Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

চিকুনগুনিয়ায় তোলপাড় রাজধানী

আফছার আহমদ রূপক॥প্রিন্ট সংস্করণ

জুলাই ৯, ২০১৭, ০৬:৪২ এএম


চিকুনগুনিয়ায় তোলপাড় রাজধানী

রাজধানীতে যেমন প্রতিদিনই চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ, ঠিক তেমনই এ রোগের প্রাদুর্ভাব নিয়ে চলছে তোলপাড়। পথে-ঘাটে, বাসাবাড়ি, অফিসে, পাড়া-মহল্লাসহ এমন কোনো স্থান নেই যেখানে চিকুনগুনিয়া নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। রাজধানীর আনাচে-কানাচে বাসাবাড়িতে রোগটি ছড়িয়ে পড়ার কারণেই এই তোলপাড়। কারো মধ্যে আতঙ্ক, কারো মধ্যে আতঙ্ক না থাকলেও রোগ-যন্ত্রণা নিয়ে অস্বস্তি দেখা যাচ্ছে। গতকাল শনিবার শ্যামলীর মোহনপুর গলিতে একটি মুদি দোকানের সামনে রাস্তায়ও দুই ব্যক্তিকে দেখা গেছে চিকুনগুনিয়া নিয়ে আলোচনা করতে।

এক ব্যক্তি তার পা দেখিয়ে অপর ব্যক্তিকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, দেখুন ভাই আমার পায়ের অবস্থা। জ্বর কমে গেলেও পায়ের গোড়ালি ও নিচের অংশে ব্যথা এবং ফুলে গেছে। ব্যথায় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। এ কথা শুনে অপর ব্যক্তিও জানালেন তারও চিকুনগুনিয়া হয়েছিল। একটু এগিয়ে একটি যাত্রীবাহী বাসে চড়ার পরও দেখা গেল রোগটি নিয়ে বাসযাত্রীদের মধ্যে আলোচনা। একজন আরেকজনকে বলছেন আক্রান্ত হওয়া এবং রোগ-যন্ত্রণার গল্প। পাশাপাপাশি কেন রোগটি নির্মূল হচ্ছে না তার জন্য মুখে দুশ্চিন্তারও আভাস দেখা গেল। কয়েকদিন আগে একটি সরকারি হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল একজন চিকিৎসক অন্য চিকিৎসককে শুনাচ্ছেন তার চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কথা।

তবে চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ ও আক্রান্ত হওয়া নিয়ে যতটা আলোচনা ও তোলপাড় দেখা যাচ্ছে ততটা আলোচনা নেই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারী এডিশ মশা নিয়ে। অথচ এই এডিশ মশা নিধন হলেই কেউ চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত হবে না। শুধু চিকুনগুনিয়া নিয়ে আলোচন্ইা নয়, হাসপাতালগুলোতেও এ রোগে আক্রান্তদের অনেকেই ভর্তি হচ্ছেন। ডাক্তার, সাংবাদিক, উকিল, শিশু-বৃদ্ধসহ বয়সের মানুষেরই পিছু ছাড়ছে না এই বেরসিক রোগ। তবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ক্ষেত্রে দেখা গেছে যাদের অন্যরোগ আছে, তাদেরই চিকুনগুনিয়া বেশি কাবু করছে। যেমন ডায়াবেটিস, হার্ট, ফুসফুসসহ অন্যান্য সমস্যার রোগীদের এডিশ মশা কামড় দিলে চিকুনগুনিয়া বা ডেঙ্গুজ্বর বেশি অসুস্থ করছে।

