Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

তদন্ত শেষ হয়নি এক বছরেও পাঁচজনকে খুঁজছে পুলিশ

আব্দুল লতিফ রানা॥প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই ১, ২০১৭, ০৮:০৭ এএম


তদন্ত শেষ হয়নি এক বছরেও পাঁচজনকে খুঁজছে পুলিশ

আজ দেশের ইতিহাসে গুলশান হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি সন্ত্রাসী হামলায় বিদেশিসহ নারকীয় হত্যাকা-ের এক বছর পূর্তি হলো। কিন্তু সেই নারকীয় হত্যাযজ্ঞের মামলার চার্জশিট দীর্ঘ এক বছরেও আদালতে জমা দিতে পারেনি পুলিশ। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, গুলশানের অভিজাত রেস্তোরা ‘হলি আর্টিজান’ বেকারিতে জঙ্গিহামলার অভিযোগপত্র খুব শিগগির দেওয়া হবে।

গত বুধবার দুপুরে সচিবালয়ে ঈদের ছুটি শেষে প্রথম কর্মদিবসে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে সাংবাদিকদের তিনি একথা বলেন। হলি আর্টিজানে জঙ্গিহামলার এক বছর হতে যাচ্ছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ১ জুলাই সেই দিনটি আমাদের জন্য একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। আমরা বুঝতে শিখেছিলাম, এই জঙ্গিরা কী চায়, কী তাদের উদ্দেশ্য, কারা তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা, কারা অর্থায়ন করেছে। সবই খুব সূক্ষভাবে দেখেছি। সেই জন্য অভিযোগপত্র দিতে একটু সময় নিয়েছি। আমরা এখানে নির্ভুল অভিযোগপত্র দেব। কোনো ত্রুটি ছাড়া অভিযোগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং খুব শিগগির অভিযোগপত্র দিতে পারব।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটি) প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, চাঞ্চল্যকর গুলশান হলি আর্টিজানের হত্যাহামলার সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে নতুন করে আরো ৫ জনকে খোঁজা হচ্ছে। আর ওই ৫ জনের মধ্যে অন্তত ৩ জনকে গ্রেপ্তার করতে পারলেও এ মামলার চার্জশিট দেওয়া সম্ভব বলে সম্প্রতি সাংবাদিকদের কাছে এক অনানুষ্ঠানিক ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা তুলে ধরেন। মনিরুল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সালের পহেলা জুলাই রাতে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় যে ভয়াবহতম সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। সেখানে হামলাকারী ৫ জঙ্গি সন্ত্রাসী নিহত হয়।

এরপর যারা এ হামলার পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল তাদের মধ্যে ৮ জন বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়। আর ৪ জনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়। এছাড়া, মামলার তদন্তে আরো ৫ জনের নাম পাওয়া গেছে। যাদের নাম পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে অন্তত ৩ জনকে গ্রেপ্তার এবং নিহত জঙ্গিদের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে পেলেই মামলার চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। নতুন এ পাঁচ জঙ্গির মধ্যে সোহেল মাহফুজ, রাশেদ ওরফে র‌্যাশ এবং বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট বাশারসহ ৩ জনের নাম মনিরুল ইসলাম জানিয়েছেন।

সিটি প্রধান বলেছেন, গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার ঘটনায় যেসব অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল তার সবই চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সংগ্রহ করে আনা হয়েছিল। এই মামলায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে গ্রেপ্তার করা হয়। সে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। আর সম্পূর্ণ বিস্ফোরক ও অস্ত্র কে বা কারা এনেছিল সেটি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এজন্যই অন্তত আরো পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করতে পারলে প্রাপ্ত তথ্যগুলো যাচাই করা যাবে। আর তখনই মামলার তদন্তের পুরো চিত্রটা উল্টে যেতে পারে।

