Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

৬ মাসে যৌতুকের বলি ৫১ গৃহবধূ

জাহিদুল ইসলাম সিহাব॥প্রিন্ট সংস্করণ

জুন ৩০, ২০১৭, ০৮:৪০ এএম


৬ মাসে যৌতুকের বলি ৫১ গৃহবধূ

নারী নির্যাতন বা নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে নানা উদ্যোগ নেয়া সত্ত্বেও কমছে না নারী নির্যাতন। বিগত বছরগুলোর মতো চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত সারা দেশে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শিকার হয়ে খুন হয়েছেন ৫১ জন গৃহবধূ।

এছাড়াও যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৬৪ জন। ১১৪ জন গৃহবধূ যৌতুকের কারণে নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছেন। এরমধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার ৫৪ জন, মামলা হয় ৩২টি, স্বামীর ঘর থেকে বিতাড়িত হয় ১০, নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা ৩ এবং শারীরিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয় ৫১ জন নারীকে, মামলা হয় ২৯টি। আইন ও সালিসকেন্দ্র, আমার সংবাদের অনুসন্ধান এবং বিভিন্ন গণমাধ্যম সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ২০১৬ সালে যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয় ২৩৯ জন নারী, মামলা হয় ৯৫টি, পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৯৪ জন নারী, এর মধ্যে থানায় মামলা হয়েছে ১৮৭টি। কিন্তু ২০১৬ সালের তুলনায় চলতি বছর যৌতুককেন্দ্রিক নির্যাতনের শিকার বেড়েই চলছে। বিগত বছরগুলোতে নারী উত্ত্যক্ত করা, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, সালিস ও ফতোয়ার মাধ্যমে নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা, অ্যাসিড নিক্ষেপ, পারিবারিক নির্যাতন ও গৃহকর্মী নির্যাতনসহ নারী নির্যাতনের অনেক নৃশংস ঘটনা ঘটে।

এসব ঘটনার ক্ষেত্রে মামলা হলেও বিচার-প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার কারণে অনেকে আপস-মীমাংসা করতে বাধ্য হচ্ছেন। অন্যদিকে দেশের নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখেও ’বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন ২০১৬’-র খসড়া অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এতে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ থাকলেও বিশেষ ক্ষেত্রে ‘সর্বোত্তম স্বার্থে’ আদালতের নির্দেশ এবং মা-বাবার সম্মতিতে ১৮-র নিচে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের বিয়ের বিধান রাখা হয়েছে। সর্বশেষ চলতি মাসে যৌতুকের শিকার হয়ে ৪ জন গৃহবধূ খুন হন। এরা হচ্ছেন রৌশনআরা, ওম্মে কুলসুম, লিমা, ও ঋতু ঘোষ।

গত ১৮ জুন সাটুরিয়ায় যৌতুকের দাবিকৃত দেড়ভরি স্বর্ণ না পেয়ে এক গৃহবধূকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ শ্বশুর আনন্দ মিয়াকে আটক করেছে। নিহত গৃহবধূ রৌশনারা বেগমের পরিবারের অভিযোগ, তাদের মেয়েকে হত্যা করে বসত ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এরপর এলাকায় আত্মহত্যা করার কথা প্রচার করেছে স্বামী ও তার পরিবারের লোকজন। ঘটনাটি ঘটেছে উপজেলার পূর্ব চর তিল্ডি গ্রামে। গত রোববার সকালে খবর পেয়ে সাটুরিয়া থানা পুলিশ গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করেছে।

গৃহবধূ রৌশনারার ভাই মহিদুর রহমান জানান, তার বোনকে রাতভর অত্যাচার করে স্বামী শফিক, শ্বশুর আনন্দ মিয়া ও শাশুড়ি রাবিয়া বেগম। তিনি আরও জানান, লাশের গায়ে বিভিন্ন স্থানে ক্ষত চিহ্ন দেখা গেছে। একই দিনে যৌতুকের জন্য ভোলার লালমোহন উপজেলায় লিমা (২২) নামে এক গৃহবধূকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে। উপজেলার কালমা ইউনিয়নের চরছকিনা গ্রাম থেকে গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত গৃহবধূর মা শিরিন আক্তারের অভিযোগ, যৌতুকের জন্য লিমাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

