বৃদ্ধ শ্রমিকের প্রাণ যায় রাজধানীতে। কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী এলাকায় সাইকেল চাপা দিয়ে দাদা-নাতনির প্রাণ কেড়ে নেয় মাইক্রোবাস, রাজবাড়ীর কালুখালীতে মিনি ট্রাকের ধাক্কায় প্রাণ যায় দুই মোটরসাইকেল আরোহীর, হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে দাঁড়িয়ে থাকা বাসের পেছনে আরেক বাসের ধাক্কায় দুজন নিহত, নওগাঁর মহাদেবপুরে দুই মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই আরোহীর মৃত্যু, ঈদের ছুটিতে নীলফামারীতে ঝরে ছয় প্রাণ, মাদারীপুরের শিবচরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায় ঢাকা কলেজের ছাত্র, জয়পুরহাটে পৃথক ঘটনায় মৃত্যু হয় তিনজনের, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফের দুই মোটরসাইকেলের সংঘর্ষে প্রাণ যায় যুবকের, পঞ্চগড়ে ঈদের দাওয়াত খেয়ে বাড়ি ফেরার পথে মোটরসাইকেলে ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যু হয় ব্যবসায়ীর, ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুর পল্লীবিদ্যুৎ অফিস সংলগ্ন এলাকায় এক অটোরিকশায় দুই বাসের চাপায় মারা যায় দুজন।

কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারীতে ট্রাকচাপায় দুই মোটরসাইকেল আরোহী, মানিকগঞ্জে স্ত্রীকে অফিসে দিতে গিয়ে বাসচাপায় প্রাণ হারান স্বামী-স্ত্রী উভয়ই, কিশোরগঞ্জে ঘাস কাটতে গিয়ে যাত্রীবাহী বাসচাপায় একজন নিহত, সিলেট নগরের চৌহাট্টা এলাকায় ট্রাকের ধাক্কায় মোটরসাইকেল আরোহী তরুণ নিহত, চুয়াডাঙ্গায় নৈশকোচের ধাক্কায় প্রাণ হারায় পাঁচজন, পরে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ছয়জনে। এদিকে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যায় ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায়। বেপরোয়া বাস কেড়ে নেয় বাবা-মা-মেয়েসহ আটজনের প্রাণ।

খুলনায় ট্রাকচাপায় প্রাণ হারায় স্কুলশিক্ষক, রূপগঞ্জে ট্রাকের ধাক্কায় দুমড়েমুচড়ে যায় সিএনজি- প্রাণ হারায় দুইজন, চুয়াডাঙ্গায় সড়কে প্রাণ যায় আরও দুজনের, খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কে ট্রাকের পেছনে ধাক্কা দিয়ে প্রাণ যায় দুই মোটরসাইকেল আরোহীর, পটুয়াখালীতে সৈকতে ভ্রমণ শেষে বাড়ি ফেরার পথে সড়কে প্রাণ হারায় এক পুলিশ সদস্য, ফেনীতে সিএনজি-ট্রাকের সংঘর্ষে চালকসহ নিহত হয় দুই, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় বাসের ধাক্কায় প্রাইভেটকারে থাকা একই পরিবারের তিনজনসহ নিহত হয় চার, রংপুরের মিঠাপুকুর এলাকায় একসঙ্গে দুই অটোভ্যানকে চাপা দিয়ে বাস খাদে পড়ে মারা যায় দুজন, পাবনায় বাসের ধাক্কায় স্কুলছাত্রসহ নিহত হয় তিনজন, সিলেটে বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে তিন শিশুসহ নিহত হয় ছয়জন।

এছাড়াও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে ট্রাক্টর-কাভার্ডভ্যান সংঘর্ষে ঝরে যায় এক প্রাণ, নাটোরের সড়কে প্রাণ যায় আ.লীগ নেতার, ভোলায় দ্রুতগামী মাইক্রোবাস কেড়ে নেয় যুবকের প্রাণ ও পিকআপের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে প্রাণ হারায় ব্যবসায়ী, কুষ্টিয়ায় ট্রাকচাপায় প্রাণ যায় যুবকের, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে দ্রুতগামী ট্রাক কেড়ে নেয় সাইকেল আরোহীর প্রাণ, গাজীপুর সদরের মহাসড়কে পিকআপ উল্টে নিহত হয় দুইজন, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে বাস কেড়ে নেয় দুই কলেজছাত্রের প্রাণ, নেত্রকোনায় নানির লাশ দেখার আগেই সড়কে লাশ হয় নাতি, ময়মনসিংহে মাইক্রোবাস পুকুরে পড়ে এক পরিবারের আটজন নিহত, নওগাঁর মান্দায় সড়ক দুর্ঘটনায় স্ত্রীর দুই ঘণ্টা পর মারা যায় স্বামীও, ময়মনসিংহে বাবার সামনেই বাসের নিচে পিষে যায় সন্তান, টাঙ্গাইলে বাস-অটোরিকশা সংঘর্ষে নিহত হয় একই পরিবারের চারজন, কক্সবাজারের রামুতে যাত্রী নিয়ে বাস উল্টে খাদে পড়ে নিহত হয় দুজন, চট্টগ্রামে বাস কেড়ে নেয় যুবকের প্রাণ এবং গতকাল ময়মনসিংহের ভালুকায় বাস-প্রাইভেটকার মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত হয় ছয়জন।

শুধু তাই নয়, একই দিন ময়মনসিংহের নান্দাইলেও দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকে অপর ট্রাকের ধাক্কায় নিহত হয় দুজনসহ সবশেষ চট্টগ্রামে গাড়ির ধাক্কায় একজনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই গতকালের পরিসংখ্যানের ইতি ঘটে। তবে এ পরিসংখ্যান স্থায়ীভাবে কবে কমে আসবে সেই আশাতেই রয়েছে দেশের মানুষ। যারা সড়কে বের হলে নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারবে কী না সে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।

সুষ্ঠু ও নির্বিঘ্ন যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য সমন্বিত ও আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দুর্ঘটনারোধে চালক ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। জেব্রা ক্রসিং ও ফুটওভার ব্রিজ ছাড়া রাস্তা পারাপার বন্ধ করতে হবে। যথাযথ পরীক্ষা ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেয়া যাবে না। ফুটপাথগুলো দখলমুক্ত করে পথচারী চলার উপযোগী করতে হবে।

তুলে দিতে হবে মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহন। রাস্তায় চলাচলে আইন অমান্যের জন্য আরও কঠিন শাস্তি ও জরিমানা আদায় করতে হবে। প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটের দুর্ভোগ পোহাতে হয় নগরবাসীকে। ফলে আগে যাওয়ার প্রবণতার কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে।

তাছাড়া রাস্তায় যেখানে সেখানে গাড়ি পার্কিং, ফুটপাথ দখল করে ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, একই রাস্তায় বিভিন্ন গতির যানবাহন চলাচল, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ি, চালকের মাদকাসক্তি ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটছে। কর্তৃপক্ষের সুষ্ঠু ও সমন্বিত পদক্ষেপেই দেশে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব বলে বলছেন তারা।

আমারসংবাদ/এসটি