Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

জটিলতা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন সরকারি চাকরিজীবীরা

বেলাল হোসেন

আগস্ট ২৪, ২০২০, ০৭:২০ পিএম


জটিলতা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন সরকারি চাকরিজীবীরা

মুন্সিগঞ্জ জেলার এক থানা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার অনেক আগ্রহ নিয়ে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন সরকারি কর্মচারীদের গৃহঋণ নেয়ার জন্য। তবে কিভাবে আবেদন করবেন? কোথায় এর সহজ সমাধান তা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকেন। তিনি একজন নারী চাকরিজীবী হওয়ায় অনেক কিছুই সম্ভব হয়ে ওঠে না।

আবার তিনি জানতে পারেন গৃহঋণের আবেদন করতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের গৃহঋণ শাখায়। এরপর যাচাই-বাছাই আরও লম্বা সময়। এর মাঝেও আছে নীতিমালার বেশকিছু জটিলতা। সব মিলিয়ে নারী চাকরিজীবী গৃহঋণের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।

তিনি এ প্রতিবেদককে জানান, ঋণ নেয়ার আগে এতো আবেদন। আবার শুনলাম ব্যাংক টাকা উঠানোয় অনেক ঝামেলা বলে জানান এ নারী চাকরিজীবী। এ রকম অভিযোগ অনেকেরই। দীর্ঘ এক যুগ পর সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপক আগ্রহের মুখে গৃহঋণ প্রকল্প চালু হয়।

দুই বছর ধরে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে অর্থ বিভাগের দেয়া তথ্য মতে, দেশে প্রায় ১২ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর  মধ্যে এ পর্যন্ত গৃহঋণ গ্রহণ করেছেন মোট ৪৮০ জন। যা মোট সরকারি কর্মকর্তাদের তুলনায় খুবই কম।

শুরুর দিকে ব্যাপক আগ্রহ থাকার পরও গৃহঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা কেন এমন অনাগ্রহ দেখাচ্ছেন এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অর্থ বিভাগের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এ সংক্রান্ত নীতিমালা অত্যন্ত জটিল।

তারা বলছেন, এ ঋণের বিপরীতে যে পরিমাণ মাসিক কিস্তির হার নির্ধারণ করা হয় তা কোনো কোনো কর্মকর্তার মোট বেতনের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ। অনেকের ক্ষেত্রে তা বেতনের সমান। ফলে মাসে উপার্জিত সব টাকা ঋণ পরিশোধ করলে জীবনযাপনে আর্থিক সংকটে পড়তে হয়। এ কারণে অনেকে গৃহঋণ নেয়ার বিষয়ে বারবার ভাবছেন।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংক থেকে টাকা নিতে গিয়েও অনেককেই পড়তে হচ্ছে নানা বিড়ম্বনায়।

বিশেষ সূত্রে জানা গেছে, দেশের সাধারণ নাগরিক ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণে যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, একজন সরকারি আমলার ক্ষেত্রেও মানতে হচ্ছে একই প্রক্রিয়া। ব্যাংকে দাখিল করতে হচ্ছে একই ধরনের কাগজপত্র, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে যে ফ্ল্যাট ক্রয় করা হবে বা জমির ওপর বাড়ি নির্মাণ করার জন্য ঋণ গ্রহণ করা হবে তা ভিজিট করে ক্রয় নিশ্চিত জেনেই লোন পাস করে ব্যাংকগুলো। অনেক ক্ষেত্রে ভিজিট প্রক্রিয়া এতটাই ধীরগতির যা অনেক ক্ষেত্রে হয়রানির পর্যায়ে পড়ে।

এছাড়াও কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য যে আইনজীবী বা আইন উপদেষ্টাকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব দেন অনেক ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা তাদের দ্বারা হয়রানির শিকার হন বলেও অভিযোগ উঠেছে। সাধারণ মানুষের ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ও আইনজীবীর যে মনোভাব, একই মনোভাব সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রেও পোষণ করা হচ্ছে। সরকারের আমলা হিসেবে ন্যূনতম কোনো সুবিধা বা সম্মানও দেখানো হয় না এক্ষেত্রে।

সচিবালয়ে কর্মরত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা আমার সংবাদকে বলেন, এই প্রক্রিয়ায় সাধারণ ঋণ গ্রহীতাদের কাছ থেকে ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা ও আইনজীবী সম্মানী অথবা অতিরিক্ত সুবিধা প্রাপ্তিতে অভ্যস্ত। যা সরকারি কর্মকর্তারা দিতে অনাগ্রহ দেখায়। ফলে ঋণ গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ব্যাংক কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের সক্রিয় করতে অনেক ঝামেলা হয়। অর্থ বিভাগে নিয়োজিত গৃহঋণের দায়িত্ব পালন করা উপসচিব দিল আফরুজা নিজেও গৃহঋণ গ্রহণ করেননি।

