Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

রাজনৈতিক দলে গৃহদাহ

আবদুর রহিম ও রফিকুল ইসলাম

আগস্ট ২৮, ২০২০, ০৬:০৮ পিএম


রাজনৈতিক দলে গৃহদাহ

দেশের সব রাজনৈতিক দলেই অভ্যন্তরীণ কোন্দল। ভালো নেই কেউ। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে ব্যবসায়ী নেতাদের প্রভাব বৃদ্ধিতে মাঠের ত্যাগী নেতাদের কার্যত মূল্যায়ন করা হচ্ছে না।

এ নিয়ে ভেতরে ভেতরে ব্যক্তি ও পন্থির প্রভাব বেড়েছে। বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী ও ভিন্নপন্থিদের দলে অনুপ্রবেশে নেতৃত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। শীর্ষ নেতাদের বলয়-ভিত্তিক রাজনীতি এবং তৃণমূলে সৃষ্ট এমপি লীগ, ভাই লীগের নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ডে বিব্রত পরিস্থিতিতে সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে দলটিকে।

অন্যদিকে একসময়ের ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দল বিএনপিতে প্রধান রাজনৈতিক নেতাশূন্যতায় নেতৃত্ব, পদবি নিয়ে ক্ষোভ বেড়েছে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের নাম ভাঙিয়ে কমিটি গঠনে দলে চলছে একটি অংশের প্রভাব। ক্ষোভ বেড়েছে আরেকটি অংশের।

এছাড়া হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টিতেও প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বের কারণে নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে দলটির দলীয় কার্যক্রম। জামায়াতে ইসলামী ও হেফাজতে ইসলামিসহ ইসলামি দলগুলোতেও ক্ষমতার আক্রোশ দেখা গেছে।

এ নিয়ে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি একটি রাজনৈতিক দলের মধ্য গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকে, তাহলে সেই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পদ-পদবি নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় পদের দাপট দেখিয়ে অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।

দলের একটি পদ-পদবি আসতে একাধিকজন প্রতিযোগিতা করেন। এটা প্রতিটি রাজনীতিবিদের মধ্য থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, বঞ্চিত হলেই বিরোধিতা শুরু করেন দলের এক শ্রেণির নেতার ছত্রছায়ায়, এ ধরনের নেতারাই আজ রাজনীতিকে কলঙ্কিত করছেন!

রাজনীতিকে দুর্বল করে ফেলছেন। ফলে রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। এদের অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত। এরা রাজনীতি করেন নিজের স্বার্থে।
ভোট ও মাঠের রাজনীতিতে সফল আওয়ামী লীগ। দলের দায়িত্বশীল নেতাদের দূরদর্শী ও বলিষ্ঠ নেতৃতে সফলতার সাথেই দীর্ঘ একযুগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় রয়েছে দলটি। তবুও ঘরের রাজনীতি নিয়ে মাঝে মধ্যেই উদ্বেগ ও অস্বস্তি প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী ও ভিন্নপন্থিদের দলে অনুপ্রবেশ।

একই সাথে শীর্ষ নেতাদের বলয়-ভিত্তিক রাজনীতি এবং তৃণমূলে সৃষ্ট এমপি লীগ, ভাই লীগের নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ডে বিব্রত পরিস্থিতি ও সমালোচনার মুখে পড়তে হয় দলটিকে। এমন পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে বারবার উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকায় নিজ দলের মধ্য থেকেই শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছে তারা। অভিযুক্তদের কঠোর শাস্তির মুখোমুখি করা হয়েছে।

তবুও বিতর্ক পিছু ছাড়েনি তাদের। দলে ত্যাগী নেতারা এখন মূল্যায়ন কম হচ্ছেন। বড় নেতৃত্বে সুযোগ পাচ্ছেন ব্যবসায়ী নেতারা। এ ছাড়া বৈশ্বিক মহামারি করোনাকালের রাজধানীসহ বেশকিছু জেলাতে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছেন দলের পদধারী দায়িত্বশীল নেতারা। কোথাও কোথাও হামলা-মামলা হয়েছে।

