Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

মাথাপিছু ৪৬ হাজার টাকা ঋণের বোঝা

ওমর ফারুক॥প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই ১, ২০১৭, ১২:০৩ পিএম


মাথাপিছু ৪৬ হাজার টাকা ঋণের বোঝা

২০০৮ সালের পর ২০১৪ সালে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসায় আওয়ামী লীগ সরকারের চতুর্থ বাজেটের আকার ছিল ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। যা গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ছিল ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যকে সামনে রেখে চলমান উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে সরকার। উচ্চতর প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহত রাখতে সম্প্রতি জাতীয় সংসদ অধিবেশনে কণ্ঠভোটে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট পাস হয়েছে এবং আজ (পয়লা জুলাই) থেকে এটি কার্যকর শুরু।

এদিকে বাজেটের আকার বড় হওয়ায় এবং সরকারের ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়ায় দেশে মানুষের মাথাপিছু ঋণ পরিমাণের বোঝাও বেড়েই চলছে। মাথাপিছু ঋণ ৪৬ হাজার ১৭৭ টাকার বোঝা নিয়ে আগামীকাল থেকেই দেশের প্রতিটি মানুষ শুরু করবে ২০১৭-১৮ নতুন অর্থবছর। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে যা ছিল ৩৯ হাজার ৯৬৩ টাকা। তবে দেশের অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অর্থমন্ত্রী বড় বাজেট দিলেও বেশি আয় করতে পারছেন না। এতে বাড়ছে বাজেট ঘাটতি। আর তা মেটাতে তার ভরসা এখন ঋণ। এই ঋণ প্রতিবছর বেড়েই চলছে।

এর ফলে জনগণের উপর ঋণের বোঝাও সমান তালেই বাড়ছে। তারা মনে করে, ঋণ বেড়ে যাওয়ায় বাজেট শৃঙ্খলাও নষ্ট হচ্ছে। বিশাল অংকের টাকাও খরচ হয়ে যাচ্ছে সুদ পরিশোধে। সুদ পরিশোধে এত বেশি অর্থ বরাদ্দ রাখতে না হলে সরকার শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বেশি রাখতে পারতো। অন্যদিকে গত পয়লা জুন বাজেট পেশের দিন প্রকাশিত মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি বাজেটের আকার বাড়ছে, কিন্তু অভ্যন্তরীণ সম্পদ বাড়ছে না। ফলে বাজেট ঘাটতি বেড়ে চলেছে এবং সরকার বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। অন্যদিকে নতুন ভ্যাট আইন থেকে সরকার পিছিয়ে আসায় এলোমেলো হয়ে গেছে নতুন বাজেট। নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা বেশি রাজস্ব আয়ের পরিকল্পনা ছিল অর্থমন্ত্রীর। আর বেশি আয়ের ওপর নির্ভর করেই বিশাল একটি বাজেট তৈরি করা হয়েছিল। সেই পরিকল্পনায় বড় ধরনের ধাক্কা খেলেন অর্থমন্ত্রী ও সরকার।

ফলে বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল বাজেট পাসের সঙ্গে সঙ্গেই। এমনকি সরকারের ঋণ গ্রহণের পরিমাণ বাড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাওয়া তথ্য মতে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছর শেষে দেশি-বিদেশি মিলিয়ে রাষ্ট্রের মোট ঋণ দাঁড়াবে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৯৩০ কোটি টাকা। যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৪ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে দেশের ভেতর থেকে নেয়া ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ ৭১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ ২ লাখ ৯০ হাজার ৪৩০ কোটি টাকা। সদ্য সমাপ্ত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পুরো দেশের মানুষের ওপর ৬ লাখ ৫৯ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ঋণ ছিল। সুদসহ আগের বছরগুলোর মূল টাকাও সরকার প্রতিবছর পরিশোধ করে আসছে। পরিশোধ না হওয়া টাকা জমতে জমতেই ঋণের বোঝা এত বড় হয়েছে।

