Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

ভোগান্তির মূলে অস্থায়ী নিয়োগ!

প্রিন্ট সংস্করণ॥নুর মোহাম্মদ মিঠু

ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০১৯, ০৬:৪৫ পিএম


ভোগান্তির মূলে অস্থায়ী নিয়োগ!

*ঢামেক বার্ন ইউনিট বকশিস বিড়ম্বনায় ভোগান্তিতে রোগীর স্বজনরা
*১৫ বছর ধরে বিনা বেতনে সেবা দিচ্ছেন কর্মচারীরা
*নিয়োগ না হলেও কর্মচারীরা কাজ করছেন সরকারি আদেশে

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। পোড়া ক্ষতের দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে সারাদেশ থেকে অনেকেই ছুটে যান সেখানে। অথচ গেট দিয়ে ঢুকতেই চিকিৎসকদের কাছে পৌঁছার আগেই তাদের পাশে এসে দাঁড়ান আনসার-আয়া থেকে শুরু করে এ ইউনিটের অন্যসব কর্মচারীরা। বার্ন ইউনিটে পোড়া ক্ষতের এক-একটি রোগী আসা মানেই যেন এ ইউনিটের কর্মচারীদের ইনকামের রাস্তা তৈরি হওয়া। রোগী ভর্তির প্রথমদিকে চিকিৎসকদের পাশাপাশি কর্মচারীদের সেবায় সুস্থ হওয়া রোগীর স্বজনরাই যেন শেষ পর্যন্ত হয়ে যান অসুস্থ। সরেজমিন রোগীর স্বজনদের অভিযোগ থেকে জানা যায়, বার্ন ইউনিটে পর্যাপ্ত চিকিৎসক ও রিসিপশন না থাকা, মারা যাওয়া রোগীদের বার্ন ইউনিট থেকে মর্গ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পথে টাকা দেয়া, টাকা না দিলে ড্রেসিংয়ের সময় রোগীদের অযত্ম-অবহেলা করা, আইসিইউ, সিসিইউ ও অজারভেশন বিভাগে নাইট ডিউটিতে নার্স না থাকা, লবিং ছাড়া আসা রোগীদের হয়রানি করা, ইমার্জেন্সি রোগীদের জন্য সময়মতো চিকিৎসক না পাওয়ায় চরম ভোগান্তির সৃষ্টিতে যেন অসুস্থ হয়ে যান রোগীর স্বজনরাই। এতসব ভোগান্তির পাশাপাশি কর্মচারীদের দেয়া সামান্যতম সেবার বিনিময়ে বকশিস হিসেবে রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে চেয়ে নিচ্ছে ৩০০ থেকে ৩ হাজার টাকাও। এতে যারা স্বল্প খরচের কথা চিন্তা করে এখানে আসেন তাদের অনেককেই হতে হচ্ছে ভোগান্তির শিকার। এদিকে, কর্মচারীদের এই বকশিস নেয়া ছাড়াও কোনো উপায় নেই। কারণ বার্ন ইউনিটে কর্মরত ৬৮ কর্মচারী বিনা বেতনে রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে রোগীদের কাছ থেকে নেয়া এই বকশিসেই চলে তাদের সংসার। যে চাকরি স্থায়ীকরণের আশায় ১৫ বছর ধরে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন সেই চাকরি নিয়েই বর্তমানে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন তারা। বার্ন ইউনিটে এই কর্মচারীদের বিকল্পও সম্ভব নয় স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, সরকার আউটসোর্সিংয়ে দৃষ্টি দেয়ায় এদের নিয়োগ হচ্ছে না। তবে শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে।কর্মচারীরা অভিযোগ করেন, গত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে নিরলসভাবে রোগীদের সেবা দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো বেতন-ভাতাই পাননি তারা। বিনা বেতনে তাদের চাকরি স্থায়ীকরণ দূরে থাক কাজের জন্য সরকার বা হাসপাতাল থেকে কোনো ধরনের পারিশ্রমিক দেয়া হয় না। এই দীর্ঘ সময়ে অনেকেই তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের আশ্বাস দিলেও বাস্তবায়ন করেনি কেউই। বর্তমানে যখন তাদের চাকরি স্থায়ীকরণের সুযোগ আসতে শুরু করেছে, ঠিক তখনই একটি পক্ষ বয়সের দোহাই দিয়ে বাদ দিতে চাইছে। এতে চরম হতাশার মধ্যে রয়েছে বার্ন ইউনিটের কর্মচারীরা। সূত্র মতে, ১৯৮৭ সালে ঢামেক হাসপাতালের পাশে বার্ন এন্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০০৩ সালে ১০ জন চিকিৎসক নিয়ে ৫০ শয্যার পূর্ণাঙ্গ ইউনিট যাত্রা শুরু করে। ২০০৯ সালে তা ১০০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। এরপর দিন দিন এই ইউনিটের কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়া ও বিভিন্ন অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে ২০১৩ সালে বার্ন ইউনিটকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্লাস্টিক সার্জারি নামে রূপান্তরিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি আদেশ জারি করে। কার্যক্রমের পর থেকে প্রতিদিনই বাড়ছে এই ইনস্টিটিউটের কার্যক্রম। পোড়া রোগীর চিকিৎসার পাশাপাশি বাড়ছে তাদের কাজের পরিধিও।