Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

শহীদ মিনারের পাশে স্থাপন হয়নি গ্রন্থাগার ও জাদুঘর

প্রিন্ট সংস্করণ॥এনায়েত উল্লাহ

ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৯, ০৭:১৪ পিএম


শহীদ মিনারের পাশে স্থাপন হয়নি গ্রন্থাগার ও জাদুঘর

ভাষার মাস এলেই কদর বাড়ে শহীদ মিনার ও ভাষাবিদদের। প্রকৃতপক্ষে ভাষাবিদদের প্রতি এ ভালোবাসা কতটুকু রয়েছে, এ নিয়ে তাদের মাঝে দেখা দিয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। বক্তৃতার মঞ্চে ভাষা, দেশ ও ভাষাবিদদের প্রতি ভালোবাসার ফুলঝুরি ছড়ালেও বাস্তবে রয়েছে আন্তরিকতার অভাব। প্রায় সাড়ে আট বছর আগে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষা এবং জাদুঘর নির্মাণের নির্দেশনা চেয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ২৫ আগস্ট হাইকোর্ট আদেশ দেন। আদেশে শহীদ মিনারের পাশে গ্রন্থাগারসহ জাদুঘর নির্মাণ এবং জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসসমৃদ্ধ তথ্যপঞ্জিকা রাখা, ভাষাসংগ্রামীদের প্রকৃত তালিকা প্রণয়ন ও প্রকাশ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ ও মর্যাদা রক্ষাসহ আটটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। রায় বাস্তবায়নে কয়েক দফা সময় নিয়েও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ওই রায় পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করায় ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে সংস্কৃতি ও পূর্ত সচিবের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। ওই সময় সংস্কৃতি ও পূর্ত সচিবকে তলব করেছিলেন হাইকোর্ট। পরে ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারা আদালতে হাজির হয়ে অভিযোগের ব্যাখ্যা দেন। তখন আদালত তাদের ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে গ্রন্থাগারসহ ভাষাশহীদ জাদুঘর নির্মাণ এবং ভাষাসংগ্রামীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়নসহ রায় বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। এ নিদের্শেও কর্ণপাত করেননি সংশ্লিষ্টরা। পরবর্তীতে ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের বেঞ্চ শহীদ মিনারের পাশে জাদুঘর, ভাষাশহীদদের তালিকা প্রকাশসহ আদালতের নির্দশনা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। সে নির্দেশনায় বলা হয়েছিল রায়ের (২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে) ছয় মাসের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। তিন দফা নির্দেশনায়ও কারো টনক নড়েনি। রায়ের প্রায় সাড়ে আট বছর পার হলেও এখন পর্যন্ত রায় বাস্তবায়নের ধারেকাছেও নেই দুই মন্ত্রণালয়। ভাষাসৈনিকরা এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তারা জানে না, বারবার আদালত নির্দেশনা দেয়ার পরও মন্ত্রণালয় কেন এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিচ্ছে না। এ ব্যাপারে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি ড. মুহাম্মাদ সিদ্দিক বলেন, হাইকোর্ট রায় দেয়ার পরও তা বাস্তবায়নে কেন গড়িমসি করা হচ্ছে তা আমাদের জানা নেই। রায়ের প্রেক্ষিতে ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা আংশিক প্রকাশও করা হয়েছিল। তবে সে তথ্যে অনেক অসামঞ্জস্য ছিল। সিনিয়রদের নাম নিচে লেখা হয়েছিল। ওই তালিকায় অন্যতম ছিলেন আবুল কাসেম। এরকম কিছু সমস্যা ওই তালিকায় ছিল। পূর্ণাঙ্গ তালিকা আজ পর্যন্ত প্রকাশ করা হয়নি। এ ভাষাবিদ মনে করেন, জাতীয় শহীদ মিনার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সেটা মেনে নেয়া যায় না। সেটারও একটা সুরাহা চান তিনি। তিনি হাইকোর্টের রায় দ্রুত বাস্তবায়ন চান। এ সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ না করা নিয়েও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, আদালত ও বিভিন্ন অফিসে ইংরেজির ছড়াছড়ি বন্ধেরও আহ্বান জানান তিনি এবং ইংরেজির এ ছড়াছড়ির জন্য বাঙালিকেই দায়ী করেন। উচ্চ আদালতের ওই রায়ে আরো নির্দেশনা ছিল দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণ করার। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি নেয়ার শর্তেও তার উল্লেখ রয়েছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে ক্যাম্পাস ও শহীদ মিনার নির্মাণের। শর্ত পূরণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বিভিন্ন সময় ‘তাগাদা’ দিলেও তার ভ্রুক্ষেপ করেনি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জানা যায়, সে বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। দেশের ভাষাবিদরা জানতে চান, কার ইশারায় রায় বাস্তবায়ন আটকে আছে? ভাষা প্রতিষ্ঠার ৬৭ বছর পরও কি পাকিস্তানিদের আধিপত্য কমেনি? রায় বাস্তবায়ন করার জন্য ভাষাসৈনিকদের আবারো রাস্তায় নামতে হবে কি না; সে কথা চানতে চান তারা। সূত্র জানায়, শহীদ মিনার নির্মাণের শর্ত, আদেশ ও নির্দেশ সবই উপেক্ষা করছে দেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শহীদ মিনার নির্মাণ না করেই চালিয়ে যাচ্ছে শিক্ষাকার্যক্রম। কয়েকটির বিরুদ্ধে শিক্ষা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়ারও বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কয়েক দশক ও যুগ পার হলেও সেগুলোতে আজও নির্মাণ হয়নি বায়ান্নর ভাষাশহীদদের স্মরণে কোনো স্মৃতিস্তম্ভ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দুর্বলতর জবাবদিহি ও মন্ত্রণালয়ের কয়েক কর্মকর্তাকে নানাভাবে ম্যানেজ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পার পেয়ে যাচ্ছে বলেও ব্যাপক অভিযোগ আছে। একই সঙ্গে