স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্য অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটিতে গত কয়েকমাসে ৬৫৬ জনের রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এরমধ্যে ৫২৬ জনের রক্তে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস পাওয়া গেছে। ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে আসা রোগীদের কাছ থেকে এই নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির ফোনকল সার্ভেইলেন্সের সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে চারহাজার মানুষের মধ্যে ৩৫৭ জনের চিকুনগুনিয়া। তারমানে প্রতি ১১ জনে একজন। কিন্তু এটি সারাদেশের বা পুরো ঢাকার মানুষের শতকরা হিসাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরও চিকুনগুনিয়া নিয়ে বেশ তৎপর। ঈদের আগে সারা ঢাকার বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও মেডিকেল টেকনোলজি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের মাঠে নামানো হয়েছিল চিকুনগুনিয়া রোগের সচেতনতা ও এডিশ মশা নিধন কার্যক্রমের কর্মসূচিতে। মশক নিধনে ওষুধ ছিটিয়ে এ কাজে সহযোগিতা করেছিল সিটি করপোরেশন। স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ ওই কর্মসূচি পালনের আগে একটি সংবাদ সম্মেলনও করেছিলেন। তাতে তিনি বলেছিলেন, চিকুনগুনিয়া রোগ প্রতিরোধ ও এডিশ মশা নিধন তখনই সম্ভব হবে যখন রাজধানীর মানুষ সচেতনভাবে এগিয়ে আসবেন এবং নিজ উদ্যোগেও এডিশ মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করবেন। মহাপরিচালকের এই উদ্যোগ ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, আবহাওয়ার তারতম্যে হঠাৎ বৃষ্টি এবং রোদ হচ্ছে। বৃষ্টি হলেই পরিত্যক্ত পাত্রে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিশ মশা ডিম পাড়ে এবং বংশ বৃদ্ধি করে। তাই পরিত্যক্ত পাত্র, ফুলের টব, টায়ার, ডাবের খোসা, এসির নিচসহ যেসব স্থানে এডিস মশা বাসা বাঁধে সেগুলোর দিকে নজর রাখতে হবে, যাতে এডিশ মশা ডিম না পাড়ে।

এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, চিকুনগুনিয়া নিয়ে আতঙ্কের কিছুই নেই। রোগটি এমনিতেই সেরে যায়। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুজ্বরের তেমন চিকিৎসা নেই। নেই প্রতিষেধকও। জ্বর ও শরীর ব্যথার জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়া যেতে পারে। তবে সবথেকে বেশি খাওয়া প্রয়োজন পানিসহ তরল খাবার। বিশ্রামও খুবই দরকার। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুজ্বর প্রতিরোধই উত্তম। একটু সচেতন হলেই এই দুইটি রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোনো পাত্রেই যেন তিন-চারদিন স্বচ্ছপানি জমে না থাকে। মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। স্বাস্থ্যঅধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে গ্রামে দুয়েকজন চিকুনগুনিয়ার রোগী পাওয়া গেলেও তারা ঢাকায় এডিশ মশার কামড় খেয়েছিলেন।

জানা গেছে, রাজধানীতে বেশ কিছুদিন ধরে কয়েকশ মানুষ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। অনেক মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে চিকুনগুনিয়া নিয়ে। চিকিৎসকরা বলছেন চিকুনগুনিয়া ভাইরাসটি ডেঙ্গুজ্বরের জীবাণুবাহক এডিস মশা বহন করে। এডিশ মশা ভোরে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়। এডিস মশার কামড়ে এ রোগের প্রকোপ কেবল রাজধানীতেই বেড়েছে। গ্রামে নেই। চিকুনগুনিয়া আক্রান্তদের জ্বর, মুখে অরুচি, মাথাসহ শরীরের গিরায় গিরায় অনেকদিন প্রচ- ব্যথা হওয়ায় ভয় বেশি পাচ্ছে রোগীরা। কারণ এ রোগ সম্পর্কে মানুষের ধারণা কম। বেশি প্রচার হয়েছে ডেঙ্গুজ্বর সম্পর্কে। যদিও ডেঙ্গুজ্বর ও চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ ও চিকিৎসা অনেকটা একই রকম। পার্থক্য কেবল ডেঙ্গুজ্বরে গিরায় গিরায় ব্যথা করে না।