কর্মচারীরা বলেন, প্রতিটি কাজেই তাদের সরকারি কর্মচারীদের মতোই আদেশ দেয়া হয়। সেই আদেশে তারা শিফট ভাগ করে রুটিন কাজ, প্রশিক্ষণ এমনকি কোনো বিশেষ ক্যাম্পেইনেও কাজ করে থাকেন। নিয়োগের সময় এসব কর্মচারীকে বলা হয়েছিল প্রথমে তাদের মাস্টার রোলে নিয়োগ দেয়া হবে। সার্কুলার এলেই চাকরি জাতীয়করণ করা হবে। অথচ এতদিন পর হলেও তারা চাকরি জাতীয়করণ তো দূরের কথা কোনো ধরনের পারিশ্রমিক দেয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে রোগীদের কাছ থেকে চেয়ে বকশিস নিয়ে কোনো রকমে সংসার চালাতে হয় এসব কর্মচারীকে। এতে করে অনেক সময় রোগীরাও বিরক্ত বোধ করে থাকেন বলে জানান কর্মচারীরা। তারপরও বাঁচার তাগিদেই এই বকশিস নিতে হয় তাদের।বার্ন ইউনিটের অস্থায়ী কর্মচারী সমিতির নেতা ও সদস্যরা জানান, বার্ন ইউনিটে ৬৮ কর্মচারীর মধ্যে কেউ হাসপাতাল পরিষ্কার-পরিছন্ন থেকে শুরু করে ওটি কমপ্লেক্স, এইচডিইউ, আইসিইউ, অফিস, চিকিৎসকদের রুমে দায়িত্ব পালন করে থাকেন। আবার কেউ ওয়ার্ডবয়, এমএলএসএস, ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রেসার কেউ অটোক্লেভ অপারেটর হিসেবে কাজ করছেন। এদের মধ্যে কেউ ১৫ বছর, কেউ ১০ বছর ধরে বিনা বেতনে কাজ করে যাচ্ছেন। তবে ২০১৫ সালে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েকজন কর্মকর্তার চাকরি স্থায়ী করা হয়। ওই সময় মাস্টার রোল দেখিয়ে চতুর্থ শ্রেণির এই কর্মচারীদেরও প্রকল্পের আওতায় এনে তিন মাসের বেতন দেয়া হয়েছিল। তিন মাস বেতন পাওয়ার পর চতুর্থ শ্রেণির এই কর্মচারীদের আর কোনো বেতন দেয়া হয়নি। এই ঘটনার আগে ও পরে এখন পর্যন্ত কেউ হাসপাতালের পক্ষ থেকে একটি পয়সাও পাননি। যার কারণে প্রত্যেক কর্মচারীকে চরম মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। হতাশায় বুঁদ হয়ে যখন ইউনিটের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে যান তখন তারা নানা ধরনের আশ্বাস দিতে থাকেন। কিন্তু সেগুলো আর বাস্তবায়ন হয় না। কর্মচারীরা বলেন, সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে বার্ন ইউনিটে সরকারিভাবে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগ করা হবে। এ ক্ষেত্রে ১৫ বছর ধরে বিনা বেতনে সেবা দিয়ে যাওয়া কর্মচারীদের অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা। কিন্তু একটি স্বার্থান্বেষী মহল বয়সের দোহাই দিয়ে এই কর্মচারীদের বাদ দিয়ে টাকার বিনিময়ে অন্যদের নিয়োগ দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। কর্মচারীরা মানবিক দিক বিবেচনা করে বিনা বেতনে চাকরি করা ৬৮ কর্মচারীর চাকরি স্থায়ীকরণের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। ঢামেকের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৬৮ জন কর্মচারীর নিয়োগের বিষয়ে বার্ন ইউনিট থেকে পরিচালকের কাছে তালিকা দিয়েছেন তিনি। এ বিষয়ে পরিচালকই বলতে পারবেন ভালো। তাছাড়া বার্ন ইউনিটের কর্মচারীদের বকশিস বিড়ম্বনাসহ বিভিন্ন কারণে ভোগান্তিতে রয়েছেন রোগীর স্বজনরা এমন প্রশ্নে তিনি নির্দিষ্ট অভিযোগ চান। বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন রোগীর স্বজনদের করা চিকিৎসক স্বল্পতার অভিযোগের প্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ঢামেকের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসক স্বল্পতা নেই।