Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

কড়াইলে ফ্ল্যাট নির্মাণ : ‘অসামঞ্জস্য’ ডিপিপি সংশোধন হচ্ছে

প্রিন্ট সংস্করণ॥কাওসার আজম

ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৯, ০৫:৩৫ এএম


কড়াইলে ফ্ল্যাট নির্মাণ : ‘অসামঞ্জস্য’ ডিপিপি সংশোধন হচ্ছে

রাজধানীর গুলশান-বনানীর মধ্যে অবস্থিত কড়াইলে (বস্তি) ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সংশোধন হচ্ছে। অসামঞ্জস্যপূর্ণ চুক্তির ভিত্তিতে গণপূর্ত অধিদপ্তরের উদ্যোগে বাস্তবায়ন হতে চলা ওই প্রকল্প নিয়ে নানা প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে, প্রধান প্রকৌশলী মো. সাহাদাত হোসেন অবশ্য এটিকে সংশোধন বলতে নারাজ। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে ডিপিপিতে কিছু অবজারভেশন দিয়ে ফেরত দিয়েছে। তারা কিছু কারেকশন দিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ডিপিপি কারেকশন করে পাঠাব। বর্তমান ডিপিপির আলোকে কড়াইল বস্তি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পভুক্ত জমির মালিকানা বাবদ ডেভেলপার কোম্পানি থেকে কোনো সাইনিং মানি দিতে হবে না। প্রতি কাঠা জমির বিপরীতে ২০ লাখ টাকা সাইনিং মানি ধরা হলে সরকারের ক্ষতি হবে প্রায় ৫২৪ কোটি টাকা। অন্যদিকে ফ্লোর স্পেস ভাগাভাগিতে ৬০ শতাংশের পরিবর্তে সরকার পাবে ৪০ শতাংশ। এখানেও সরকারের লোকসান হবে আরো প্রায় ৪৬৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে কড়াইল বস্তির ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে সরকারের প্রায় এক হাজার কোটি টাকা লোকসান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের (রিহ্যাব) একাধিক সদস্য জানান, গুলশানে অন্তত ৬০ শতাংশ ফ্লোর স্পেস ভূমি মালিক পান। এ ছাড়া সাইনিং মানি পান প্রতি কাঠা অন্তত ২০ লাখ টাকা। দেড় শ’ বিঘা জমি একসঙ্গে হলে সেখানে অত্যাধুনিক ও আকর্ষণীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যায়। এ ক্ষেত্রে জমির মালিকের ফ্লোরের পার্সেন্টেজ ও সাইনিং মানি আরও বেশি হওয়ার কথা।জানা যায়, গুলশান লেকপাড়ে বনানীর কড়াইল বস্তিতে ৪৩ দশমিক ৩৮ একর (১৩০ দশমিক ১৪ বিঘা) জমি রয়েছে পূর্ত বিভাগের। এর প্রায় ২২ একর জমিতে দীর্ঘদিন ধরেই বস্তিঘর রয়েছে। স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী সেখানে ঘর তুলে ভাড়া দিয়ে আয় করছেন। ২০১৪ সালে এখানে পিপিপির ভিত্তিতে ফ্ল্যাট তৈরির উদ্যোগ নেয় পূর্ত বিভাগ। তখন বলা হয়, এ জমিতে পিপিপির ভিত্তিতে ফ্ল্যাট তৈরি করে পূর্ত বিভাগের প্রাপ্য ফ্ল্যাটগুলো সরকারি কর্মকর্তাদের বরাদ্দ দিলে আবাসন সঙ্কট কমবে। ডেভেলপার তার ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিতে পারবে। পরে ২০১৫ সালে পূর্ত বিভাগ একটি ডিপিপি তৈরি করে দরপত্র আহ্বান করে। চারটি প্রতিষ্ঠান দরপত্রে অংশ নেয়। তখন ৩৯ শতাংশ ফ্লোর ছিল সরকারের। বাকি ৬১ শতাংশ ছিল ডেভেলপারের। এর মধ্যে প্রকল্প এলাকার আনুষঙ্গিক উপকরণও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু সরকারের লোকসান হবে বলে মন্ত্রণালয়ের আপত্তির কারণে তখন সেটা স্থগিত হয়ে যায়। এবারে তৈরি করা ডিপিপিতে ২০১৫ সালের বাজারমূল্য অনুসারেই জমির দাম ধরা হয়েছে। নতুন ডিপিপিতে এ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ১১ হাজার কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে জমির মূল্য পাঁচ হাজার ৪২ কোটি ৮৮ লাখ ৩৩ হাজার টাকা। ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে পাঁচ হাজার ৬২৫ কোটি ১১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা। জমির মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে উঁচু জমি কাঠাপ্রতি ২ দশমিক ২৫ কোটি টাকা এবং নিচু জমি কাঠাপ্রতি ১ দশমিক ৭৫ কোটি টাকা। ২০১৫ সালের ডিপিপিতেও জমির মূল্য একই ছিল। অথচ গুলশান ও বনানী সংলগ্ন এলাকায় বর্তমানে জমির বাজার দর ক্ষেত্রবিশেষে কাঠাপ্রতি পাঁচ থেকে ১০ কোটি টাকা বলে জানা যায়। এদিকে কড়াইলের প্রকল্পে জমির দাম কম ধরে প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৪৯ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ সরকারের এবং ৫০ দশমিক ৯২ শতাংশ অংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠানের দেখিয়ে এই ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়। এটিকে একেবারেই অবাস্তব হিসেবে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। গণপূর্ত বিভাগ সূত্র জানায়, তিন বছর পর নতুন করে ডিপিপি প্রণয়নের ফলে সরকারের অংশীদারিত্বের পরিমাণ বেশি হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। তা ছাড়া ২০১৫ সালের ডিপিপিতে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের অর্থায়নে প্রকল্প এলাকায় ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, হেলথকেয়ার সেন্টার, রিটেইল মল ও মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টার ও অন্যান্য সুযোগ সংবলিত ভবন, পুলিশ স্টেশন ও অন্যান্য সার্ভিস ভবন ছাড়াও কমন ফ্যাসিলিটিজ (বাইরে ও ভেতরে খেলাধুলার সুবিধা, নিচতলায় কার পার্কিং, শিশুদের খেলাধুলার স্থান, লেকের পানি শোধন), দুটি ছোট সেতু, লেকের পাড় বাঁধানো, ১০টি উন্মুক্ত প্যাভিলিয়ন, ১৫টি ডাস্টবিন, বাইরে বসার ব্যবস্থা, মাছ শিকার ও নৌকা চালানোর সুবিধা, সুইমিংপুল তৈরিসহ আরও বেশ কিছু বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে প্রকল্প ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল। অথচ চলতি ডিপিপিতে এসব খাতের ব্যয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ খাতে এবার ডিপিপিতে ৩১৯ কোটি ৬৭ লাখ ৩৭ হাজার টাকা পৃথক ব্যয় ধরা হয়েছে। গতবারের ডিপিপিতে এসব আনুষঙ্গিক সুবিধাসহ ব্যয় ধরা হয়েছিল ১১ হাজার ৭৪ কোটি ৬০ লাখ ৪২ হাজার টাকা। তখন সরকারি বিনিয়োগের পরিমাণও ছিল এবারের চেয়ে কমÑ ৪৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ।

