Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ২০ জুলাই, ২০২৫,

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বাংলাদেশ

প্রিন্ট সংস্করণ॥বিশেষ প্রতিবেদক

জানুয়ারি ১৪, ২০১৯, ০৬:৩৫ পিএম


বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বাংলাদেশ

বর্তমান সরকারের টানা ১০ বছরে উচ্চমাত্রা ছুঁয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দুই মেয়াদের গত ১০ বছরে ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব মতে, আমদানি ব্যয় পরিশোধ করেও বর্তমানে রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের উপর রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কর্মরত ১ কোটি ১৮ লাখ প্রবাসীর আয়ে ভর করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে রিজার্ভ বর্তমানে রয়েছে, তা দেশের শক্ত অর্থনীতির বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। যা এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়।বাংলাদেশ ব্যাংকের চেইঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাডভাইজার আল্লাহ মালিক কাজেমী আমার সংবাদকে বলেন, আমরা দক্ষতার সাথে দর নিয়ন্ত্রণ করার কারণে ডলারের মজুদ বেড়েছে। বর্তমানে দৃশ্যমান কোনো সংকট নেই। আমাদের কাছে যথেষ্ট পরিমাণ মজুদ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১০ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ বেড়েছে সাড়ে চার গুণেরও বেশি। যা এই সরকারের সাফল্যেরই ধারাবাহিকতা। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু প্রকল্প শুরুর আগে থেকেই অনেকে বলা শুরু করেছিল, এতে ডলার সংকট দেখা দেবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সংকটের পরিবর্তে সমৃদ্ধ হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ আরও বাড়বে। যা মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরের নির্দেশক। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল সাড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার, যা বর্তমানে ৩১ দশমিক ১৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) বিল পরিশোধের আগে তা ছিল ৩২ বিলিয়নের উপরে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রিজার্ভ ছিল ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ৩৩ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, একটি দেশের কাছে অন্তত তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানোর সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার মজুদ থাকতে হয়। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ এ নয়টি দেশ বর্তমানে আকুর সদস্য। এই দেশগুলো থেকে বাংলাদেশ যেসব পণ্য আমদানি করে তার বিল দুমাস পর পর আকুর মাধ্যমে পরিশোধ করতে হয়।সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও বলছেন, প্রবৃদ্ধি ঊর্ধ্বমুখী থাকায় দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে, আমদানি বাড়ছে। আর আমাদেরও যথেষ্ট পরিমাণ ডলার মজুদ রয়েছে।একটি দেশে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে এমন পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকার নীতি থাকলেও পৃথিবীর উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো বড় আকারের রিজার্ভ রক্ষা করে চলে। আর বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ দিয়ে ৯ মাসের আমদানি ব্যয়ের দায় পরিশোধ করা সম্ভব। ২০১৭ সালের ২১ জুন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ প্রথম বারের মতো ৩৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর তা ৩২ বিলিয়নের ঘরেই স্থায়ী ছিল। গত সপ্তাহে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে আকুর দেনা পরিশোধ করে সেটি কিছুটা কমে যায়।এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবীরের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমি সাধারণত এসব বিষয়ে কারো সাথে কথা বলি না। তাই এখনো বলতে চাচ্ছি না। কথা বলার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন মুখপাত্র রয়েছে। তাই তার সাথে কথা বলার জন্য তিনি বলেন।বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক আর্থিক খাতে স্থিতিশীলতা ও মজুত পরিস্থিতি ধরে রাখতে রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় অত্যন্ত সতর্ক। মূলত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভ বেড়েছে। যার ধারাবাহিকতা থাকবে বলেও তিনি জানান।