তিনি আরো বলেন, গুলশানে যারা হামলা চালিয়েছিল, তারা জানান দেওয়ার জন্যই করেছিল এবং জানান দেওয়াই তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল। আর তাদের নিজস্ব কিছু স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ও ছিল। যেমন তারা মনে করতো, এই ধরনের হামলার পর বেশিসংখ্যক মানুষ আস্থা অর্জন করবে এবং তাদের দলে যোগ দেবে। এটি সফল হলে রিক্রুটমেন্ট প্রসেসটা সহজ হবে। আর পাশাপাশি তারা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সোর্স থেকে অনেক অর্থ উপার্জন করতে পারবে। আর এ ঘটনার বেনিফিসিয়ারি তো যারা গভর্নমেন্টের মঙ্গল চায় না, বিনিয়োগ বন্ধ হোক, গভর্নমেন্টের ওপর থেকে আস্থা নষ্ট হোক ও বিদেশিরা তাদের ব্যবসা গুটিয়ে এদেশ থেকে চলে যাক, তারা তো কিছুটা বেনিফিসিয়ারি হয়েছে। তাদের ভূমিকা এ হামলার সঙ্গে কি আছে না আছে, তারা বেনিফিসিয়ারি হয়েছে।

মনিরুল ইসলাম বলেন, হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার পরিকল্পনার আগে যেহেতু হামলাকারীরা আগেই ঘর ছেড়েছে। তারা ঝিনাইদহে আশ্রয় নিয়েছিল। জঙ্গি নিবরাস ও রোহান ইমতিয়াজ জিহাদের নামে কথিত হিজরত করেছে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার ঘটনার বেশ আগে। এরপর তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় থেকেছে। ঝিনাইদহেও তারা অবস্থান করেছিল বলে মামলার তদন্তে প্রমাণ পাওয়া গেছে। আর তারা সেখানে একাধিক বিষয়ে হাতে-কলমে অর্থাৎ প্রাকটিক্যাল রিহার্সেল করেছে।

সিটি প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, চাঞ্চল্যকর এ মামলার মূল আসামিদের যারা ছিল, তাদের মাস্টারমাইন্ডদের মধ্যে জঙ্গি নেতা তামীম চৌধুরী, মাস্টার ট্রেইনার মেজর (অব.) জাহিদ, তানভীর কাদেরী ও নুরুল ইসলাম মারজান অন্যতম ছিল। এরাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এদেরকে জীবিত ধরা গেলে হয়তো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের সন্ত্রাসী বা সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল কি না, সে ব্যাপারে নিশ্চিত করা যেত। কিন্তু আনফরচুনেটলি কাউকে জীবিত ধরা যায়নি। ফলে ওই লিঙ্কটা এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্টভাবে বলতে পারব না। তথাপি যে তিনজনের নাম বলা হচ্ছে এদেরকে ধরতে পারলে হয়তো বা বাকি তদন্তটুকু নিশ্চিত করতে পারবেন বলে তিনি জানিয়েছেন।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অবস্থান কোন পর্যায়ে জানতে চাইলে মনিরুল ইসলাম বলেন, গত বছর হামলাটি যখন জঙ্গিহামলার সংঘটিত হয়, তার আগে ছোট ছোট আকারে জঙ্গিরা রিহার্সেল হামলা চালানো হয়েছিল। সবশেষ তারা হলি আর্টিজানে হামলা চালায়। এই ঘটনার আগে জঙ্গি দমন বা সন্ত্রাসী দমন কার্যক্রমের সঙ্গে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই সম্পৃক্ত ছিল। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধ দাঁড়ায়। এরপরই মূলত সারাদেশে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে একটা গুণগত পরিবর্তন আসে। আর গত এক বছরে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট কর্মকর্তা সেট-আপ করেছে, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, অভিজ্ঞতা বেড়েছে। এরই মধ্যে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি জঙ্গি আস্তানায় অভিযান পরিচালিত হয়েছে। এক বছর পর এসে বলব যে, হলি আর্টিজানের মতো বড় কোনো হামলা করার মতো শক্তি বা ক্ষমতা জঙ্গিদের এই মুহূর্তে নেই।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গুলশানে হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ১৭ জনকে বছরের শুরুতে সনাক্ত করা হয়। তার মধ্যে ১৩ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়। নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান নামে এক জঙ্গি নিহত হয়। আর একজন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছে। জঙ্গিদের এদের মধ্যে রাজীব গুলশান হামলার জন্য বগুড়ার দুজন জঙ্গিকে নিয়োগ করেন। হামলার আগ দিয়ে ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ভাড়া বাসায় থেকে হামলায় যুক্ত জঙ্গিদের উদ্বুদ্ধ করেন। সাগর সীমান্তের ওপার থেকে আসা অস্ত্র ঢাকায় মারজানের কাছে পৌঁছান, যা পরে হামলাকারীরা ব্যবহার করেন। আর সফটওয়্যার প্রকৌশলী বাশারুজ্জামান মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশ থেকে দুই দফায় হুন্ডির মাধ্যমে আসা ২০ লাখ টাকা গ্রহণ করেন।

