Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪,

রাসায়নিক বিপর্যয় রোধে করা হয়নি পর্যাপ্ত আইন

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৯, ০৮:১৯ পিএম


রাসায়নিক বিপর্যয় রোধে করা হয়নি পর্যাপ্ত আইন

*কেমিক্যাল ও গ্যাস সিলিন্ডার একে অপরের পরিপূরক
*২০০৬ সালে ‘এসএআইসিএম’ চুক্তিতে সই করেও নীরব থাকা
*২০০৯ সালের রাসায়নিক দ্রব্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি জিএইচএসে পক্ষ হচ্ছে না বাংলাদেশ
*প্রসেস সেফটি সম্পর্কে ব্যবসায়ীদের ধারণার অভাব
*আন্তর্জাতিক তহবিলের সাহায্য নিয়ে কমিটি গঠনের সুপারিশ বিশেষজ্ঞদের
*আবাসিক এলাকার তথ্য জানাতে ৯৫৫৬০১৪ নম্বরে ফোনের আহ্বান মেয়রের
*গতকাল পর্যন্ত হস্তান্তর ৪৭ মরদেহ, ১৯ মরদেহের বিপরীতে ৩২ স্বজনের ডিএনএ সংগ্রহ
*২-৩ দিনের মধ্যেই আসছে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন

রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৬৭টি তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়ার ঘটনায় কেমিক্যাল ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কেমিক্যাল কোনো দুর্ঘটনার জন্য দায়ী নয়, বরং গ্যাস সিলিন্ডারই দায়ী। পক্ষান্তরে সাধারণ মানুষের দাবি সকল আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল দ্রব্যের সংশ্লিষ্ট সব দোকানপাট সরিয়ে নিতে হবে। অথচ রাসায়নিক ও গ্যাস সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, অগ্নি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে গ্যাস সিলিন্ডার ও কেমিক্যাল একে অপরের পরিপূরক। বিভিন্ন মহলের দাবি নিমতলীর ঘটনার পরও সরকারের টনক না নড়ায় চকবাজার ট্র্যাজিডির মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং ৬৭টি তাজা প্রাণ ঝরেছে। এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি থামাতে সরকারকে এখনি কঠোর অবস্থানে উত্তীর্ণ হতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান সময়ে প্রচলিত আইনে দেশে রাসায়নিক বিপর্যয় ঘটলেও তা রোধ করা সম্ভব নয়, বরং রাসায়নিক বিপর্যয় রোধে আইনের সংকট রয়েছে বৈকি নেই কোনো প্রস্তুতিও। বিশ্বব্যাপী আলোচিত চকবাজারের এ দুর্ঘটনায় ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক সমাধানের আশ্বাস দেয়া ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে সকল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠান সরানোর নির্দেশ দিয়েছেন এবং সরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলেও জানিয়েছেন সেতুমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা। কেমিক্যালের কারণে আগুন এলাকাটিতে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে এমন তথ্য অস্বীকার করে চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকার জুয়েলারি ব্যবসায়ী হাজী আব্দুর রশিদ বলেন, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণে প্রতিনিয়তই দুর্ঘটনা ঘটছে। ঝরে যাচ্ছে তাজা প্রাণ। আমরা চাই দেশ থেকে সব গ্যাস সিলিন্ডার বন্ধ করে দেয়া হোক। তার মতে, কেমিক্যাল নয় সব কিছুর জন্য দায়ী গ্যাস সিলিন্ডার। হাজী মুসলিম নামে অন্য ব্যবসায়ী বলেন, কেমিক্যাল থেকে সব কিছু তৈরি হয়। কেমিক্যাল থেকে কোনো দুর্ঘটনা আজও ঘটেনি। ইজতেমা ময়দান থেকে শুরু করে সব জায়গায় গ্যাস সিলিন্ডার কেড়ে নিয়েছে প্রাণ। আমরা এই গ্যাস সিলিন্ডার চাই না। ব্যবসায়ীদের এমন দাবির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সাধারণ মানুষরা বলছেন, আবাসিক এলাকায় আর কোনো মরদেহ দেখতে চাই না, কেমিক্যালমুক্ত এলাকা চাই। মোমেনা আহমেদ নামে মাঝবয়সী এক নারী বাসিন্দা বলেন, কেমিক্যাল নামে ভয়ানক পদার্থ আর আবাসিক এলাকায় চাই না। কেমিক্যাল না থাকলে ওই দুর্ঘটনার ভয়াবহতা এত বেশি হতো না। আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল দোকান, গুদাম বন্ধ হওয়া উচিৎ। সাইদুল ইসলাম নামে অন্য বাসিন্দার মতে, সিলিন্ডার সব সমস্যার কারণ হতে পারে না। গাড়ির গ্যাস সিলিন্ডার দেখতে হবে তার মেয়াদ আছে কি না। আমারও গাড়ি আছে, সিলিন্ডারে চলে। নিয়মিত সার্ভিসিং করতে হবে, সতর্ক হতে হবে। ব্যবসায়ীরা সতর্ক না হওয়ায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এখন তারা সিলিন্ডার নিয়ে নতুন ইস্যু তৈরি করার চেষ্টা করছে।এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্ট্র্যাটেজিক অ্যাপ্রোচ টু ইন্টারন্যাশনাল কেমিক্যালস ম্যানেজমেন্ট বা এসএআইসিএম চুক্তি। এতে বিগত ২০০৬ সালে দুবাইয়ে বাংলাদেশ সই করেছিল। কিন্তু সই করার পর আর কোনো ফলোআপ আদৌ না থাকায় রাসায়নিক নিরাপত্তাহীনতা বিরাজ করছে দেশে। অথচ বিশ্বব্যাপী রাসায়নিক নিরাপত্তার ধারণাকে এগিয়ে নেয়ার জন্যই এই রূপরেখা চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশসহ অন্য সদস্যদেশগুলো। চকবাজার ট্র্যাজেডি থেকে তাগাদা নিয়ে বাংলাদেশকে এখনই এটা এগিয়ে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
এ ছাড়া রাসায়নিক দ্রব্যের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য আন্তর্জাতিক তহবিলও রয়েছে। সেই তহবিলের সহায়তায় একটি জাতীয় রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠিত করে নেয়া যেতে পারে। কারও মনে হতে পারে এটা দূরের বিষয়। কিন্তু তা নয়, আমাদের রাসায়নিক নিরাপত্তাব্যবস্থা বিশ্বমানের করে তোলার স্বার্থেই এটা করা উচিত। সে জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে একটি জাতীয় রাসায়নিক কমিটি গঠনের সুপারিশও করেন বিশেষজ্ঞরা। আমাদের ইতিহাসে অন্য বহু ক্ষেত্রে এ ধরনের কমিটি বা অবকাঠামো রয়েছে। কিন্তু রাসায়নিক নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দিতে এ ধরনের একটি উদ্যোগ অনেক আগেই নেয়া উচিত ছিল যা আদৌ করা হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার জন্য একটি আলাদা নিবেদিতপ্রাণ বিভাগ থাকা দরকার। তারা রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা দেখবে। কিন্তু তারা একই সঙ্গে সরকারের অন্য সব অংশ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করবে। এত দিন যা চলে আসছে, তা খণ্ডিত বা আংশিকভাবে প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে মাত্র। আমরা আনন্দিত যে আমাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ভালো অবস্থায় রয়েছে। এটা আরও জোরালো হবে। এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই একটি উপযুক্ত রাষ্ট্রীয় রাসায়নিক অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। প্রসেস সেফটি কথাটি আমাদের দেশের মানুষের জানা নেই। এটা চালু করতে হবে। এটা শুধু রাসায়নিক মহাবিপর্যয় রোধের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। অথচ এ বিষয়ে আমাদের কোনো আইন নেই, রয়েছে সংকট প্রস্তুতি নেই। এছাড়া রাসায়নিক দ্রব্য বিষয়ক ২০০৯ সালের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে আদৌ পক্ষ হচ্ছে না কেন বাংলাদেশ এমন প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিপ্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান গণমাধ্যমে বলেন, রাসায়নিক দ্রব্যের ‘গ্লোবালি হারমোনাইজড সিস্টেম’কে সংক্ষেপে বলা হয় (জিএইচএস)। সব ধরনের রাসায়নিকের শ্রেণিকরণ, লেবেল লাগানো এবং মোড়কজাতকরণ-সংক্রান্ত এটি একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি। বাংলাদেশের উচিত এতে পক্ষভুক্ত হওয়া। বাংলাদেশ যদি এতে পক্ষ হয়, তাহলে তাকে আরও একটি কাজ একত্রে করতে হবে। সেটি হলো ‘সেফটি ডেটা শিট-এসডিএস’ তৈরি করা। কিন্তু এটা তৈরির কোনো প্রক্রিয়া চলমান আছে কি না জানা নেই তার। এদিকে, চকবাজারের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ৬৭ জন নিহতের মধ্যে ৪৭ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। পরে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আরও একটি মরদেহ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। অন্যদিকে, অজ্ঞাত পরিচয়ের ১৯ মরদেহ শনাক্তকরণে এসব মরদেহের দাবিদার ৩২ জনের ডিএনএ টেস্টের জন্য নমুনা সংগ্রহ করেছে সিআইডি। গতকাল শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ঢাকা জেলা প্রশাসন ও সিআইডি’র কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেন। ঢাকা জেলা ডিসি অফিসের সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আবুল্লা আল মাহফুজ বলেন, আমরা গতকাল রাত পর্যন্ত ৪৬ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করেছি। শনিবার সকালে একটি মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও একটি মরদেহ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে।সিআইডির সহকারী ডিএনএ অ্যানালিস্ট নুসরাত ইয়াসমিন বলেন, গতকাল থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত ১৯টি অজ্ঞাত মরদেহের বিপরীতে আমরা ৩২ জনের নমুনা সংগ্রহ করেছি। আমরা এখন অপেক্ষা করছি মরদেহের দাবিদার আর কোনো স্বজন আসেন কি না। কেউ আসলে আমরা তাদেরও ডিএনএ টেস্টের জন্য নমুনা সংগ্রহ করব। সর্বশেষ ত্যথানুযায়ী পুরান ঢাকার সমস্ত কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণে নেমেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি)। যতক্ষণ পর্যন্ত এই এলাকায় কেমিক্যালের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত অপসারণ বা উচ্ছেদ কার্যক্রম চালিয়ে যাবার ঘোষণাও দিয়েছে সিটি মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। সেই সঙ্গে নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে মেয়র বলেন, সর্বস্তরের নাগরিকদের প্রতি অনুরোধ যদি কেউ গোডাউনে কেমিক্যাল স্টোর করতে দেখেন বা কেমিক্যাল রাখতে দেখেন আপনারা আমাদের কন্ট্রোল রুম ‘৯৫৫৬০১৪’ নম্বরে জানান। যে কেউ তার বাড়ির আশাপাশে পাড়া-মহল্লায় কেমিক্যাল রাখছে এমন দৃশ্য দেখেন তাহলে আমাদের কন্ট্রোল রুম, পুলিশ কন্ট্রোল রুম, কাউন্সিলর অফিসে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে জানান, আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবো। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের এ ঘটনায় গঠিত তিনটি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। ঘটনার তদন্ত প্রতিবেদন খুব সতর্কতার সঙ্গে দেখা হবে। রিপোর্টগুলোকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে স্বজনদের কাছে লাশ হস্তান্তর, আহতদের চিকিৎসা, নিখোঁজদের শনাক্ত ও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে তা পরীক্ষার কাজ চলছে এবং চকবাজার থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে চকবাজার এলাকা থেকে সরানো হলেও পর্যায়ক্রমে তালিকা তৈরি করে পুরো পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরানো হবে। প্রসঙ্গত, বুধবার রাত ১০টা ৩৮ মিনিটে রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজার থানার চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদের সামনে একটি পিকআপের সিলিন্ডার বিস্ফোরণের পর আশপাশের ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট ১১ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এই ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৬৭ জন। আহত হয় কমপক্ষে ৫০ জন। যারা রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তার মধ্যে ঢামেকের বার্ন ইউনিটে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছে ৯ জন। যাদের কারোই এখনো পর্যন্ত অবস্থার অবনতি ছাড়া উন্নতি হয়নি বলে বার্ন ইউনিট সূত্রে জানা যায়।