Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪,

ভোক্তারা পাচ্ছেন না ঘোষণার সুফল

জাহাঙ্গীর আলম

অক্টোবর ২২, ২০২০, ০৬:৪১ পিএম


ভোক্তারা পাচ্ছেন না ঘোষণার সুফল

সরকার কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করলেও খুচরা ব্যবসায়ীরা আলুর দাম কমাচ্ছেন না। আড়তে সর্বোচ্চ ৩০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও তারা ৫০ টাকার কম দামে আলু বিক্রি করছেন না। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে দুই দফা আলুর দাম সর্বোচ্চ দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা বেঁধে দিলেও ভোক্তারা তার সুফল পাচ্ছেন না।

এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে টিসিবির মাধ্যমে ৩০ টাকা কেজি আলু বিক্রি করলে তাতে ব্যাপক ভিড় দেখা গেছে। বৃষ্টিতে ভিজেই বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে থেকে শুরু করে প্রেস ক্লাবসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ লাইনে আলু কিনতে দেখা গেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিও বাজারে বেশি দামে আলু বিক্রির কথা জানান।

তিনি বলেন, বুধবারও আলুর দাম কোল্ড স্টোরেজে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা কেজি ছিলো। গতকাল তা ২৮ টাকা দরে বিক্রি হয়। যেটা ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে আগামী দু-তিনদিনের মধ্যে খুচরা বাজারে আলুর দাম ৩৫ টাকার নিচে নেমে আসবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

জানতে চাইলে রাজধানীর শ্যামবাজারের আড়ৎদার মানিক শাহা গতকাল আমার সংবাদকে বলেন, সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়মে বিক্রি করা হচ্ছে আলু। তাই ২৯ থেকে ৩০ টাকা কেজি পাইকারি বিক্রি করা হচ্ছে। বুধবারও একই দামে বিক্রি করা হয়। দাম কমায় বিক্রি বাড়তে শুরু হয়েছে। আরও কমলে আরও বিক্রি বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। একই কথা বলেন কারওয়ান বাজারের পাইকারি আলু ব্যবসায়ী মো. হাফিজ।

তিনি বলেন, ‘আজ বাজারে ভালো মানের আলু কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা। এছাড়া মান অনুযায়ী ৩০ থেকে ৩৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোল্ড স্টোরেজগুলো এখন আলু ছাড়ছে। গতকাল থেকে বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। এটা অব্যাহত থাকলে সামনে দাম আরও কমবে।’

তবে মোহাম্মদপুর কৃষিমার্কেটের মেসার্স নিউ বিক্রমপুর বাণিজ্যালয়ের মো. কালু বেপারী বলেন, বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক ছুটি মোহাম্মদপুর বাজার। তাই বাজার বলা যাবে না। তবে দাম কমে যাওয়ায় মোকাম থেকে আড়তে আলু সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে।    

তবুও খুচরা বাজারে ৫০ টাকার কমে মিলছে না আলু : পাইকারি বাজারে সরকারের বেঁধে দেয়া ৩০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে প্রতিকেজি আলুর মূল্য ৩৫ টাকা নির্ধারণের সুফলের ছিটেফোঁটাও নেই। কোথাও এই দামে আলু মিলছে না।

গতকাল রাজধানীর মোহাম্মদপুর, এজিবি কলোনি কাঁচাবাজার, আরামবাগ কাঁচাবাজার, খিলগাঁও ও কমলাপুরসহ বেশ কয়েকটি কাঁচাবাজারে এমনই চিত্র পাওয়া গেছে। মতিঝিল এজিবি কলোনি কাঁচাবাজারের আলু বিক্রেতা অলি মিয়া বলেন, পাইকারি বাজার থেকে ৪০ টাকার বেশি দামে আলু কিনতে হচ্ছে।

তার সঙ্গে রয়েছে পরিবহন খরচ, আবার প্রতিবস্তায় তিন-চার কেজি আলু পচা থাকে। ফলে ৫০ টাকা বিক্রি করলেও খুব বেশি লাভ হয় না।  সরকার খুচরা বাজারে আলুর দাম ৩৫ টাকা এবং পাইকারি বাজারে ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে জানালে তিনি বলেন, এসব বলে লাভ নাই।

একই কথা বলেছেন খিলগাঁও বাজারের আলু বিক্রেতা জামাল হোসেন। তিনি বলেন, ৫০ টাকার নিচে আলু বিক্রি করার কোনো উপায় নেই। কারণ আমাদের ৪০-৪১ টাকায় কিনতে হয়। তারসঙ্গে পরিবহন খরচ যোগ করলে দাম আরও বেড়ে যায়। ফলে ৫০ টাকার নিচে আলু বিক্রি করলে লোকসান গুনতে হবে। অন্যান্য বাজারেও একই অবস্থা। বিভিন্ন অজুহাতে কম দামে খুচরা ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছে না আলু।