আর সেই টাকা গুলশান হামলার কাজে ব্যবহৃত হয়। বাশারুজ্জামানের স্ত্রী শায়লা আফরিন, মারজানের স্ত্রী প্রিয়তি ও তানভীর কাদেরীর স্ত্রী আবেদাতুন ফাতেমা আজিমপুরের জঙ্গি আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার হন। জঙ্গিদের স্ত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেও অনেক তথ্য পাওয়া গেছে বলে জানান তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণ। আর চিহ্নিত ১৭ জঙ্গির মধ্যে পাঁচজন গুলশান হামলায় সরাসরি অংশ নিয়েছিল। আর বাকিরা হামলার পরিকল্পনা, সমন্বয়, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র বোমা সংগ্রহসহ বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িত ছিলেন। এরা সবাই ‘নব্য জেএমবি’র সঙ্গে যুক্ত।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, গুলশান হামলায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করা হয়েছে। মূল পরিকল্পনাকারীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের জড়িত অনেকেই ইতিমধ্যে পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে নিহত হয়েছেন। আর গুলশান হামলার মূল সমন্বয়ক ও পরিকল্পনাকারী ছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম রচৗধুরী। তার সঙ্গে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ে যুক্ত ছিলেন নুরুল ইসলাম ওরফে মারজান। যোগাযোগ সমন্বয়ক ছিলেন তাওসিফ হোসেন।

অপর এক সূত্র জানায়, হলি আর্টিজানে দেশি-বিদেশি নাগরিকদের নৃশংসভাবে হত্যার পর ভেতর থেকে তাদের ছবি তুলে মারজানের কাছে পাঠিয়েছিল জঙ্গিরা। এরপর মারজান সেসব ছবি পাঠায় তামিম চৌধুরীর কাছে। পরে তামিম ওই সব ছবি আইএসের কথিত বার্তা সংস্থা আমাক নিউজে পাঠান, যা ওই রাতে ইন্টারনেটে প্রচার পায়। গত ২০১৬ সালের ২৭ আগস্ট তামিম চৌধুরী ও তাওসিফ নারায়ণগঞ্জে পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হন। আর মারজান নিহত হন চলতি বছরের শুরুতে গভীর রাতে ঢাকায় এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’।

সূত্রটি আরো জানায়, গুলশান ও শোলাকিয়ায় হামলায় জড়িত জঙ্গিদের গাইবান্ধার চরে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদুল ইসলাম ওরফে মুরাদ, রায়হান ইবনে কবির ও রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান। এদের মধ্যে মেজর জাহিদ গত বছরের ২ সেপ্টেম্বর রূপনগরে ও রায়হান গত বছর ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে অভিযানে নিহত হন। আর জঙ্গি রিগ্যান কল্যাণপুরের অভিযানে আহত অবস্থায় গ্রেপ্তার হয়। পরে গুলশান হামলার ঘটনায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। কল্যাণপুরে নিহত আরেক জঙ্গি আবু নাঈম হাকিম গুলশান হামলার অস্ত্র সংগ্রহে যুক্ত ছিলেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

