Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪,

দাবি আদায়ের আশা ক্ষীণ

ডিসেম্বর ১, ২০২১, ০৭:১০ পিএম


দাবি আদায়ের আশা ক্ষীণ
  • অদ্ভুত নিয়মে অশুভ সড়ক
  • ১১ দফা দাবির বাস্তবায়ন হয়নি এখনো
  • হাফ পাস কার্যকরের প্রথম দিনেই  মিশ্র প্রতিক্রিয়া 
  • ঢাকা হলে চট্টগ্রামে কেন নয়—প্রশ্ন চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীদের 
  • সারা দেশে কার্যকর দাবিতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ  
  • মালিকপক্ষের অদ্ভুত পদ্ধতিতেই  রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে সড়ক 
  • শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ে সাড়া নেই নতুন কর্মসূচি ঘোষণা আজ

রাজধানীর বেশির ভাগ গণপরিবহনই চুক্তিভিত্তিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। এমন পদ্ধতিতে বাসমালিকরা শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণে টাকা নিয়ে থাকেন। এই টাকাকে পরিবহন শ্রমিকরা জমার টাকা বলে থাকেন। এই জমার টাকা মালিককে পরিশোধ করার পর বাকি যে টাকা থাকে তা থেকে গাড়ির খরচ বাদ দিয়ে যা থাকে তা ড্রাইভার ও হেলপার নির্দিষ্ট অনুপাতে ভাগ করে নেন। 

তাছাড়া সিটিং সার্ভিস ও ওয়েবিল পদ্ধতিতে ট্রিপ হিসাবে টাকা পান চালক-হেলপাররা। যত বেশি ট্রিপ তত বেশি টাকা— এই মানসিকতা থেকে অনেকেই বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালান। এর বাইরে ওয়েবিল স্বাক্ষরের আগে-পরে অতিরিক্ত যাত্রী পাওয়ার আশায়ও এক বাস অন্য বাসকে ওভারটেক করতে চায়। 

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন অদ্ভুত পদ্ধতিতে গণপরিবহনগুলো চলাচল করার কারণে শৃঙ্খলা আসছে না। বারবার সড়কে রক্ত ঝরছে। এ থেকে বের হয়ে চালক-হেলপারদের নির্দিষ্ট বেতন দিয়ে গাড়ি পরিচালনা করলে এমন অশুভ প্রতিযোগিতা থাকবে না। 

কিন্তু এতে মালিক-শ্রমিক দুপক্ষেরই আপত্তি রয়েছে। কেননা এ পদ্ধতিতে গেলে দুপক্ষেরই অতিরিক্ত মুনাফা অর্জনের সুযোগ কমে যাবে বলে মনে করছেন তারা। বাসমালিকদের একটি অংশ মনে করছে, এভাবে ছেড়ে দিলে শ্রমিকরা বেশি যাত্রী নিয়েও তাদের কম টাকা দেবে। সার্বক্ষণিক মনিটরিং করতে পারবে না। 

শ্রমিকের প্রতি মালিকদের এমন আস্থার সংকট নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিনের এ সংকটেই বর্তমান অশুভ সড়কে একের পর এক প্রাণহানিসহ নানা ইস্যুর সৃষ্টি হচ্ছে। সম্পতি ভাড়া বৃদ্ধির পর থেকেই একের পর এক ঘটনার জন্ম দিয়েই যাচ্ছে পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এর মধ্যে শিক্ষার্থী হত্যার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত। এছাড়া হাফ পাসের বিষয়টিও গড়িয়েছে আন্দোলনে।   

শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনের মধ্যে শুধুমাত্র ঢাকা মহনগরীতে শর্তসাপেক্ষে হাফ পাসের দাবি মেনে নেয় মালিক পক্ষ। আর সবই এখন পর্যন্ত রয়েছে আগের মতোই। এদিকে গতকাল হাফ পাস কার্যকরের প্রথম দিনেও দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। আবার প্রধানমন্ত্রীও শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন। 

