Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

ঝুলছে ৩ হাজার মামলার বিচার

শরিফ রুবেল

নভেম্বর ৫, ২০২০, ০৪:৫৪ এএম


ঝুলছে ৩ হাজার মামলার বিচার

২০১০ সালের ১৩ জুন। সকালে বিকট গুলির শব্দে কেঁপে ওঠে এলাকা। এদিন যাত্রাবাড়ীর উত্তর কুতুবখালীতে রিংকু নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। হত্যার পরে নিহতের ভগ্নিপতি নাহিদ হাসান যাত্রাবাড়ী থানায় হীরা ওরফে হারুনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ মামলায় হীরাকে গ্রেপ্তারও করা হয়। ওই বছরের ১২ জুলাই বিচারিক আদালতে হাজির করা হয়।

পরে হীরা জবানবন্দিতে হত্যার কথা স্বীকার করে। পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে। ওই মামলায় নিম্ন আদালতে হীরার জামিন আবেদন নামঞ্জুর হলে সেই বছরের ১১ নভেম্বর হাইকোর্টে তিনি জামিনের আবেদন করেন।

আবেদনকারী পক্ষ জানায়, এ মামলায় গত ছয় বছরে একজনও সাক্ষ্য দেননি। শত চেষ্টার পরও হাজির করা যায়নি কোনো সাক্ষীকে। সাক্ষী একাধিকবার অনুপস্থিত থাকায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে সমন জারি করলেও হাজির হয়নি কেউ। শুধু রিংকু হত্যামামলার সাক্ষীরাই নয়, অধিকাংশ ফৌজদারি মামলার সাক্ষীরা যথাসময়ে আদালতে হাজির না হওয়ায় সাক্ষীর অভাবে মামলার বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

ফলে আদালতগুলোতে জমছে মামলার পাহাড়। মামলার সংখ্যা না কমে প্রতিবছরই বাড়ছে। বেশির ভাগ বিচারাধীন মামলায় সাক্ষী হাজির হয় না। রাষ্ট্রপক্ষ আদালতে সাক্ষীকে হাজির করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণে ন্যায়বিচার লঙ্ঘিত হয়। খালাস পেয়ে যায় সন্ত্রাসীরা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সাক্ষী হাজির না হওয়ার অন্যতম কারণ তাদের নিরাপত্তাহীনতা। এদিকে সাক্ষীর প্রতি হুমকির ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এ কারণে বিভিন্ন মামলায় সাক্ষীরা প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।

এছাড়া সাক্ষীদের অনুপস্থিতিতে অনেক ফৌজদারি মামলায় অভিযোগ প্রমাণ করা যায় না। এতে কোনো কোনো সময় মামলার প্রকৃত আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। পাশাপাশি বিলম্বিত হয় বিচার কার্যক্রমও। এমনকি মামলার আসামিরা খালাস পর্যন্ত পেয়ে যায়। ফলে জরুরি হয়ে পড়েছে সাক্ষীদের নিরাপত্তার জন্য ‘সাক্ষী সুরক্ষা’ আইন প্রণয়ন।

তারিখ পড়েছে ১১২ বার, বিচারক বদল হয়েছে ১১ জন তবুও হাজির হয়নি সাক্ষী : পুরান ঢাকার জগন্নাথ সাহা রোডে ১৯৮৮ সালের ২৬ এপ্রিল খুন হন সীমা মোহাম্মদী (২০)। বাড়িতে ঢুকে ছুরিকাঘাত করে সীমাকে হত্যা করে মোহাম্মদ আহমদ ওরফে আমিন নামে এক যুবক। ঘটনার পরপরই ওই যুবকের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় হত্যামামলা করেন সীমার মা ইজহার মোহাম্মদী।দুই মাস পর ২৫ জুন পলাতক আমিনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।

২০০১ সালের ২৯ এপ্রিল অভিযোগ গঠনের পরও সাক্ষ্য দিতে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা ও ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের অনীহার কারণে মামলার বিচারকাজ বারবার পিছিয়ে যায়। অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলেও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের তৎকালীন প্রভাষক আনোয়ার হোসেন সাক্ষ্য দিতে অদ্যাবধি আদালতে হাজির হননি। ওই চিকিৎসককে এ পর্যন্ত অর্ধশত অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে ঢাকার জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক চমন বেগম চৌধুরীর আদালতে বিচারাধীন।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য এ পর্যন্ত মামলার তারিখ পড়েছে ১১২ বার। ১১ জন বিচারক বদল হয়েছেন। সরকার পাল্টেছে ১০ বার। মামলার একমাত্র আসামি আমিন এখনো পলাতক। এদিকে মামলার বাদি সীমার মা বিচারের অপেক্ষায় থেকে শেষ পর্যন্ত মারা গেছেন। বাবারও মৃত্যু হয়েছে। ওয়ারেন্ট দিয়েও সাক্ষী হাজির করা সম্ভব হয়নি।

বেশ কয়েকটি মামলার নথি পর্যালোচনা করে আরও দেখা যায়, যেসব মামলার সাক্ষী আসছেন না, সেগুলোর বেশির ভাগই হত্যা, ডাকাতি, ধর্ষণ, অস্ত্র ও ছিনতাইয়ের মামলা। গুরুতর অপরাধের এসব মামলায় সহজে কেউ সাক্ষ্য দিতে চান না। আইন অনুসারে আদালতের আদেশের পর সাক্ষী হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। সাক্ষীর বিষয়টি নিশ্চিত করবে প্রসিকিউশন। মূলত এ দুপক্ষের কাজে কোনো সমন্বয় নেই।