তবে দল ও সরকারের সুনাম নষ্ট করতে স্বাধীনতাবিরোধী ও ভিন্নপন্থিরা বিভিন্ন কৌশলে দলে প্রবেশ করছে বলে দাবি আওয়ামী লীগের। তারা বলছে, ভাবমূর্তি ক্ষতু্ন করছে অনুপ্রবেশকারীরাই। তাই কোনোভাবেই দলে অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়া যাবে না।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী বলেছেন, ‘দুঃসময়ে দীর্ঘ দিনের ত্যাগী নেতাকর্মীরাই দলকে ধরে রাখে। কিন্তু সুসময়ে দল ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করে অনুপ্রবেশকারীরাই।’

তিনি আরও বলেন, ‘যারা দল করেন, তারা মনে রাখবেন, দলে যদি ঐক্যকে গুরুত্ব না দেন, নিজেদের মধ্যে কলহ-কোন্দল থাকে তাহলে দুঃসময়ে প্রতিপক্ষ কোন্দলের ওপর আঘাত হানবে। এ দেশে কখন কী ঘটে বলা যায় না। চিরজীবন আমরা ক্ষমতায় থাকবো এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাবেন না, আমরাও ভাবি না।’

এদিকে আসন ভাগাভাগি, নেতৃত্ব, পদবি নিয়ে ভালো নেই বিএনপি। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দোহাই দিয়ে গঠন করা হচ্ছে নানান কমিটি। এতে বিব্রত হচ্ছেন সিনিয়র নেতারা। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি পুনর্গঠনকে কেন্দ্র করেও দেখা দিয়েছে অস্থিরতা। কেউ কাউকে মানতে চাইছেন না। মাঠপর্যায়ে সাংগঠনিক কমিটি গঠনে চিরায়িত গণতান্ত্রিক নিয়মের বদলে সফররত ‘কেন্দ্রীয় টিম’ কর্তৃক গঠিত হচ্ছে ‘পছন্দমতো’ কমিটি।

আর অঙ্গ-সংগঠনের কমিটি গঠনে স্থানীয় শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতারাও কিছু জানতে পারছেন না। ফলে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাকর্মীর পরিবর্তে অযোগ্য, চাটুকার ও অনুপ্রেবেশকারীরা বড় পদে আসছেন।

এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গড়া জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও ক্রমেই গুরুত্ব হারাচ্ছে দলটিতে। শরিক দলগুলোর এ জোটের প্রতি এখন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। নির্বাচনের পর বিবৃতি ছাড়া তেমন কোনো তৎপরতা নেই ঐক্যফ্রন্টের।

কমিটি গঠনে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘সিনিয়র নেতাদের মতামত নিয়েই কমিটি করা উচিত। এরপরও বড় দলের কারণে কিছু অভিযোগ থাকে। এসব অভিযোগ আলোচনার মাধ্যমেই নিষ্পত্তি করা হয়।’

আর জোট নিয়ে জানতে চাইলে ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক দল নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কাগজ-কলমে আছে, কিন্তু বাস্তবে তো নেই। যে আশা-আকাঙ্ক্ষা নিয়ে জোট গঠন করা হয়েছিল, সেটা ঐক্যফ্রন্ট ধরে রাখতে পারেনি। কিন্তু তা যে শুধু ড. কামাল হোসেনের জন্য, তা তো নয়। এর জন্য বেশির ভাগ দায়ী বিএনপি।

এছাড়া একাদশ জাতীয় সংসদের বিরোধী দলের নেতা ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং দলটির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টিতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করেছে। এ দলটি বর্তমানে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় রয়েছে। তবুও আগের রূপে নেই সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড।

শাপলা চত্বরের ঘটনা নিয়ে সাত বছর আগে সরকারকে ঝাঁকুনি নিয়ে রাতারাতি প্রতিষ্ঠিত হেফাজতে ইসলামে ভাঙন। সংগঠনের মহাসচিব হাফেজ জুনায়েদ বাবুনগরী ও আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফীর ছেলে আনাস মাদানির দ্বন্দ্বে সংগঠনটির ভেতরের কোন্দল প্রকাশ্যে এসেছে।

