Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

৯ বছরে ১৩ মামলা!

অক্টোবর ৩, ২০২১, ০৬:১৫ পিএম


৯ বছরে ১৩ মামলা!
  • বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কার্যকরী প্রয়োগের অভাব কাটেনি
  • মামলা নেয়ার আগে যাচাই বাছাইয়ের পরামর্শ আইনজীবীদের
  • ছোটখাটো অপরাধ সালিশি পর্যায়েই শেষ করার তাগিদ আইনজ্ঞদের
  • বিরোধ নিষ্পত্তিতে আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ

বিল্লাল হোসেন ও হাজেরা আক্তার। দুজনই একে অপরের প্রতিবেশী। উভয়ের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লার আদর্শনগর এলাকায়। দীর্ঘদিন ধরে তাদের মধ্যে সড়কের জন্য দেড় ফুট জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল। ৯ বছর ধরে চলমান বিরোধের কোনো নিষ্পত্তিতে আসতে পারেনি দুই পরিবার।

এ ঘটনায় উভয়পক্ষের মধ্যে একাধিকবার মারামারির ঘটনাও ঘটেছে। মামলাও হয়েছে। জেলেও যেতে হয়েছে। ৯ বছরে একে অপরের বিরুদ্ধে আদালতে প্রায় ১৩টি মামলা করেছেন। তবে মামলা করেও কোনো সমাধান মেলেনি। একাধিকবার স্থানীয় সালিশ বৈঠকেও কাজ হয়নি।

এদিকে মামলাগুলোতে পুলিশের তৎপরতা বাড়াতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজি), জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে প্রায় শতাধিক অভিযোগ করেছেন দুইপক্ষ। তবুও বিরোধ নিষ্পত্তিতে কেউ সমাধান দিতে পারেনি। বর্তমানে তাদের মামলাগুলোও আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।

অবশেষে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির (এডিআর) মাধ্যমে দুই প্রতিবেশীর বহুকাল ধরে চলা সমস্যার মীমাংসা করা হয়। তাদের দুজনের মধ্যে বিল্লাল হোসেন এক ফুট ৬ ইঞ্চি ও হাজেরা আক্তার মুক্তা এক ফুট ৯ ইঞ্চি জমি সড়কের জন্য ছেড়ে দেবেন বলে সম্মত হন।

এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, শুধু ফতুল্লার ঘটনাই নয়, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতির কার্যকরী ব্যবহার করা গেলে দেশের আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা অর্ধেকের নিচে কমে আসবে। তারা অভিযোগ করে বলছেন, মামলাজট কমাতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পৃথক আইন থাকা সত্ত্বেও তার কার্যকরী প্রয়োগের অভাবে সুফল মিলছে না।

জানা গেছে, নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত পর্যন্ত অসংখ্য মামলা ঝুলছে। প্রতিদিন যত মামলা ফাইল হচ্ছে, সেগুলো মাসে কিংবা বছরেও নিষ্পত্তি হচ্ছে না। মামলাজট না কমার বড় কারণ হলো বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআর সম্পর্ক ধারণা না থাকা। বিভিন্ন আইনে বিকল্প পদ্ধতিতে বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলা আছে, কিন্তু এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে। ফলে মামলার ভারে জর্জরিত আদালতের কার্যতালিকায় প্রতিদিনই জমা হচ্ছে আরও নতুন নতুন মামলা। প্রতিদিনই বেড়ে চলছে মামলার সংখ্যা। আদালত বা বিচার ব্যবস্থার পক্ষে সময়মতো ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে বিচার সম্পন্ন করা দুরূহ। আপসযোগ্যে ধারার মামলাও বিচার প্রক্রিয়ায় এসে জটলা সৃষ্টি করছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীরা বলছেন, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে রুজু করা মামলাগুলো আগে আটকাতে হবে। গ্রাম্য আদালতকে আরও তৎপর করতে হবে। ছোটখাটো অপরাধ চেয়ারম্যানের মাধ্যমে সালিশি পর্যায়েই শেষ করে দিতে হবে এবং মামলা নেয়ার সময় থানা বা আদালতের উচিত প্রাথমিক একটা তদন্ত করা ও সত্যতা যাচাই করা। যাচাই-বাছাই এবং তদন্ত ছাড়া মামলা হলে এটা নকল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কেউ থানায় গেলেন আর থানা মামলা নিয়ে নিলো এমন হওয়া যাবে না, এক্ষেত্রে থানা কর্তৃপক্ষকে আরও সচেতন হতে হবে এবং অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে মামলা গ্রহণ করতে হবে। অনেক সময় সামান্য পারিবারিক দ্বন্দ্বের বিষয় মামলা পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু এসব বিরোধ পারিবারিক সালিশের মাধ্যমেই মিটিয়ে ফেলা সম্ভব।