আর্থিক ক্ষতি অন্তত হাজার কোটি টাকা
৬০ শতাংশ ফ্লোর ভূমি মালিক পেলে এ প্রকল্প থেকে পূর্ত বিভাগ ফ্লোর পেত ১৩ লাখ ৮৯ হাজার বর্গফুট। কিন্তু ৪০ শতাংশের কারণে পাচ্ছে নয় লাখ ২৬ হাজার বর্গফুট ফ্লোর। ফলে স্বাভাবিকের চেয়ে চার লাখ ৬৩ হাজার বর্গফুট কম ফ্লোর পাচ্ছে পূর্ত বিভাগ। গুলশান-বনানীতে সাধারণত আবাসিক ভবনে ফ্ল্যাটের প্রতি বর্গফুটের মূল্য ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা। এ হিসাবে লোকসান দেয়া চার লাখ ৬৩ হাজার বর্গফুটের মূল্য দাঁড়ায় ৪৬৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া প্রতি কাঠায় ২০ লাখ টাকা করে সাইনিং মানি বাবদ লোকসান হবে ৫২৪ কোটি টাকা।

যা থাকছে কড়াইল বস্তি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে
কড়াইল বস্তি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে এ-১ টাইপ ভবন হবে ১১টি। প্রতিটি ৩০ তলা। প্রতি তলার আয়তন হবে ২৭ হাজার বর্গফুট। প্রতি ফ্ল্যাটের আয়তন হবে এক হাজার ৫৫০ থেকে দুই হাজার ৬০০ বর্গফুট। এ-২ টাইপের ভবন হবে চারটি। প্রতিটি হবে ২৯ তলা। প্রতি তলার আয়তন ২৭ হাজার বর্গফুট। ফ্ল্যাটের আয়তন হবে এক হাজার ৫৫০ থেকে দুই হাজার ৬০০ বর্গফুট। বি টাইপের ভবন হবে একটি, ২৩ তলাবিশিষ্ট। প্রতি তলার আয়তন হবে ১৮ হাজার বর্গফুট। সি টাইপের ভবনও হবে একটি, ২২ তলাবিশিষ্ট। প্রতি তলার আয়তন হবে ১৪ হাজার বর্গফুট।

এ ব্যাপারে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. সাহাদাত হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, লাভ-ক্ষতির বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই না। এটি আমি দায়িত্ব নেয়ার আগেই হয়েছে। ডিপিপিটি গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে কারেকশন করতে আমাদের কাছে পাঠানো হয়েছে। কী কী অংশ সংশোধন হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঠিক সংশোধন নয়। কিছু অবজারভেশন দিয়েছে মন্ত্রণালয়। সেগুলো ঠিক করে আমরা পাঠাব। গণপূর্ত অধিদপ্তরের সদ্য অবসরে যাওয়া প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ রফিকুল ইসলামের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তিনি একাধিক গণমাধ্যমে দাবি করেছেন, সব ধরনের নিয়মকানুন মেনেই ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) প্রণয়ন করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এই প্রতিবেদককে জানান, কড়াইল বস্তি ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্পে জমির দাম কম ও প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয় বেশি ধরাসহ কিছু অভিযোগ আমার কাছেও এসেছে। আমি দায়িত্ব নেয়ার আগে এই ডিপিপি হয়েছে। এটি আমি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছি। এখানে কোনো অনিয়মকে প্রশ্রয় দেবো না।