Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

ওষুধ-যন্ত্রপাতি সংকটে ধুঁকছে ঢামেকের বার্ন ইউনিট

প্রিন্ট সংস্করণ॥ফারুক আলম

ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৯, ০৮:৩৬ পিএম


ওষুধ-যন্ত্রপাতি সংকটে ধুঁকছে ঢামেকের বার্ন ইউনিট

লোকবল, চিকিৎসক, শয্যা, ওষুধ ও যন্ত্রপাতি সংকটে ঢাকা মেডিকেল কলেজে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে পোড়া রোগীদের চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে। এসব সংকটে প্রতিনিয়ত চরম দুর্ভোগ আছেন রোগীরা। হাসপাতালটির এ ইউনিটে ১৫০ শয্যা থাকলেও রোগী ভর্তি থাকছেন ৯০০ জন। ফলে হাসপাতালের নির্ধারিত ১৫০ রোগীর বরাদ্দকৃত ওষুধ ও ডায়েট (খাবার) সকলকে দিতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে কর্তৃপক্ষ।সরেজমিন দেখা যায়, ঢামেকের বার্ন ইউনিটি কোথাও বেড ও ফ্লোর খালি নেই। পাঁচতলায় হাঁটার মতো অবস্থা নেই। লিফট থেকে নেমে ভেতরে যেতে হয় খুব সতর্কতার সঙ্গে। ইউনিটের চার ও পাঁচতলায় পুরুষ রোগীর সংখ্যা বেশি। অধিকাংশ রোগী বিদ্যুৎস্পৃষ্ট ও সিলিন্ডার গ্যাসের আগুনে দগ্ধ হয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক সহিংসতা, সিলিন্ডার গ্যাস ও বয়লার বিস্ফোরণে সারাদেশে পোড়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এতে শত শত রোগী চিকিৎসা নিতে বার্ন ইউনিটে এলেও সক্ষমতা নেই ঢাকা বার্ন ইউনিটের। ফলে রোগীর চিকিৎসা ব্যাঘাত হচ্ছে। যা মোকাবিলায় ঢাকা মেডিকেলের পাশে এশিয়ার সর্ববৃহৎ ৫০০ শয্যার ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও সার্জারি ইউনিট ইনস্টিটিউট’ গত বছরের ২৪ অক্টোবার উদ্বোধন হলেও চিকিৎসক, যন্ত্রপাতির কারণে চালু করা সম্ভব হয়নি। জানা গেছে, আগুনে পোড়া রোগীদের অন্য হাসপাতালের চিকিৎসকরা বাঁচানো নিয়ে যখন অনিশ্চয়তায় পড়েন তখন তারা দ্রুত রোগীটিকে ঢামেক বার্ন ইউনিটে রেফার করেন। তবে শরীরের ৪০ শতাংশের বেশি পুড়ে গেলে রোগীদের বাঁচানো দায়। আবার ৪০ শতাংশের নিচে হলেও, শ্বাসনালী যদি পুড়ে যায় সে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। আগুনের মধ্যে পড়ে মানুষ ধোঁয়ার কু-লীতে যখনই শ্বাস নিতে থাকে তখন শ্বাসনালী পুড়ে যায় ফলে তাদের বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি এ দুটি ইউনিটে প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েশন প্রফেসার, অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর, আরএসসহ ৯০ জনের মতো ডাক্তার ও ২২০ জন নার্স আছে। শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়া রোগীদের জন্য ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা হয়েছে দুটি অত্যাধুনিক হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বার। চিকিৎসরা বলছেন, এই যন্ত্রের মাধ্যমে শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়া রোগীদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব।চিকিৎসকরা বলছেন, শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়া শরীরের সব রাসায়নিক উত্তেজক গ্রন্থির সিক্রেশন আরও দুই থেকে তিনগুণ বেড়ে যায় এবং অতি অল্প সময়ে ওই পোড়া রোগীর সারা শরীর ফুলে-ফেঁপে যায়। একে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় ইডিমা ফরমেশন বলে। ইডিমার কারণে বাতাসের মধ্যে থাকা অতি প্রয়োজনীয় অক্সিজেন নিঃশ্বাসের সঙ্গে দেহকোষে পর্যাপ্ত পরিমাণে পৌঁছাতে পারে না বিধায় পোড়া রোগী চিকিৎসায় ভালো বা আবার মন্দও হতে পারে। কিন্তু ঢাকা বার্ন ইউনিটে মাত্র দুটি হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বার আছে। একজন রোগীকে সপ্তাহ দেড় ঘণ্টা করে হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বারে রাখতে হয়। তবে এ যন্ত্রটি কম হওয়ায় শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়া রোগীদের বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়ছে।একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, প্রতিদিন প্রায় ৩৭০ জন পোড়া রোগী ঢাকা বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে আসেন। এই হিসেবে বছরে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫০ জন রোগী চিকিৎসা নেন। এসব রোগীর মধ্যে যাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক তাদের হাসপাতালে ভর্তি করে নেয়া হয়। আর যারা শঙ্কামুক্ত তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে। আর প্রতিদিন কমবেশি ৩ জন রোগী মারা গেছে বছরে ১ হাজার ৯৫ রোগী মারা যাচ্ছে। তবে ঢাকা বার্ন ইউনিটে যেসব পোড়া রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন তারা অধিকাংশ গুরুত্বর অবস্থায় আসেন।ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক ডা. আজাদ আমার সংবাদকে বলেন, ১৫০ শয্যার হাসপাতাল রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় ফ্লোর ও করিডরে থাকতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা ওষুধ সংকট ও জায়গার স্বল্পতা। রোগীদের হাসপাতালের মেঝেতে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে। তাছাড়া পোড়া রোগীদের জন্য জায়গা গুরুত্বপূর্ণ। ঢামেক বার্নে জায়গা কম থাকায় একজনের ক্রস ভাইরাস অন্য রোগীকে আক্রান্ত করে। এতে মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে। তবে নতুন করে ৫০০ শয্যা ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’ হয়েছে। সেখানে ২৫০ শয্যা বার্ন ও ২৫০ শয্যা সার্জারি বিশিষ্ট রয়েছে। আর ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম মাঝখানে থাকবে। ঢাকা মেডিকেল বার্ন ইউনিটের ডাক্তার মনির আহম্মেদ আমার সংবাদকে বলেন, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও সার্জারি ইনস্টিটিউট উদ্বোধন করা হলেও চালু হয়নি। তবে ২০০৩ সালে একটি ‘৫০ শয্যা বিশিষ্ট বার্ন ইউনিট’ প্রজেক্টের আওতায় ঢাকা মেডিকেলের কিছু ডাক্তার ও নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। তিনি আরও বলেন, বার্ন ও সার্জারি দুটি বিভাগের চিকিৎসা ভিন্ন ভিন্ন। দুটি বিভাগ একত্রিত করে চিকিৎসা করা হচ্ছে। জনবল ও চিকিৎসক কম থাকায় রোগীদের চিকিৎসা দেয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে।ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ও সার্জারি ইউনিটের নার্স মৌসুমী আমার সংবাদকে বলেন, ১৫০ শয্যা দুটি ইউনিটে ৯০০ জন রোগী মাত্র ২২০ জন নার্স থাকায় পোড়া রোগীদের সেবা দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ২৪ ঘণ্টা সেবা দিতে ১৫০ জন রোগীর জন্য দিনে ৬-৭ জন নার্স ও রাতে ২ জন নার্স থাকেন। ১৫০ শয্যার জন্য বরাদ্দকৃত ওষুধ প্রতি সপ্তাহ একদিনে আনতে হয়। সেখানে ১৫০ জন রোগীর বরাদ্দ ওষুধ ৯০০ জন রোগীর মাঝে বিতরণ করা হয়। এরপর বাকি দিনগুলো রোগীর স্বজনরা বাইরে থেকে ওষুধ কিনে। এতে নার্সদের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের সঙ্গে বাগবিত-ের ঘটনা ঘটছে বলে জানান এই নার্স। ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটের প্রধান সমন্বয়কারী ডা. সামন্ত লাল আমার সংবাদকে বলেন, ডাক্তার-নার্স ও স্টাফ সংকট থাকার পরেও রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেয়ার চেষ্টা করি। আর ভবিষ্যতে যেন দেশে কোনো পোড়া রোগী বিনা চিকিৎসায় মারা না যায়। এ জন্য নতুন বার্ন ইউনিটে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকবে দেশের অন্যকোথাও নাই। ঢামেক বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিতে এসে আকলিমা বেগম আমার সংবাদকে বলেন, তার স্বামী গ্রামে একবাসায় পাতা কুঁড়ে আগুন ধরাতে গিয়ে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। ২৮ দিন ধরে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসা নিচ্ছেন। এ পর্যন্ত তার ১ লাখ টাকার কম খরচ হয়েছে। কারণ চিকিৎসার জন্য অধিকাংশ ওষুধ হাসপাতালের বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে।প্রসঙ্গত, ১৯৮৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পাশে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৩ সালে ১০ জন চিকিৎসক নিয়ে ৫০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ইউনিট যাত্রা শুরু করে। ২০০৯ সালে তা ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এরপর দিন দিন এই ইউনিটের কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়া ও বিভিন্ন অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে ২০১৩ সালে বার্ন ইউনিটকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্লাস্টিক সার্জারি নামে রূপান্তরিত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর ২০১৬ সালের ৬ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চানখাঁরপুলে ‘শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট’ নামে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর নির্মাণকাজ শুরু করে। দুই একর জমির ওপর ৯১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয় বিশ্বের সর্ববৃহৎ অত্যাধুনিক এ বার্ন হাসপাতালটি। যা ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন। কিন্তু চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হয়নি।