Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

ডিজিটাল চেক জালিয়াতি : এমএলএম কর্মী থেকে প্রতারক সিন্ডিকেটের সদস্য

প্রিন্ট সংস্করণ॥হাসান-উজ-জামান

ফেব্রুয়ারি ২০, ২০১৯, ১১:৩০ এএম


ডিজিটাল চেক জালিয়াতি : এমএলএম কর্মী থেকে প্রতারক সিন্ডিকেটের সদস্য

কখনো তানিয়া আবার কখনো তানিশা, কখনো ভিন্ন নাম। নিজেকে এভাবেই পরিচয় দেয় সে। বিশোর্ধ্ব তানিয়ার স্বামী-সংসার সবই আছে। কিন্তু এরপরও নিজেকে কখনো কুমারী আবার কখনো স্বামী প্রবাসী বলে জাহির করে। স্বল্পশিক্ষিত তানিয়ার চলাফেরায়ও রয়েছে ভিন্নতা। কখনো পশ্চিমা স্টাইলের আধুনিক ড্রেস আবার কখনো ইসলামের আদলে বোরখা ব্যবহার। তার এ ভিন্ন ভিন্ন রূপের আড়ালেই লুকিয়ে থাকে প্রতারণা। বহুরূপী এ নারী কি আর সহজ-সরল স্বল্প আয়ের স্বামীর বাঁধনে আবদ্ধ থাকে! থাকে না। সামান্যতেই জেদ ধরে স্বামীকে ছেড়ে পা বাড়ায় একাকী জীবনে। মুন্সীগঞ্জ জেলার টঙ্গী থানাধীন উত্তর সোনারং গ্রামে তার নিজ বাড়ি। চলে আসে ঢাকায়। ঘাঁটি গড়ে মুগদায়। কাজ নেয় মাল্টি লেবেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি ‘লাইফওয়েতে’। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয় ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে। এখানে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় রানা ও মিলনের সাথে। রানার সাথে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। পরিচিতদের কাছে সে রানার স্ত্রী। তার বাচনভঙ্গি-স্মার্টনেস আর বহুরূপী কৌশল নজরে পড়ে হানিফ ওরফে হালিমের। ওই হানিফ ডিজিটাল ব্যাংক (চেক) জালিয়াত চক্রের একটি সিন্ডিকেটের প্রধান। হানিফ ঠিকই বুঝতে পারে, তানিয়াই হবে তার সেরা অস্ত্র। তানিয়াকে কাছে টেনে নেয় হানিফ। চেক জালিয়াতির মাধ্যমে অল্পদিনেই বড়লোক হওয়ার প্রস্তাব দেয় তানিয়াকে। লোভী তানিয়া সায় দেয় তাতে। তবে শর্ত জুড়ে দেয়Ñ সঙ্গে রাখতে হবে রানা ও মিলনকেও। প্রস্তাব রাজি হয় হানিফ। এরপর তানিয়াকে সে ব্যবহার করে যেখানে যেমন প্রয়োজন। তানিয়া বড় হয়েছে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গীবাড়িতে। তার স্বামীর বাড়ি সিরাজদিখানে। জানাশোনায় ওই এলাকায় ভালোই দখল তানিয়ার। হানিফের সহায়তায় সেখানকার বিভিন্ন ব্যাংকে হিসাব খোলে তানিয়া। এরপর অল্পদিনের ব্যবধানে মুন্সীগঞ্জ ইসলামী ব্যাংক শাখা থেকে ২৫ লাখ, টঙ্গীবাড়ি বালিগাঁও বাজার অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৪৫ লাখ টাকা অনায়াসেই হাতিয়ে নেয় চেক জালিয়াতির মাধ্যমে। শুধু মুন্সীগঞ্জেই নয়, চাঁদপুর, সিলেট, কুমিল্লা, ঢাকার মোহাম্মদপুর ও ভাটারার বিভিন্ন ব্যাংক থেকে একইভাবে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছে ওই সিন্ডকেট। নিজে এতগুলো অপরাধমূলক কাজ করলেও কখনো ধরা পড়া কিংবা কারো সন্দেহের তালিকায় আসেনি সে। তবে সহযোগী শাহানাকে দিয়ে ঢাকার একটি ব্যাংক থেকে টাকা তোলাতে গিয়ে তানিয়ার নাম প্রকাশ্যে আসে। সূত্রমতে, ২০১৮ সালের ১ মার্চ ঢাকার কদমতলি থানাধীন ইসলামী ব্যাংক দনিয়া শাখা থেকে ১২ লাখ টাকা তুলতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয় শাহানা বেগম (৪৫)। এ মামলায় উঠে আসে তানিয়াসহ তার সহযোগী ও সিন্ডিকেট প্রধান হানিফের নাম। স্পর্শকাতর এ মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পান সিআইডি ইন্সপেক্টর মো. ইমাম আল মেহেদি। বিচক্ষণ এ পুলিশ কর্মকর্তা নিজ দক্ষতায় একে একে এ মামলার পলাতক সব আসামিকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হন। তার নিরপেক্ষ তদন্তেই এ সিন্ডিকেটের কার্যক্রমসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক পরিকল্পনার কথা পুলিশ জানতে পারে। একাধিক ব্যাংক কর্মকর্তার ভাষ্য, পুলিশ সময়মতো এ সিন্ডিকেট গ্রেপ্তার করতে ব্যর্থ হলে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে আরো কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতো। শাহানা বয়সে অনেক সিনিয়র হলেও প্রতারণায় তানিয়ার সহযোগী। নারায়ণগঞ্জ জেলা সদরের কুতুবপুরে শাহানা বেগমের বাড়ি। বাসা ডেমরার মাতুয়াইলে। স্বামী গোলাম রব্বানী প্রবাসী। এমএলএম কোম্পানিতে কাজ করতে গিয়ে পরিচয় হয় তানিয়ার সাথে। সেখান থেকে প্রতারক সিন্ডিকেডের সদস্য। গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি দনিয়া শাখা ইসলামী ব্যাংক থেকে ইসলামী ব্যাংক সুনামগঞ্জ শাখার গ্রাহক লন্ডন প্রবাসী জগলুল হক পাশার চেক জালিয়াতি করে ১৫ লাখ টাকা নিজের অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করে সে। সেদিন তানিয়া ছিল ব্যাংকের নিচে। টাকা স্থানান্তরের পর নিজের চেকে একই শাখা থেকে চার লাখ ৯৫ হাজার টাকা তাৎক্ষণিক তুলে নেয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ব্যাংক ভিআইপি শাখা থেকে তুলে নেয় ১০ লাখ টাকা। কিন্তু মাত্র সাত দিনের মাথায় একইভাবে টাকা তুলতে গিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। তারা শাহানাকে পরদিন আসতে বলেন। ওই সময়ের মধ্যে লন্ডন প্রবাসী জগলুল পাশার স্বজনরা কাউকে চেক না দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পরে শাহানা টাকা নিতে গেলে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। এ মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ জানতে পেরেছে, সারা দেশেই এ চক্রের সিন্ডিকেট সক্রিয় রয়েছে। প্রভাবশালী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার লোকজন এ কাজে জড়িত। সহযোগিতায় রয়েছে পোস্ট অফিস ও অসাধু কিছু ব্যাংক কর্মচারী। সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক ইমাম আল মেহেদি আমার সংবাদকে বলেন, মামলার সব আসামিকে তিনি গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। তবে অন্য কর্মকর্তাদের তদন্তে এ ধরনের আরো মামলা রয়েছে। পুলিশ যতই আসামি ধরুক না কেন, লেনদেনের আগে ব্যাংক কর্মকর্তাদের উচিত সঠিক যাচাই-বাছাই নিশ্চিত করা। সবার আগে জরুরি ব্যাংক গ্রাহকদের সচেতনতা।