Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল, ২০২৪,

অবসরভাতা পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা

বেলাল হোসেন॥প্রিন্ট সংস্করণ

আগস্ট ৭, ২০১৭, ০৫:২৫ এএম


অবসরভাতা পেতে দীর্ঘ অপেক্ষা

শ্রী রতন কুমার শীল। পেশায় শিক্ষক। ২০১২ সালে ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলার একটি স্কুল থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। ৬ বছর ঘুরেও অবসরভাতা তুলতে পারেননি তিনি রাজধানীর বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী অবসর সুবিধা বোর্ড থেকে।

সম্প্রতি এ প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় ভুক্তভোগী স্কুলশিক্ষক শ্রী রতন কুমার শীলের। তিনি জানান, ২০১২ সালে চাকরি থেকে অবসর নেয়ারপর সে সময় অবসরভাতা ও কল্যাণ তহবিলের টাকার জন্য আবেদন করেন। অনেক ঘোরাঘুরির পর কল্যাণ তহবিলের টাকা পেলেও ছয় বছর হতে চলল এখনো অবসরভাতার চেক পাননি। গত কয়েক মাস আগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন চলতি বছরের ৪ জানুয়ারিতে অবসরভাতা চেক স্কুলের নামে ইস্যু করা হয়েছে। কিন্তু চেকটা স্কুলে পৌঁছেনি।

গত মাসে খবর নিতে আসলে অবসর সুবিধা বোর্ড থেকে বলা হয় থানা ও জেলার পোস্ট অফিসে খোঁজ নিতে। সেখানে গিয়েও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারা আবার পরে বলেছে চেক হারিয়ে গেছে এই মর্মে থানায় জিডি করে কাগজ জমা দিতে। আবার এসেছি সেই কাগজ জমা দিতে। আক্ষেপ করে স্কুলশিক্ষক রতন কুমার বলেন, ৬ বছর হয়ে গেলো বিধাতায় জানে আবার কবে এই চেক পাবো। প্রায় দিনই রতন কুমার শীলের মত অনেকেই আসেন তাদের শেষ জীবনের কাঙিক্ষত অর্থের জন্য। তবে হতাশায় শিক্ষকদের মুখগুলো ফিকে হয়ে যায়। টাঙ্গাইল থেকে আসা মাদ্রাসা শিক্ষক আব্দুস সালাম, মো. আব্দুল মজিদ এবং মুন্সিগঞ্জের বছিরণ নেছা উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষিকাসহ অনেকেই তিন/চার বার এখানে এসেছেন অবসরভাতার খবর নিতে। বৃদ্ধ বয়সে একা আসতে পারেন না বলে কারো ছেলে, কারো মেয়ে বা আত্মীয় স্বজন সঙ্গে আসছেন।

এইসব শিক্ষকরা অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, বৃদ্ধ বয়সে আমরা অন্যের উপর ভর করে এখানে আসি। তাও সঠিক সময়ে টাকাটা পাওয়া যায় না। আর সারাদেশে একটা অবসর ভাতা প্রদানের অফিস হওয়ায় এটা আরো কষ্টদায়ক হয়েছে। অনেক খরচ হয়, ঘুরতে হয় তবুও অবসরের টাকাটা সঠিক সময়ে মেলে না। তারা বলেন যদি প্রত্যেক বিভাগে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারি অবসর সুবিধার বোর্ডের একটা করে অফিস থাকতো তবে এত কষ্ট হতো না।

চাকরি জীবন থেকে অব্যহতি পাওয়ার পর বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারিদের কতই না যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়। জীবনের শেষ দিকে এসে একটু সুখে কাটানোর আশায় অবসর সুবিধা বোর্ডের শরণাপন্ন হয়। তবে সেখানে এসে দিনের পর দিন ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে প্রায় শিক্ষকদের অভিযোগ। অনেক সময় পাঁচ থেকে ছয় বছরেও দেখা মিলে না অবসর ভাতার। কারণ হিসেবে অনেকেই বলছেন সারাদেশের লক্ষাধিক বেসরকারি শিক্ষক পরিবারের অবসর সুবিধা গ্রহণের জন্য একটিমাত্র কেন্দ্র হওয়ায় এবং এই খাতে বাজেট কম।

দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আশা বয়সের ভারে ন্যূব্জ শিক্ষকরা অবসর সুবিধার বোর্ডে এসে ধরণা দেন। শুধু চাকরির শেষ জীবনের পর কিছু পুঁজিকে আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টায়। তবে সেই অবসরভাতা ও কল্যাণ তহবিলের টাকা পেতে বছরের পর বছর লেগে যায়। ফলে এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এখন ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন, অনেকে অনাহারে মৃত্যুবরণ করেছেন। এদিকে সুশীল সমাজ বলছেন, আমাদের দেশের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। অথচ সামান্য অর্থের প্রয়োজনীয় বরাদ্দের জন্য শিক্ষকরা মানবেতর জীবন যাপন করবে, তা কোনভাবেই কম্য নয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানাগেছে, একজন শিক্ষক অবসর সুবিধা গ্রহণের জন্য আবেদন করলে এ অর্থের চেক পেতে প্রায় সাড়ে চার বছর লেগে যায়। দীর্ঘ দিনের কারণে অনেকেই এই টাকার সুবিধা বেঁচে থাকা অবস্থায় দেখে যেতে পারে না বলে জানা গেছে। আবার অনেকেরই অভিযোগ চারবছর পেরিয়ে গেলোও অবসরভাতার কোনো খবর থাকে না।

এ বিষয়ে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারি অবসর সুবিধার বোর্ডের পরিচালক মো. খসরুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, বাজেট ঘাটতি কারণে শিক্ষক-কর্মচারির অবসরভাতার অর্থটা দিতে একটু দেরি হয়ে যায়। তবে মৃত্যুজনিত শিক্ষক-কর্মচারিদের এ অর্থ দ্রুত নিষ্পত্তি করা হয়। বর্তমানে প্রায় ৪৮ হাজার শিক্ষক-কর্মচারিদের ফাইল জমা আছে। বর্তমানে ২০১৩ সালের চেকগুলো দ্রুত ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, সারাদেশের এই বিশাল শিক্ষক পরিবারের কাজ একজায়গাতে হওয়ায় একটু বেশি সময় লেগে যায়। এরপর আবার বাজেটে ঘাটতি তো আছেই।

তবে গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই খাতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে কিছু অর্থ দেয়ায় আমরা এখন এগুলো দ্রুত দেয়ার চেষ্টা করছি। আগামী তিন মাসের মধ্যে ১৩’ সালের চেক দেওয়া হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন। অবসর সুবিধা বোর্ডের কাউন্টারে অনেকেই সঠিক তথ্য পায় না বলে প্রশ্ন করলে এই পরিচালক বলেন, আমাদের অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারি মিলিয়ে সর্বমোট ২৫ জন জনবল। এই অল্পসংখ্যক জনবল দিয়ে কাজ করতে একটু-আধটু সমস্যা হতেই পারে বলে তিনি যোগ করেন।

এছাড়াও দেশের বিভিন্ন দূরপ্রান্ত থেকে শিক্ষকদের ঢাকায় এসে খোঁজ নেয়ায় অনেক কষ্ট হয় এ ব্যাপারে প্রশ্ন করলে অবসর সুবিধার বোর্ডের পরিচালক খসরুল আলম বলেন, আমার মনে হয় ঢাকার পাশাপাশি দেশের বড় বিভাগীয় শহর চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীতে অবসর সুবিধার বোর্ডের অফিস কার্যক্রম পরিচালনা করলে ওই সকল শিক্ষকদের কষ্ট কিছুটা লাঘব হবে।

সুশিল সমাজের কয়েকজন বলেন, আমাদেরকে জীবন গড়তে যারা সাহায্য করেছেন এবং সকলের নিকট পূজনীয় ব্যক্তিত্ব শিক্ষকরা এভাবে মানবেতর জীবন যাপন করবে তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।