হাটহাজারী মাদ্রাসার সহকারী পরিচালক পদ থেকে জুনায়েদ বাবুনগরীকে অপসারণের পর থেকে দুই পক্ষের আলাদা অবস্থান। বাবুনগরী ও আনাস মাদানী প্রকাশ্যে একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে চলছে বিতণ্ডা। সহকারী পরিচালকের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার পর ফুঁসে ওঠেন জুনায়েদ বাবুনগরী।

তিনি তখন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, সহকারী পদ থেকে তিনি সরতে চাননি। তার অনিচ্ছায়ই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি হেফাজত ও মাদ্রাসার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বললে এর প্রতিবাদে কথা বলেন হেফাজতে ইসলামের প্রচার সম্পাদক ও শফীপুত্র আনাস মাদানি।

একপর্যায়ে তিনি জুনায়েদ বাবুনগরীকে জামায়াতে ইসলামের এজেন্ট বলেও দাবি করে বলেন, বাবুনগরীর কারণে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা মার খেয়েছেন। এছাড়া জামায়াতের সাবেক নেতাকর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে জামায়াতে ইসলামী। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী এ দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমানের একটি বক্তব্যকে কেন্দ্র করে উভয় পক্ষের বিরোধ এবার সামনে এসেছে।

গত ২২ জুন অনলাইনে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে একজন কর্মীর প্রশ্নের প্রেক্ষিতে এবি পার্টি প্রসঙ্গে কয়েক মিনিট কথা বলেন জামায়াতের আমির।

সেখানে তিনি বলেন, ‘তাদের (এবি পার্টি) কর্মসূচিতে তাদের অ্যাজেন্ডায় ধর্ম ও মুক্তিযুদ্ধের এই চ্যাপ্টার থাকবে না। এটাকে বাদ দিয়েই হবে তাদের সবকিছু। ফলে আমাদের আর কিছু বলার প্রয়োজন নেই। আমাদের ভাইয়েরা একেবারে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। কারণ দ্বীন (ধর্ম) তাদের সাবজেক্ট নয়। আর দ্বীনটাই আমাদের সাবজেক্ট।’ ডা. শফিকুর রহমানের প্রায় তিন মিনিটের ভিডিও বক্তব্যটি এখন অন্তর্জালে ঘুরছে। জামায়াতের মধ্যে এ নিয়ে চলছে একে অপরের প্রতি ক্ষোভ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এ বিষয়ে আমার সংবাদকে বলেন, ‘দল ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করতেই রাজনীতিবিদরা রাজনীতি করেন। দলের একটি পদ-পদবি আসতে একাধিকজন প্রতিযোগিতা করেন। এটা প্রতিটি রাজনীতিবিদের মধ্য থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেউ কেউ আছেন, বঞ্চিত হলেই বিরোধিতা শুরু করে।

দলের এক শ্রেণির নেতার ছত্রছায়ায়, এ ধরনের নেতারাই আজ রাজনীতিকে কলঙ্কিত করছে! রাজনীতিকে দুর্বল করে ফেলছে! ফলে রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা কমে গেছে। এদের অনেকেই দুর্নীতিগ্রস্ত। এরা রাজনীতি করেন নিজের স্বার্থে। এ অবস্থা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করতে প্রতিটি দলের শীর্ষ নেতাদের কঠোর হতে হবে এবং উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।’

রাজনৈতিক বিশ্লেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ আমার সংবাদকে বলেছেন, ‘যদি একটি রাজনৈতিক দলের মধ্য গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকে, তাহলে সেই দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পদ-পদবি নিয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও কোন্দলের সৃষ্টি হয়। অনেক সময় পদের দাপট দেখিয়ে অনেকেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ ধরনের রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির অভাব এবং এটা এক ধরনের অপরাজনীতি।’

আমারসংবাদ/এসটিএম