এছাড়া, গত বছর ১০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আজিমপুরে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের কর্মকর্তা তানভীর কাদেরী নিহত হয়। আর ফরিদুল ইসলাম ওরফে আকাশ গত বছর ৮ অক্টোবর গাজীপুরে জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়। গুলশান হামলায় জড়িত জঙ্গিদের থাকার জন্য ঢাকার বিভিন্ন স্থানে বাসা ভাড়া করেছিলেন। হামলায় জড়িত পাঁচ জঙ্গি সর্বশেষ ছিলেন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় তানভীর কাদেরীর বাসায়। ওই বাসা থেকেই ওরা হলি আর্টিজানে গিয়ে আক্রমণ করেন। তানভীর কাদেরীর এক কিশোর ছেলে আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতেও একই তথ্য দিয়েছে।

গুলশান হলি আর্টিজানে হামলায় সরাসরি অংশ নেওয়া পাঁচ জঙ্গি হলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকার ছাত্র মীর সামেহ মোবাশ্বের, মোনাশ ইউনিভার্সিটির মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের ছাত্র নিবরাস ইসলাম এবং বগুড়ার শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল ও খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েল। এই পাঁচ জঙ্গি সেনাবাহিনীর ‘অপারেশন থান্ডার বোল্ড’ অভিযানে গত ১ জুলাই ভোরে নিহত হন। জঙ্গিরা গুলশানে হলি আর্টিজানে ১ জুলাই রাতে ২০ জন দেশি-বিদেশি নাগরিককে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা করে। তাৎক্ষণিক অভিযান চালাতে গিয়ে জঙ্গিদের বোমায় নিহত হন পুলিশের দুজন কর্মকর্তা। পরদিন সকালে জিম্মি উদ্ধার অভিযানে পাঁচ জঙ্গির সঙ্গে ওই রেস্তোরাঁর পাঁচক সাইফুল ইসলাম চৌকিদার নিহত হন। আর রেস্তোরাঁর ভেতর থেকে আটক আরেক কর্মী জাকির হোসেন পরে হাসপাতালে মারা যান। হামলা বা জঙ্গিদের সঙ্গে হলি আর্টিজানের এই দুই কর্মীর সম্পৃক্ততার কোনো তথ্য এখন পর্যন্ত তদন্তকারীরা পাননি বলে জানা গেছে। এ নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস (ইসলামিক স্টেট) এই হামলার দায় স্বীকার করে। কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশ তা নাকচ করে দেয়।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, মামলার আসামিরা প্রায় সবাই শনাক্ত হলেও খুব শিগগির গুলশান হামলা মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার সম্ভাবনা আরো দেরি হতে পারে। বিপুলসংখ্যক সাক্ষীর ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় সাক্ষ্য গ্রহণ, জব্দকৃত বিপুল পরিমাণ আলামতের ফরেনসিক পরীক্ষা ও নিহত ব্যক্তিদের ডিএনএ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অভিযোগপত্র প্রস্তুত করতে আরও সময় প্রয়োজন রয়েছে। আর উদ্ধার হওয়া ১৪ জন জিম্মি এই মামলার সাক্ষী হিসেবে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

আদালত সূত্র জানায়, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জঙ্গিহামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় আগামী ১৬ জুলাই তদন্ত প্রতিবেদন (চার্জশিট) জমা দেয়ার নতুন দিন ধার্য করেছেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিনের আদালত এ দিন ধার্য করেছেন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এদিনই মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের কথাছিল। কিন্তু ঢাকা মহানগর কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের পরিদর্শক হুমায়ূন কবির আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে না পারায় নতুন এদিন ধার্য করেন আদালত।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই হলি আর্টিজান রেস্তোরায় জঙ্গি সন্ত্রাসী হামলায় দেশি-বিদেশি মোট ২০ জনকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে জাপানের নয়জন, ইতালির সাতজন, ভারতের একজন এবং বাংলাদেশের দুইজন, মার্কিন নাগরিক একজন। এ ছাড়া রেস্তোরাঁটির দুইজন কর্মচারী এবং সন্ত্রাসীদের ছোড়া গ্রেনেডে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হন। আর পরদিন সেনাকমান্ডদের অভিযানে পাঁচ জঙ্গি নিহত হয়।