এদিকে গত ৩০ মে দেশের জনসংখ্যার একটি হিসাব দিয়েছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। বিবিএসের মতে, গত ১ জানুয়ারি পর্যন্ত দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার। সে হিসেবে আগামী অর্থবছর শেষে দেশের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১৬ কোটি ৫০ লাখ এবং মাথাপিছু ঋণ দাঁড়াবে ৪৬ হাজার ১৭৭ টাকা। সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে মাথাপিছু ঋণ ছিল ৩৯ হাজার ৯৬৩ টাকা। এ বিষয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকারকে ব্যয়বহুল ঋণ বেশি নিতে হচ্ছে। এর অর্থই হচ্ছে স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মতো অগ্রাধিকার খাতগুলোতে সরকার প্রয়োজন অনুযায়ী বরাদ্দ রাখতে পারছে না। সরকারের উচিত ঘাটতি বাজেট কমিয়ে বাজেটকে পরিপূর্ণ কাজে ব্যবহার করা। বাজেটের আকার ছোট হোক বা বড় হোক দেশের অর্থনীতি সুফল ধরে রাখাটা হলো সবচেয়ে বড় ব্যাপার।

তবে ঘাটতি বাজেট কমিয়ে আনতে পারলে মানুষের ঋণের পরিমাণ কিছুটা হলেও কমবে। মানুষ ঋণের দায় থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি মিলবে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমার সংবাদকে জানান, প্রতিবছর সরকারের বড় বাজেটের পাশাপাশি বাজেট ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। বাজেট বড় হওয়াটা কোনও বড় ব্যাপার নয়, তবে বাজেটকে পরিপূর্ণ অথবা সম্পন্নরূপ দিয়ে বাস্তবায়ন করাটা হলো মূলকথা। বাজেট বড় হচ্ছে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের মাথাপিছু ঋণ। সরকার যদি যথাযথ উদ্যোগ এবং সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ করে তবেই মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ এবং বাজেটের ঘাটতি কমবে। তবে আশা করি, সরকার জনগণকে এ দায় থেকে মুক্তি দেবে।

টিআইবির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণ করার জন্য বাধ্য হয়ে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছে। কিন্তু ঋণের বোঝা সকল মানুষের ওপর পড়ছে এতে করে দেশের অর্থনীতির চাহিদা কি পূরণ হচ্ছে সেটা দেখার বিষয়। পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, সরকার ঠিক মতো ঋণ ব্যবস্থাপনা করতে পারছে না বলেই এর দায় নিতে হচ্ছে জনগণকে। একসময় দেশি-বিদেশি ঋণের হার ছিল অর্ধেক-অর্ধেক। বিদেশ থেকে ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে যেহেতু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রশ্নটি থাকে, সরকার তাই সে পথে যায় না। সরকার সহজ পথ হিসেবে বেছে নেয় বেশি সুদের অভ্যন্তরীণ উৎসকে। সুষ্ঠু ঋণ ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা একটি বিভাগ গঠনের পরামর্শও দেন তিনি।

অন্যদিকে চলতি অর্থবছরের জন্য পাস হওয়া ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে অনুন্নয়ন বাজেট ২ লাখ ৪৫ হাজার ১৪ কোটি টাকার। এর মধ্যে সুদ পরিশোধে রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৪৫৭ কোটি টাকা, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদই ৩৯ হাজার ৫১১ কোটি টাকা। মোট বাজেটের প্রায় ১৭ শতাংশ অর্থই ব্যয় হচ্ছে ঋণের সুদ পরিশোধে। সুদ পরিশোধের পুরো বরাদ্দ কোন কোন খাতে ব্যয় করা হবে, বাজেটে তার চিত্রও তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা ব্যয় হবে সঞ্চয়পত্রের সুদে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যয় হবে মেয়াদি ঋণের সুদে। বাজেট সংক্ষিপ্তসারের অনুন্নয়ন ও উন্নয়ন ব্যয়ের অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে সঞ্চয়পত্রের সুদ দিতে বরাদ্দ রাখা আছে ১৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা।

চলতি অর্থবছরে ১৬ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা রাখা হলেও সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে করা হয় ১৫ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা। আর আগামী অর্থবছরে ১৪ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা আছে মেয়াদি ঋণের সুদ বাবদ। যদিও ১০ মাসেই (জুলাই-এপ্রিল) ৪৩ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। সংশোধিত বাজেটে বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়। অথচ চলতি অর্থবছরে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা ছিল। আগামী অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ৩০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।