পুলিশ জানায়, দেড় বছর আগে চর ছকিনা গ্রামের কামালের ছেলে শাহীনের সঙ্গে একই এলাকার মফিজল ইসলামের মেয়ে লিমার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে যৌতুকের জন্য লিমার ওপর নির্যাতন চালান শাহীন। তাদের একটি সন্তান রয়েছে। সরেজমিন জানা যায়, শনিবার রাতে লিমার সঙ্গে শাহিনের কথা কাটাকাটি হয়। রোববার সকাল ৭টার দিকে ঘরের ভেতর লিমার গলায় ওড়না পেঁচানো অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তার বড় বোন সীমা। খবর পেয়ে পুলিশ এসে লিমার লাশ উদ্ধার করেন। নিহত লিমার মা শিরিন বেগম বলেন, লিমাকে তার স্বামী শাহিন যৌতুকের জন্য শ্বাসরোধ করে হত্যা করে পালিয়েছে। লালমোহন থানায় স্বামীসহ ৪ জনকে আসামি করে মামলায় করা হয়েছে।

গত ৮ জুন দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম ধরন্দায় যৌতুকের কারণে মঙ্গলবার রাতে বিয়ের ৩ মাসের মাথায় শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয় নববধূ উম্মে কুলসুমাকে। হত্যার পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেয়ার জন্য কুলসুমের লাশ শয়নকক্ষের বরগার সাথে ঝুলিয়ে রাখা হয়। হাকিমপুর থানার ওসি আব্দুস সবুর জানান, হাকিমপুর উপজেলার ধরন্দা গ্রামের আব্দুল লতিফ হোসেনের ছেলে সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে পাশ্ববর্তী বিরামপুর উপজেলার ধানধড়া গ্রামের আফতাব উদ্দিনের মেয়ে উম্মে কুলসুমার বিয়ে হয় ৩ মাস আগে। বিয়ের পর থেকে কুলসুমার উপর নেমে আসে যৌতুকের কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। যৌতুকের কারণে অপমান সইতে হয় কুলসুমার দরিদ্র পিতা-মাতাকে।

স্বামী সাজ্জাদ ও তার পরিবার শ্বশুড়-শাশুড়ির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। মঙ্গলবার রাতে যৌতুক নিয়ে উম্মে কুলসুমার সঙ্গে বাক-বিত-ায় জড়িয়ে পড়েন সাজ্জাদসহ তার পরিবারের লোকজন। শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয় নববধূকে। ঘটনা বেগতিক দেখে ঘাতক স্বামী সাজ্জাদ ও তার পরিবারের লোকজন কুলসুমার মরদেহ ঘরের বর্গার সঙ্গে বেঁধে রাতেই প্রতিবেশীদের মাঝে প্রচার করে কুলসুমা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। নিহত উম্মে কুলসুমার বাবা আফতাব উদ্দিন বাদী হয়ে কুলসুমার স্বামী সাজ্জাদ, শ্বশুড়-শাশুড়িসহ ৯ জনকে আসামি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে হাকিমপুর থানায় মামলা করেছেন।

এছাড়া ময়মনসিংহে আরও ১ জন গৃহবধূকে হত্যা করা হয়। বিশ্লেষকরা বলে মনে করেন, নারীর প্রতি সংঘটিত অপরাধকে খাটো করে দেখা, আইনের সঠিক প্রয়োগ না হওয়া, সাক্ষীকে ভয় দেখানো, প্রভাবশালীদের অর্থের প্রলোভন ও নির্যাতিত পরিবার ঘটনা চেপে যাওয়ার চেষ্টার কারণেই নারী নির্যাতন রোধ সম্ভব হচ্ছে না। তারা আরও বলেন, আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। আমরা সবাই হয়তো নেপোলিয়ন বা নজরুলের মতো করে ভাবতে পারি না, যদি আমাদের বিবেককে জিজ্ঞেস করি এই যে নৃশংসতা, নির্যাতনের স্টিম রোলার এ থেকে আমরা কি পেয়েছি? বা সমাজ কি পেয়েছে? যদি আমরা সঠিকভাবে চিন্তা করি তাহলে সমাজ থেকে নৃশংসতা নির্যাতন কমানো সম্ভব।