Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

‘ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া সাবধান!’

প্রিন্ট সংস্করণ॥মহিউদ্দিন খান মোহন

মার্চ ৯, ২০১৯, ০৭:১৩ পিএম


‘ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া সাবধান!’

বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপন অনেকেরই নজর কেড়ে থাকবে। একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের ওই বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, একজন দোকান মালিক টাকা-পয়সা সিন্দুকে রেখে দোকান বন্ধ করে যাবার সময় নাইট গার্ডকে বলছেন- ‘এই যে জালাল মিয়া, ঘুমাইয়া ঘুমাইয়া খালি সাবধান সাবধান কইর না। পাহারা দিও’। এরপর রাতে চোর আসে। জালাল মিয়া যথারীতি ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই সাবধান সাবধান বলছে। চোরও তাকে ব্যঙ্গ করে সাবধান বলে তালা ভেঙে দোকানে ঢুকে টাকা-পয়সা নিয়ে যায়। বিজ্ঞাপনের ওই কাল্পনিক চুরির ঘটনার সঙ্গে আমাদের প্রধান বিমানবন্দরের নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট সাম্প্রতিক ঘটনার সাথে যদি কেউ সাজুয্য খুঁজে পান, তাহলে বোধকরি তাকে অমূলক বলা যাবে না। সম্প্রতি পর পর ঘটে যাওয়া তিনটি ঘটনা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সেখানে আদৌ কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা আছে কিনা তা নিয়েই সন্দেহ দেখা দিয়েছে।প্রথম ঘটনাটি ঘটে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম হয়ে দুবাইগামী বাংলাদেশ বিমানের একটি উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টা করে পলাশ আহমেদ ওরফে মাহদী নামে এক যুবক। সে একটি পিস্তল ও বোমাজাতীয় জিনিস দেখিয়ে উড়োজাহাজটি ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালায়। অবশ্য তার ছিনতাইচেষ্টা সফল হয়নি। নৌ-বাহিনীর কমান্ডোদের হামলায় সে নিহত হলে ছিনতাই নাটকের অবসান হয়। বিমান কর্তৃপক্ষ এবং নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পলাশের হাতের পিস্তলটি আসল ছিল না, ছিল খেলনা পিস্তল। প্রশ্ন উঠেছে যদি ওটা খেলনা পিস্তলও হয়, তাহলেও কি ওটা নিয়ে বিমানে ওঠা সম্ভব? বিমানের ‘কড়া চেকিং’ ও ‘কঠোর নিরাপত্তা’ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে সে পিস্তল নিয়ে উঠলো কীভাবে?এরপরের ঘটনা গত ৫ মার্চের। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাচ্ছিলেন আমাদের চলচ্চিত্রের এক সময়ের সুপার হিরো ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি বিমানবন্দরে প্রবেশের সময় তার সঙ্গে থাকা পিস্তলটি স্ক্যানিং মেশিনে ধরা পড়েনি। পরে দ্বিতীয় চেকিংয়ে তার সাথে থাকা পিস্তলের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। ইলিয়াস কাঞ্চন অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, সঙ্গে থাকা পিস্তলটির কথা তার খেয়াল ছিল না। পরে তিনি বিমানের আইনানুযায়ী পাইলটের কাছে পিস্তল জমা দিয়ে চট্টগ্রাম যান। তৃতীয় ঘটনা গত পরশু অর্থাৎ ৮ মার্চের। মামুন আলী নামের একজন যাত্রী ইউএস বাংলা এয়ার লাইন্সের একটি ফ্লাইটযোগে সিলেট যাওয়ার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরে প্রবেশ করেন। অভ্যন্তরীণ টার্মিনালের প্রথম গেটের আর্চওয়েতে তার শরীর তল্লাশি করে আনসার সদস্য রিপন। কিন্তু সে মামুনের সঙ্গে থাকা পিস্তল শনাক্ত করতে পারেনি। তল্লাশি শেষ হয়েছে কিনা নিরাপত্তাকর্মীর কাছে জানতে চান মামুন। সে জানায় তল্লাশি শেষ হয়েছে। তখন পকেট থেকে পিস্তল ও সাত রাউন্ড গুলি বের করে মামুন বলেন, কী চেক করলেন, আমার কাছে তো পিস্তল আছে! এরপর তিনি পিস্তল বের করেন এবং লাইসেন্সও দেখান। পরের ঘটনা আরও চমকপ্রদ। ঘটনার অল্প কিছুক্ষণ পরই সেখানে ছুটে আসেন বিমানবন্দরের এভিয়েশন সিকিউরিটির (এভসেক) পরিচালক নূরে আলম সিদ্দিকী। সে সময় এভসেক কর্তৃপক্ষ মামুনকে অফলোড করার জন্য ইউএস বাংলা এয়ার লাইন্সের পাইলটকে অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় পাইলট মামুনকে অফলোড করেনি।দৈনিক আমার সংবাদসহ দেশের সব পত্রিকায় গতকাল খবরটি প্রকাশিত হওয়ার পর সর্বত্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। একজন যাত্রী কী করে আগ্নেয়াস্ত্রসহ আর্চওয়ে দিয়ে নির্বিঘ্নে ঢুকে পড়তে পারলো- এ প্রশ্ন সবার। তাহলে কি ধরে নিতে হবে ওই আর্চওয়ে এবং স্ক্যানিং মেশিনে ত্রুটি আছে? নাকি যারা এসবের দায়িত্বে আছে তারা উপযুক্ত প্রশিক্ষিত নয়? যে নিরাপত্তা কর্মীটি মামুনের দেহ তল্লাশি করেছিল সে-ই বা কী করেছিল? অবশ্য বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলার চেষ্টা করেছেন যে, প্রথম চেকিংয়েই মামুনের অস্ত্রটি ধরা পড়েছে। নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে পুলিশে দিতে চাইলে সে কান ধরে উঠবস করে এবং মুচলেকা দিয়ে নিয়ম মেনে সিলেটে যায়। কথা হলো, প্রথম চেকিংয়েই যদি তার অস্ত্র থাকার বিষয়টি ধরা পড়ে থাকে, তাহলে অবৈধভাবে অস্ত্র বহন করে বিমানবন্দরে প্রবেশের অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করা হলো না কেন? বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্য যে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। সচেতন নাগরিকরা উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন দেশের প্রধান বিমানবন্দরের নিরাপত্তাব্যবস্থার দুরবস্থা নিয়ে। নিরাপত্তাব্যবস্থার এ লেজেগোবরে অবস্থার কথা বহির্বিশ্বে জানাজানি হওয়ার পর দেশের ভাবমূর্তি যে সংকটের মুখে পড়বে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের প্রশ্ন- বিমানবন্দরে আদৌ কোনো নিরাপত্তাব্যবস্থা আছে কিনা বা তার প্রতি বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো নজর আছে কিনা। সেখানকার নিরাপত্তা মেশিনগুলো কী সচল আছে? নিরাপত্তাকর্মীরা কী সেগুলো অপারেট করতে সক্ষম? নাকি তারাও বিজ্ঞাপনের জালাল মিয়ার মতো ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বলতে থাকেন- সাবধান, সাবধান....।