তিনি জানান, ঋণ নিতে চাইলে ফ্ল্যাট বা জমি নির্ধারণ করে তারপর ঋণ নিতে হয়। অনেক সময় ঋণের পরিমাণের সঙ্গে ফ্লাটের দাম মিলানো যায় না। এভাবে নানা জটিলতার কারণে আমি নিজেও ঋণ নিতে পারিনি। আমার স্বামীও একজন সরকারি কর্মকর্তা, এখন ভাবছি আমরা দুজন মিলে ঋণ নিয়ে একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করবো। এছাড়া উপায় নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গৃহঋণ গ্রহণের নীতিমালা অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা অবসরে যাওয়ার পর সুদের যে ৫ শতাংশ ভর্তুকি সুবিধা সরকার দেন তা বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে পুরো সুদ অর্থাৎ ৯ শতাংশের পুরোটাই ঋণ গ্রহীতাকে বহন করতে হয়। এটা একটা বড় সমস্যা। সুদ মওকুফের সুবিধা শুধু চাকরিতে বহাল থাকাকালীন এবং এলপিআরের এক বছর পর্যন্ত এ সুবিধা পাওয়া যায়। যার ফলে অনেকে গৃহঋণ নিতে চাইছেন না।

এক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বিভাগের গৃহঋণ শাখার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা এই পদ্ধতির সমালোচনা করে বলেন, একজন কর্মকর্তা যতদিন পেনশন পাবে সে মেয়াদ পর্যন্ত যদি সরকারের দেয়া ঋণের সুদ সুবিধা পেতো তবুও হয়তো অনেকে আগ্রহ দেখাতো। এক্ষেত্রে গৃহঋণের এ নীতিমালা সংশোধনের দাবিও তুলেছেন তিনি।  

গৃহঋণের নীতিমালার সমালোচনা করে একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাধারণ কোনো মানুষ ব্যাংক থেকে লোন নিলে শুধু তাকে ওই জমি বা ফ্ল্যাট বন্ধক রাখতে হয়। কিন্তু একজন কর্মকর্তা গৃহঋণ নিতে গেলে তার পুরো বেতন ও যে সম্পদের ওপর ঋণ গ্রহণ করছেন তাও বন্ধক রাখতে হয়। এক্ষেত্রে একজন কর্মকর্তাকে বাধ্য হয়েই একটি ঋণের বিপরীতে দুটি বন্ধক একসঙ্গে রাখতে হচ্ছে। যার ফলে গৃহঋণ গ্রহণে কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যাপক অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়াও যেসব কর্মকর্তা গৃহঋণ গ্রহণ করবেন তাদের অনলাইন পদ্ধতিতে বেতন-ভাতা গ্রহণের আওতায় আসতে হবে।

কিন্তু সিটি কর্পোরেশন, ওয়াসাসহ বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে যেসব কর্মকর্তা নিয়োজিত তাদের শতভাগ অনলাইন পদ্ধতিতে বেতন-ভাতার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। ফলে গৃহঋণ নীতিমালার এ জটিলতার ফলে অনেকে ঋণ গ্রহণে আবেদনই করতে পারছেন না।

ব্যাংকে সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র জমাদানের বিষয়ে নানা জটিলতার কথা উল্লেখ করে একাধিক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, সরকারের একজন সচিব, অতিরিক্ত সচিব অথবা যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা লোন প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে কাগজপত্র নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে যাওয়া সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এটা বিড়ম্বনা তৈরি করে।

এর ফলে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা গৃহঋণ গ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। অপরদিকে উপসচিব থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে লোন গ্রহণের পর মাসিক বেতনের পুরোটাই পরিশোধ করতে হয় কিস্তি বাবদ।

এজন্যে তারাও গৃহঋণ গ্রহণে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। এর ফলে দীর্ঘ ১২ বছরের প্রতীক্ষিত গৃহঋণ ব্যবস্থা গেল দুই বছর ধরে চালু হলেও এ পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ৪৮০ জন কর্মকর্তা গৃহঋণ গ্রহণ করেছেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু জটিল নীতিমালা ও প্রক্রিয়ার কারণেই গৃহঋণ ব্যবস্থা চালু হলেও তা অকার্যকর হয়ে পড়েছে। গৃহঋণ নীতিমালা অনুযায়ী আগে ফ্ল্যাট ক্রয় করতে হবে অথবা বাড়ি নির্মাণের জন্য জমি ক্রয় করতে হবে।

এরপর ঋণ বাবদ অর্থ অনুমোদন দেয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে মর্গেজ যাচাই-বাছাইয়ের দায়িত্ব সরকারি কর্মকর্তাদের দিলে তা সুবিধাজনক হবে বলে মত দিয়েছেন কর্মকর্তারা। এর যাচাই-বাছাই ব্যাংক কর্তৃপক্ষের ওপর ন্যস্ত থাকায় তাদের ধীরগতি পদ্ধতি ও দীর্ঘসূত্রতার নানা জটিলতার কারণে কর্মকর্তারা ঋণ গ্রহণে অনীহা প্রকাশ করছে।

নীতিমালা অনুযায়ী চাকরির গ্রেড মেনে ২০ লাখ থেকে ৭৫ লাখ টাকা পর্যন্ত গৃহঋণ পাবেন সরকারি কর্মচারীরা। শুরুতে বেসামরিক ও সামরিক কর্মচারীদের জন্য এ সুবিধা চালু করা হলেও পরে বিচারক এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারীরাও এ তালিকায় যুক্ত হন। বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশনসহ সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এ ধরনের ঋণ দিয়ে আসছে।

আমারসংবাদ/এসটিএম