উচ্চ রিজার্ভের ওপর ভর করে সরকার বাংলাদেশ সার্বভৌম সম্পদ তহবিল নামে একটি বড় তহবিল গঠনের উদ্যোগ নেয়। ১০ বিলিয়ন ডলারের ওই তহবিলে প্রাথমিকভাবে রিজার্ভ থেকে ২ বিলিয়ন ডলার জোগানের কথা। এতেও রির্জাভের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে সেটি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলেন, বিশাল রিজার্ভ রয়েছে সেটি ইতিবাচক। তবে আমরা শঙ্কায় রয়েছি যে হারে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। প্রবাসীরা কষ্ট করে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠান। আর আমরা ব্যবসার নামে সেটি বিদেশে নিয়ে যাচ্ছি কি না, সেটি খতিয়ে দেখতে হবে।উইকিপিডিয়ার তথ্যে দেখা যাচ্ছে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। প্রথম অবস্থানে রয়েছে ভারত। তাদের রিজার্ভের পরিমাণ ৪০৯ বিলিয়ন ডলার। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা পাকিস্তানের রিজার্ভ রয়েছে প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। আর সবগুলো দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রিজার্ভ রয়েছে চীনের। চীনের রিজার্ভের পরিমাণ তিন হাজার ৫৩ বিলিয়ন ডলার। এর পরের অবস্থানে রয়েছে জাপান, তাদের কাছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রয়েছে এক হাজার ২৬৬ বিলিয়ন ডলার। এরপর সুইজারল্যান্ড ও সৌদি আরবের অবস্থান।রপ্তানি ও রেমিট্যান্স বাড়লে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়ে। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বাড়লে রিজার্ভ কমে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকসংশ্লিষ্টরা বলছেন, রিজার্ভ বাড়ার ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার আয় বৃদ্ধির চেয়ে ব্যয় কমার প্রবণতাই বড় ভূমিকা রেখেছে। কারণ রেমিট্যান্স এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধির চেয়ে আমদানি ব্যয় কমেছে বেশি হারে। অনেক দিন ধরেই রেমিট্যান্স আয়ে তেমন কোনো উন্নতি নেই। রপ্তানি আয়ও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারছে না।গত কয়েক বছরে হু হু করে বাড়ছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০৯ সালের ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল মাত্র ১০ বিলিয়ন ডলার। ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর রিজার্ভ ১২ বিলিয়নের ঘর অতিক্রম করে। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ১৩ বিলিয়নে পৌঁছায়। ৫ মার্চ তা ১৪ বিলিয়ন, ৭ মে ১৫ বিলিয়ন, ১৩ আগস্ট ১৬ বিলিয়ন, ২২ অক্টোবর ১৭ বিলিয়ন ও ১৯ ডিসেম্বর ১৮ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়। ২০১৪ সালের ১০ এপ্রিল তা ২০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে। এরপর একই বছরের ১৬ এপ্রিল তা ২১ বিলিয়ন ও ৭ আগস্ট ২২ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। ২০১৫ সালের ২৬ ফেবুয়ারি রিজার্ভ ২৩ বিলিয়ন ডলার, ২৯ এপ্রিল ২৪ বিলিয়ন ও ২৫ জুন ২৫ বিলিয়নের ঘর অতিক্রম করে। ২০১৫ সালের ১৭ আগস্টে ২৬ বিলিয়ন ডলার এবং পরের মাসের ২৯ তারিখ ২৭ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। এরপর পর্যায়ক্রমে গত বছরের ২১ জুন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রথমবারের মতো মাইলফলক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। অবশ্য বর্তমানে রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের উপর কিন্তু মাইলফলক ৩৩ বিলিয়ন ডলারের নিচে রয়েছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজী হাসান বলেন, সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে গত কয়েক বছরে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। সরকার বিদেশে দক্ষ জনশক্তি প্রেরণের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করায় প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেয়েছে। রেমিটেন্স প্রেরণকারীদের সাবলীল সেবা প্রদানের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সরকার বিভিন্ন ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউজগুলোকে সব ধরনের নীতি সহায়তা প্রদান করায় দেশে টাকা পাঠানোর প্রক্রিয়া আগের চেয়ে সহজ হয়েছে। এতে রিজার্ভও বৃদ্ধি পেয়েছে।