চলতি মাসের শুরুতে হঠাৎ করে রাজধানীতে আলু দাম দ্বিগুণ অর্থাৎ ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি বিক্রি করতে থাকে ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে হইচই শুরু হলে গত ৭ অক্টোবর কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে প্রতি কেজি আলুর মূল্য ২৩ টাকা, পাইকারি পর্যায়ে ২৫ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে ৩০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে।

একই সাথে ভোক্তা, আড়ত ও কোল্ড স্টোরেজ পর্যায়ে আলুর সর্বোচ্চ দাম কার্যকর করতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর থেকে ৬৪ জেলার জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে চিঠি পাঠানো হয়। তারপর আলু ব্যবসায়ীরা তা মানছে না। ব্যবসায়ীরা ৫০ থেকে ৬০ টাকার নিচে বিক্রি করছে না আলু। পর্যাপ্ত মজুত থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ করে মাসের ব্যবধানে আলুর দাম দ্বিগুণ বেড়ে খুচরা বাজারে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

ভোক্তাদের স্বার্থে রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজারে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে বিশেষ অভিযানও পরিচালনা করছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। তারপরও আলু ব্যবসায়ীরা দাম কমাচ্ছে না ভোক্তাপর্যায়ে।

গত ২০ অক্টোবর ব্যবসায়ীদের দাবি মেনে নিয়ে আলুর দাম বাড়িয়ে আবারো পুনঃনির্ধারণ করেছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। নতুন দাম অনুযায়ী প্রতি কেজি আলু হিমাগার পর্যায়ে ২৭ টাকা কেজি, পাইকারিতে ৩০ টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা বিক্রি করতে হবে।  

এদিকে আলুর বাড়তি দামের কথা স্বীকার করে গতকাল সচিবালয়ে এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, আলুর বাজার অস্থির হয়েছে, দাম কমানোর চেষ্টা চলছে। আগামী দু-তিনদিনের মধ্যে আলুর দাম খুচরা পর্যায়ে ৩৫ টাকার নিচে নামবে।

এটি আমরা নিয়ন্ত্রণ করি না, কৃষি মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণ করে। আমরা ইচ্ছা করেই টিসিবির মাধ্যমে ২৫ টাকা দরে বাজারে আলু ছেড়েছি ভোক্তাদের সহযোগিতার জন্য। কৃষি মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে দামের বিষয়ে।

 বুধবার আলুর দাম কোল্ড স্টোরেজে ৩৫ থেকে ৪০ টাকা ছিলো। সেটা গতকাল ২৮ টাকা দরে বিক্রি হয়। যেটা ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। তাই খুব আশাবাদী, আগামী দু-তিনদিনের মধ্যে খুচরা বাজারে আলুর দাম ৩৫ টাকার নিচে নেমে আসবে।

বৃষ্টিতে ভিজে আলু কিনতে দীর্ঘ লাইন : কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রতিফলন নেই। আলুর দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় বাণিজ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী টিসিবি ট্রাকে ২৫ টাকা কেজি আলু বিক্রি শুরু করেছে। তাতে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে, জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে, খামারবাড়ীসহ বিভিন্ন স্থানে দীর্ঘ লাইন দেখা যায়। বৃষ্টিতে ভিজেই নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

আলুর ব্যাপারে জানতে চাইলে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সাবেক সহ-সভাপতি এবং রংপুরের মোস্তফা কোল্ড স্টোরেজসহ সাতটি কোল্ড স্টোরেজের মালিক মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু আমার সংবাদকে সম্প্রতি বলেন, কোল্ড স্টোরেজের ৩২ টাকার আলু আড়তে ৩৬ টাকা বিক্রি হলেও ভোক্তাদের ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি কিনতে হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে ব্যবসায়ীরা ১০ টাকা লাভ করছে। তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।

শুধু ভোক্তা অধিদপ্তর দিয়ে বাজার অভিযানে অসাধু ব্যবসায়ীদের স্বাভাবিক করা যাবে না। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা রয়েছে। নজরদারি বাড়াতে হবে। সিন্ডিকেটমুক্ত করতে হবে। দেখতে হবে কারা বেশি লাভ করছে, বাজার অস্থির করছে। তা শনাক্ত করে দৃশ্যমান শাস্তির আওতায় আনতে হবে। তবে আলুর বাজার স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে অভিমত প্রকাশ করেন তিনি।

বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, এবার আলুর উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৮৫ লাখ মেট্রিক টন। বাংলাদেশে মোট কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা ৪০৭টি। বর্তমানে চালু আছে ৩৯৩টি। এসব হিমাগারে এবার ৪৫ লাখ মেট্রিক টন আলু সংরক্ষণ করে। এর মধ্যে ৫৫ শতাংশ আলু বাজারজাত হয়েছে। তার মধ্যে ১০ লাখ টন বীজ আলু। বাকি আলু এখনো হিমাগারগুলোতে রয়ে গেছে। তারপরও খুচরা বাজারে কমছে না আলুর দাম।

আমারসংবাদ/এসটিএম