বছর পেরুলেও রেশ কাটেনি গুলশানে : গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার এক বছর পরও কূটনীতিক পাড়া হিসেবে পরিচিত ঢাকার অভিজাত এলাকাটি নিয়ে তৈরি হওয়া আতঙ্কের রেশ কাটেনি। আতঙ্কের সঙ্গে নিরাপত্তার কড়াকড়িতে ভাড়াটিয়া সঙ্কটে ভুগছে ওই এলাকার বহু ভবন। নতুন ভাড়াটিয়ার অভাবে ভাড়াও অর্ধেক নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বেশ কয়েকটি বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক। ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে একদল জঙ্গি গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের হলি আর্টিজান বেকারিতে ঢুকে ১৭ বিদেশিসহ ২০ জনকে হত্যা করে। তাদের ঠেকাতে গিয়ে মারা যান দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরদিন সকালে কমান্ডো অভিযান চালিয়ে ওই রেস্তোরাঁর নিয়ন্ত্রণ নেয় নিরাপত্তা বাহিনী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার হয়ে ঢাকায় কর্মরত বিদেশিদের একটা বড় অংশ যে গুলশানে থাকেন, সেখানে হামলার পর আতঙ্কে তাদের অনেকেই চলে যাওয়ার পর নতুন করে বিদেশিদের আসা কমে যাওয়ায় দামি এসব অ্যাপার্টমেন্ট খালি পড়ে থাকছে।

বিদায়ী অর্থ বছরের এডিপি বাস্তবায়ন না হওয়ার জন্য গুলশান হামলাকেই দায়ী করে আসছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলছেন, অনেক বিদেশি চলে যাওয়ায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পিছিয়ে যায়। আবার হামলার পর থেকে গুলশান এলাকায় অতিরিক্ত নিরাপত্তার কারণে মানুষের ভোগান্তিও বেড়ে যায়। যে কারণে ওই এলাকায় অনেকেই বাসা ভাড়া নিতে যাচ্ছেন না। গুলশাল-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের পূর্ব দিকের শেষ মাথার ৫ নম্বর বাড়িটিতে ছিল হলি আর্টিজান বেকারি নামে সেই রেস্তোরাঁটি। এই বাড়িতে প্রবেশের আগে সড়কের দুই পাশে বেশ কিছু বাড়ি রয়েছে। হলি আর্টিজানের একেবারে লাগোয়া পশ্চিম পাশের ২১ নম্বর হোল্ডিংয়ের ভবনটির নাম ‘সুবাস্তু সেতারা’। এই ভবনের ১৯টি অ্যাপার্টমেন্টের মধ্যে এখন মাত্র ছয়টিতে ভাড়াটিয়া রয়েছে বলে জানান বাড়িটির নিরাপত্তাকর্মী আবদুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, ভাড়াটিয়াদের মধ্যে তিনটি অ্যাপার্টমেন্টে পাকিস্তান, সৌদি আবর ও কোরিয়ার বিদেশিরা আছেন। বাকিরা বাংলাদেশেরই।

হলি আর্টিজান হামলার আগে সবগুলো অ্যাপার্টমেন্টে ভাড়াটিয়া ছিল জানিয়ে তিনি বলেন, জঙ্গি হামলার পর যে আতঙ্ক শুরু হয়েছিল, তা মানুষের মন থেকে এখনও যায়নি। হলি আর্টিজানের ঘটনার কারণে এখন আগের মতো মানুষ বাড়ি ভাড়া নিতে আসছে না। এমনকি এই ঘটনার পর বহু ভাড়াটিয়া এই এলাকা ছেড়ে চলে গেছে।
বাড়ি ভাড়াও অর্ধেক কমে যাওয়ার কথা জানান কাইয়ুম। আগে প্রতিটি অ্যাপার্টমেন্টের মাসিক ভাড়া ছিল দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। বর্তমানে এক থেকে দেড় লাখ টাকায়ও নতুন ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না।