আইনজ্ঞরা বলছেন, মামলায় দীর্ঘসূত্রতা, আর্থিক দিক এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় বিকল্পবিরোধ নিষ্পত্তি এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে পারে। তবে এর কার্যকরী ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আইন ও বিচার বিভাগকে অবশ্যই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিষয়টিকে আরও গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার পাশাপাশি সর্বত্র প্রচার ও প্রসারকল্পে এগিয়ে আসতে হবে। যাতে দেশের আপামর জনগণের মধ্যে এই পদ্ধতির বিস্তৃতি ঘটে।

অনেক ক্ষেত্রেই আইনজীবীরা বিরোধ নিষ্পত্তিতে সহায়তা করেন না বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি উৎসাহিত করতে আইন পরিবর্তন করা হলেও সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা সহযোগিতা না করার ফলে মামলার পক্ষরা এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে মামলা-মোকদ্দমার ঝামেলা পরিহার করে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুবিধা গ্রহণ করা এবং নিজেদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করতে বিচারপ্রার্থীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেছেন, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি একান্ত প্রয়োজন। এতে তাড়াতাড়ি মামলা নিষ্পত্তি হবে। সমাজে শান্তি ফিরে আসবে। মামলা ফাইল হলে এটা মীমাংসা করা যায়। পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ক্রিমিনাল মামলাও এডিআরের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা যায়। এ ব্যবস্থা না হলে বিচারব্যবস্থায় ধস নামবে। জনগণ দীর্ঘসূত্রতার কারণে বিচার পাচ্ছে না। এডিআরের ফলে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে মামলা করার প্রবণতা দূর হবে।

সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, দেশের দেওয়ানি কার্যবিধিতে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান থাকলেও তা জনপ্রিয় হয়নি। বিচারপ্রার্থীরা বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির সুফল বুঝতে পারছেন না বলেই এর সুযোগ নিচ্ছেন না, অন্যদিকে আদালত বা আইনজীবীরাও এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কিন্তু এটা বাধ্যতামূলক বা অবশ্যকরণীয় করা হলে তারা বুঝতে পারবেন যে এটা উপকারী। ফলে আদালতের ওপর থেকেও মামলার চাপ কমবে।

তিনি বলেন, মামলার জট আর আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তিতে দীর্ঘ সময় লাগার কারণে অনেক ক্ষেত্রে বিচারপ্রার্থীরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। ‘মামলার জট কমাতে এটা প্রয়োজন, আর তাই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিকে বাধ্যতামূলক করতে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা উচিত।’

সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার শিহাব উদ্দিন খান বলেন, আদালতে মামলা করার পর বিচারপ্রার্থী কিংবা তার আইনজীবী না চাইলে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তিতে যাওয়া যায় না। যে মামলাগুলো খুব জটিল নয় সেগুলোই এডিআরের আওতায় আসবে। দেখা গেছে জটিল বিষয়ে মামলার সংখ্যা খুব কম। অর্থকরী কিংবা জমি-সংক্রান্ত মামলা জটিল নয়, হত্যার মতো ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তি অবশ্য এডিআরের মাধ্যমে করা যাবে না।