জানা যায়, ঢাকার ১৬টি আদালতে ৫০ হাজারের বেশি ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন। সাক্ষীর অভাবে প্রায় তিন হাজার মামলার বিচার কাজ এক যুগের বেশি সময় ধরে ঝুলে রয়েছে। এর মধ্যে ২৩ বছরের পুরনো মামলাও রয়েছে কয়েকটি। এসব মামলায় বারবার নির্ধারিত তারিখে সাক্ষীদের হাজির করতে ব্যর্থ হচ্ছে পুলিশ। ভাড়াটিয়া হওয়ায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাক্ষীর বাসা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এভাবে দীর্ঘদিন ধরে আদালতে দায়সারা প্রতিবেদন দাখিল করা হচ্ছে। ফৌজদারি আইনের ১৭১ (২) উপধারায় বলা আছে, সাক্ষী হাজির করা পুলিশের কাজ।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অনেক ক্ষেত্রেই আসামিপক্ষ সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে সাক্ষীদের আদালতে হাজির না করার ব্যবস্থা করে। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় যাবতীয় সুবিধা পাচ্ছে আসামিপক্ষ। কারণ, বছরের পর বছর বিচারাধীন থাকায় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা দুরূহ হয়ে পড়ে রাষ্ট্রপক্ষের। একপর্যায়ে আসামিরাও জামিনে বের হয়ে যান।

ঢাকা মহানগরের বিভিন্ন আদালতের পৃথক ৩০টি হত্যা ও অস্ত্র মামলার নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, ওইসব মামলায় সাক্ষী হিসেবে ১০০ জনের বেশি পুলিশ সদস্য ও ২৭০ জনের বেশি সাধারণ সাক্ষীকে খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। প্রতিটি মামলার চার্জশিটে সাক্ষীদের স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা রয়েছে। এক যুগে একজনেরও সাক্ষ্য হয়নি, এমন মামলার নজিরও অসংখ্য। ফলে এসব মামলার ভবিষ্যৎ এক রকম অনিশ্চিত বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

তাদের মতে, সাক্ষীর অভাবে একদিকে গুরুতর অপরাধের আসামিরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে জামিনে বের হয়ে যাচ্ছেন। অপরদিকে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ায় অনেক আসামি বিনাবিচারে বছরের পর বছর কারাগারে থাকছেন।

২৩ বছরের পুরনো মামলা : ঢাকা মহানগর আদালতে মাদকদ্রব্য আইনে করা একটি মামলা ২৩ বছর ধরে বিচারাধীন রয়েছে। ১৯৯৪ সালের এপ্রিলে রাজধানীর কোতোয়ালি থানায় এ মামলাটি করা হয়। যার নম্বর কোতোয়ালি থানা ৩০(০৪)৯৪। এ মামলার আসামি মেহেদী হাসান জামিনে আছেন। ২০০২ সালের ১৯ আগস্ট এ মামলায় অভিযোগ গঠন করেন আদালত। আজও সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়নি। মোট ১১ সাক্ষীর মধ্যে তিনজনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে।

অবশিষ্ট সাক্ষীদের মধ্যে আছেন তৎকালীন ডিএমপির সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক শেখ আলী হায়দার, সিআইডির আরেক পুলিশ পরিদর্শক পরিতোষ বণিক এবং জনৈক মো. শাহজাহান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইউনুস চৌধুরী। বাকি চার সাক্ষীর নাম-ঠিকানা চার্জশিটে অস্পষ্ট। এছাড়া সাক্ষী না আসায় ২৬ বছর ধরে ঝুলছে আরেকটি মামলা। এ মামলাটিও ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন।

সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, সাক্ষী হাজির করা যাদের দায়িত্ব, তারা যদি আদালতে সময়মতো সাক্ষী হাজির করতে না পারেন, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান ফৌজদারি কার্যবিধিতে সংযোজন করা যেতে পারে। এটা করা হলে সাক্ষী হাজির করার সমস্যা হয়তো আর থাকবে না।

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ইকবাল হোসেন বলেন, আলোচিত মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকায় সম্পূর্ণ দোষ পুলিশের নয়। একটি নির্দিষ্ট সময় পর সাক্ষী না এলে প্রতিটি বিচারকের ক্ষমতা দেয়া আছে তারা (বিচারক) মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে পারেন। এটা সম্পূর্ণই বিচারকের ওপর নির্ভরশীল।

ঢাকা মহানগর আদালতের প্রধান পিপি আবদুল্লাহ আবু বলেন, দীর্ঘদিন আদালতে সাক্ষী না এলে মামলা হালকা হয়ে যায়। এতে আসামিপক্ষ সুবিধা নেয়।

তিনি বলেন, পুলিশই যাচাই-বাছাই করে চার্জশিটে সাক্ষীদের নাম যুক্ত করে। আবার সাক্ষী হাজিরের সময় হলে তারাই ঠিকানা অনুসারে সাক্ষীকে খুঁজে পায় না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি সাক্ষীকে আদালতে হাজির করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়। তবে ঠিকানা পরিবর্তন করলে সেক্ষেত্রে সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার তদন্ত কর্মকর্তারাও অনেক সময় বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন।

দেখা যায়, যে সময়ে সাক্ষ্য দিতে আদালত থেকে সমন আসে, ততক্ষণে ওই কর্মকর্তা অন্যত্র বদলি হয়ে যান। সব কর্মকর্তাকে যথাযথ সময়ে মামলায় সাক্ষ্য দেয়ার নির্দেশনা দেয়া আছে। তবে বাস্তব প্রেক্ষাপটে ঠিক কতজন পুলিশ সদস্য আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না- এমন কোনো তথ্য সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি।

আমারসংবাদ/এসটিএম