সেতারা নামে ভবনটির একেবারে সামনে সড়কের উল্টাপাশের ২০ নম্বর বাড়িটির নাম ‘ফ্লোরালিয়া’। এটি হলি আর্টিজানের প্রধান ফটক লাগোয়া। এই বাড়ি দেখভালের দায়িত্বে থাকা কর্মীদের একজন শফিউল আলম বলেন, আগে ওই এলাকায় বিভিন্ন বাড়ির ‘ফুল ফার্নিশড’ অ্যাপার্টমেন্টগুলোর ভাড়া ছিল দুই-আড়াই লাখ টাকা। কিন্তু হামলার পর ভাড়াটিয়া পাওয়া যাচ্ছে না, ভাড়া কমে গেছে।

ভাড়াটিয়ার অভাবে তাদের ভবনের দুটি অ্যাপার্টমেন্ট এখনও খালি পড়ে আছে বলে জানান তিনি। শফিউল বলেন, হলি আর্টিজানে ভয়াবহ হামলার পর বাংলাদেশে বিদেশিদেরই আসা কমে গেছে, যে কারণে গুলশান এলাকায় আগের মতো বাড়ি ভাড়ার চাহিদা নেই। পাশের ১৯ নম্বর বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী শীতল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার পর চাকরি নিয়ে আমি এই ভবনে এসেছি। এই এলাকায় মানুষের আনাগোণা অনেক কম মনে হচ্ছে।

হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর স্থানীয় পর্যায়ে প্রভাব সম্পর্কে ওই এলাকার একাধিক ভাড়াটিয়ার মন্তব্য চাইলেও কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে হামলার পর কিছু দিন আতঙ্ক ও ভয় বিরাজ করলেও এখন সেই ভয় কেটে গেছে ১৮ নম্বর বাড়ি ‘কেরোলিনার’ স্টাফ ফরহাদ হোসেন তালুকদারের।

তিনি বলেন, হলি আর্টিজানের জঙ্গি হামলার পর পুরো এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ঘটনার পর প্রথম চার মাস সড়কের মুখে পুলিশের ব্যারিকেড ছিল। ব্যারিকেড তুলে নেওয়া হলেও এই এলাকায় পুলিশসহ অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর দিনরাত নিয়মিত টহল রয়েছে বলে ফরহাদ জানান।হলি আর্টিজান বেকারি যে বাড়িতে ছিল, তার উল্টোপাশে একই মালিকের আরেকটি প্রতিষ্ঠান ‘লেকভিউ ক্লিনিক’। জঙ্গি হামলার সময় বুলেটে এই হাসপাতালটির একটি কাচ ভেঙেছিল।

ক্লিনিকটির চিকিৎসক মাহবুব উদ্দিন বলেন, ঘটনার পর পুরো এলাকায় নিরাপত্তাসহ নিয়মিত তল্লাশিরর কারণে ক্লিনিকে রোগী আসা কমে গেছে। তবে গুলশান পুলিশের উপকমিশনার মোস্তাক আহম্মেদ খান বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, আতঙ্কের কারণে ভাড়াটিয়া না পাওয়ার ঘটনা ঠিক নয়। হলি অটিজেনে হামলার পর নিরাপত্তার বিষয়টিতে কোনভাবেই ছাড় দেওয়া হচ্ছে না।

এ কারণে দেশে প্রচুর বিদেশি আসছে। পাশপাশি গুলশান বারিধারা এলাকার হোটেল-গেস্ট হাউজগুলোতে বিদেশিদের ভিড় লেগেই আছে। অধিকাংশ সময় সিট পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়ে। কোনো বাড়ির মালিক যদি বলে থাকেন নিরাপত্তার কারণে কেউ বাসা ভাড়া নিচ্ছে না বা ভাড়া কমে গেছে, তা হলে তিনি ঠিক বলেননি, এটা তার ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা, বলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