আদালত, মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির নির্দেশ অমান্যের অভিযোগও আছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। ভাষাবিদরা মনে করেন, নতুন মন্ত্রীরা এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন। শিক্ষাবিদরা বলছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা উপেক্ষিত। বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাব এসব প্রতিষ্ঠানে এমনিতেই বেশি। তার ওপর মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে স্মৃতিসৌধ না থাকা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। বায়ান্নর ঐতিহাসিক ঘটনাবলির স্মৃতি নিয়ে আবেগ ও অনুভবের অপূর্ব মিশেলে গড়া এ শহীদ মিনার। ভাষার অধিকার রক্ষার শপথ নিয়ে এ মিনার সাহস, সংগ্রাম ও প্রেরণার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখনো যে কোনো সঙ্কটে জাতি মিলিত হয় শহীদ মিনারে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লাখ লাখ টাকা খরচ করেও শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনসহ জাতির নিজস্ব ইতিহাস ও সংস্কৃতিচর্চা সম্পর্কে আদৌ জানতে পারছে কি না, এ প্রশ্নও শিক্ষাবিদদের। তারা মনে করেন, নীতিমালা না মেনে বছরের পর বছর ধরে ভাড়া বাড়িতে কোনোরকমে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে শহীদ মিনার নির্মাণের সুযোগও নেই। স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষাকার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কয়েক দফায় সময় বেঁধে দিলেও বেশির ভাগই কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে অস্থায়ী ক্যাম্পাসে বা ভাড়া বাড়িতে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়কে নীতিমালা মানতে বাধ্য করতে পারলে শহীদ মিনার নির্মাণসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার সব নিয়মের বাস্তবায়ন সম্ভব হতো বলে মত দেন তারা। রায় বাস্তবায়নে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পদক্ষেপ জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ আমার সংবাদকে বলেন, উচ্চ আদালতের রায় আমরা দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেবো। কত দ্রুত সময়ের মধ্যে তা বাস্তবায়ন করা হবে তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আন্তঃমন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। অর্থ প্রাপ্তিসাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে প্রতিমন্ত্রী আন্তরিকতার সাথে বলেন, ভাষাবিদদের প্রতি আমাদের সম্মান রয়েছে। সে দিকে লক্ষ রেখেই আমরা তা দ্রুত সময়ের মধ্যে করার চেষ্টা করব। তথ্য মতে, সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণে উচ্চ আদালতের রায় অনুসারে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করে। এরপর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে নির্দেশ দেয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অবিলম্বে বাস্তবায়নের আহ্বান জানিয়ে সব আঞ্চলিক, জেলা ও উপজেলায় তখন চিঠি পাঠায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)।চিঠিতে বলা হয়, ‘আদালতের রায়ের আলোকে সরকার এ নির্দেশ দিয়েছে।’ চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় কয়েক দফা সময় নেয়। অন্যদিকে কয়েক দফা সময় নিয়েও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় আদালতের ওই রায়ের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন না করায় ২০১২ সালে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়। একই বছরে সংস্কৃতি ও পূর্ত সচিবকে তলব করেন উচ্চ আদালত। ওই বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি তারা আদালতে হাজির হয়ে অভিযোগের ব্যাখ্যা দেন। তখন আদালত তাদেরকে ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারির মধ্যে গ্রন্থাগারসহ ভাষাশহীদ জাদুঘর স্থাপন, ভাষাসংগ্রামীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন ও শহীদ মিনার নির্মাণসহ রায় বাস্তবায়নে নির্দেশ দেন। এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি আমার সংবাদকে বলেন, উচ্চ আদালত বারবার নির্দেশ দেয়ার পরও তা উপেক্ষিত হচ্ছে। তিনি দ্রুত সময়ের মধ্যে আদালতে আবারো রিট করবেন এবং মন্ত্রণালয় এখন পর্যন্ত কেন কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না জানতে চাওয়া হবে। এমনকি ২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পার হয়ে ছয় বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর ২০১৭ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি উচ্চ আদালত এ বিষয়ে আবার আদেশ দেন। এতে বলা হয়, আগামী ছয় মাসের মধ্যে আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে হবে। এরপর প্রায় দুই বছর চলে গেলেও নির্দেশনাগুলো আজও পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। বেসরকারি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখন বলছে, স্থায়ী ক্যাম্পাসে না যাওয়া ও জমিস্বল্পতার কারণে শহীদ মিনার নির্মাণ সম্ভব হয়নি। দেশে মোট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কত, এ তথ্য ইউজিসির ওয়েবসাইটে থাকলেও এগুলোর মধ্যে কয়টিতে শহীদ মিনার আছে, কয়টিতে নেই, সে তথ্য নেই প্রতিষ্ঠানটির কাছে। অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শহীদ মিনার না থাকলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি এ বিষয়ে ‘ছাড়’ দিয়ে আসছে। ইউজিসি জানায়, স্থায়ী ক্যাম্পাসে গিয়েও কোনো প্রতিষ্ঠান শহীদ মিনার নির্মাণ না করলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।