এ বিষয়ে গুলশান সোসাইটির কার্য-নির্বাহী কমিটির যুগ্ম সম্পাদক এম এ হাশেম বলেন, হামলার পর ভয়-ভীতি সৃষ্টি হলেও তা কাটিয়ে ওঠা গেছে। এলাকার নিরাপত্তাসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে বেশ কিছু নিয়ম-কানুন করা হয়। বর্তমানে মানুষ অনেক সতর্ক হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিও অনেক ভালো। এখন ভয়ের কারণ নেই। গুলশান এলাকায় বাসা ভাড়া কমে যাওয়াটা সারাদেশের মতো একটা প্রভাব বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, হলি আর্টিজানে হামলার পর হয়ত এর পাশের অনেক বিদেশি চলে যেতে পারে, কিন্তু বর্তমানে পুরো এলাকায় নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি নেই। বাইরে থেকে যা মনে করা হয়, আসলে গুলশান এলাকার ভেতরের অবস্থা তা না।

সেই হলি আর্টিজান বেকারি এখন যেমন : বাংলাদেশের যে জঙ্গি হামলা কাঁপিয়েছিল গোটা বিশ্বকে; তার সঙ্গে জড়িয়ে ঢাকার গুলশান-২ এর ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িটি এবং হলি আর্টিজান বেকারি নামটি।এক বছর আগের ওই হামলার পর নতুন ঠিকানায় কাজ চালাচ্ছে হলি আর্টিজান বেকারি; আর রেস্তোরাঁ তুলে দিয়ে এখন নিজেই থাকার জন্য বাড়িটি গোছগাছ করছেন এর মালিক। হামলার আগে ৭৯ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর ওই বাড়িতেই ছিল হলি আর্টিজান বেকারি; উন্মুক্ত সবুজ লনের ওই রেস্তোরাঁটি ঢাকায় বিদেশিদের কাছে ছিল বেশ জনপ্রিয়। হামলায় নিহতদের অধিকাংশও ছিলেন বিদেশি। জঙ্গি হামলা এবং তাদের দমনে সেনা কমান্ডোদের অভিযানের পর ভবনটির সীমানা দেয়াল ও বেকারির বেশিরভাগ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল; নষ্ট হয়েছিল ভেতরে থাকা মালামালও। বছর গড়ানোর আগে বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ঘটনার সাক্ষী সেই বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, চলছে ঘষামাজা আর রঙের কাজ। আনা হচ্ছে নতুন আসবাব। ফটকে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত বছরের ১২ নভেম্বর মালিকের হাতে ভবনটি হস্তান্তরের পর থেকে শুরু হয় সংস্কার কাজ। কাজ শেষ হলে উঠবেন মালিক সামিরা আহম্মদ ও তার স্বামী সাদাত মেহেদী।

দোতলা ভবনটির পূর্বপাশে গুলশান লেক, আগে লেকের পাড় দিয়ে হাঁটার পথ থাকলেও সেটি এখন আর ব্যবহার হয় না। লেকের পাড়ের অংশে কাঁটাতারের বেড়া। বাড়িটির সামনের অংশ (দক্ষিণ) সবুজ রঙের টিন দিয়ে ঘিরে রাখা দেখা যায়। সড়ক থেকে বাম দিকে এর প্রবেশ পথ তালাবদ্ধ। বনটির দরজার-জানালা বন্ধ। তবে বারান্দায় শ্রমিকদের কাজ করতে দেখা গেছে। এর দেয়ালে সাদা রঙ করা হলেও দরজা-জানালায় এখনও রঙের প্রলেপ পড়েনি।বাড়িতে ঢোকার পথে ডানপাশে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তায় ছোট একটি কক্ষ রয়েছে। সেখানে পাওয়া যায় নিরাপত্তাকর্মী আকতার হোসেনকে।

তিনি বলেন, ভবনটি এখনো ব্যবহার শুরু হয়নি। ভেতরে কাজ চলছে। আসবাবপত্র বসানো হলে মালিক নিজেই সপরিবারে বাড়িতে উঠবেন। র্তমানে বাড়িটির দেখাশোনার দায়িত্বে দুজন মালিসহ পাঁচজন নিরাপত্তাকর্মী রয়েছেন। বাইরের কারও বাড়ির ভেতরে ঢোকায় রয়েছে কড়াকড়ি। সাংবাদিক পরিচয় দিলেও ছাড় দেয়নি নিরাপত্তাকর্মীরা।