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, যানবাহন ভাঙচুর করা তাদের কাজ নয়। অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রাস্তায় নেমে গাড়ি ভাঙা এটা ছাত্রদের কাজ নয়, এটা কেউ করবে না। দয়া করে যার যার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে যাও, লেখাপড়া করো। আর যারা দোষী তাদের খুঁজে বের করে অবশ্যই শাস্তি দেওয়া হবে, সেটা আমরা করবো।’ 

শিক্ষার্থীরা যে দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে তার কিছুই এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। এর মধ্যে হাফ পাস কার্যকরের প্রথম দিনে গতকাল মিরপুর-১২ থেকে ছেড়ে আসা মাওয়াগামী স্বাধীন এক্সপ্রেসে ভ্রমণ করা দুই শিক্ষার্থী জানান, তাদের কাছ থেকে পুরো ভাড়া দাবি করা হয়। কিন্তু তারা সেটি দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় কিছুটা বাকবিতণ্ডা হয়। যদিও অর্ধেক ভাড়া দেন বলে জানান তারা। নারায়ণগঞ্জ থেকে গুলিস্তানের উদ্দেশে সাত-আটজন শিক্ষার্থী ওঠেন মিরপুর-১২ গামী হিমাচল পরিবহনে। তারা জানান, হেলপার সবার পরিচয়পত্র নিশ্চিত করে অর্ধেক ভাড়া রেখেছেন। 

হিমাচল বাসের হেলপার আবদুর রহমান অভিযোগ করে বলেন, কিছু কিছু শিক্ষার্থী পরিচয়পত্র না দেখিয়ে অর্ধেক ভাড়া দিয়ে চলে যান। অর্ধেক ভাড়া নিশ্চিত করতে তিনি সব শিক্ষার্থীদের পরিচয়পত্র বহন করতে অনুরোধ করেন। তবে বাসটির চালকের সহকারী অভিযোগটি স্বীকার করে বলেন, বাসের নির্দিষ্ট চেকপয়েন্টে শিক্ষার্থীরা যদি পরিচয়পত্র প্রদর্শন করেন তাহলে এ সমস্যা হয় না। মূলত যোগাযোগের সমস্যার কারণে ছোটখাটো বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। তবে পরে তা মিটিয়ে নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। 

মালিকপক্ষের শর্তসাপেক্ষে হাফ পাস কার্যকরের ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করেছে শিক্ষার্থীরা। গতকালও ঢাকা-চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় হাফ পাসের দাবি আদায়ে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। 

চট্টগ্রামের শিক্ষার্থীরাও প্রশ্ন তুলেছে— ঢাকায় হাফ পাস হলে চট্টগ্রামে কেন নয়? দেশব্যাপী এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের দাবি করছে তারা। এদিকে হাফ পাসের দাবিতে উত্তাল অবস্থার মধ্যেই রামপুরায় এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে হত্যার ঘটনায় আরও তীব্র হয় শিক্ষার্থীদের দাবি আদায়ের আন্দোলন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল হাফ পাসের পাশাপাশি শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় বিচার ও সড়ক নিরাপদ চেয়ে রাজধানীর রামপুরায় বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। চলমান এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে দ্বিতীয় দিনের মতো এই বিক্ষোভ থেকে ১১টি দাবিও জানিয়েছে তারা। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গতকাল বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে ওই এলাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সড়কে অবস্থান নেয়। এরপর দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে দাবিগুলো তুলে ধরে তারা। 

তাদের দাবিগুলো হলো— ১. সড়কে নির্মম কাঠামোগত হত্যার শিকার নাঈম ও মাঈনুদ্দিনের হত্যার বিচার করতে হবে। তাদের পরিবারকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। গুলিস্তান ও রামপুরা ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় পথচারী পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। 

২. সারা দেশের সব গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া সরকারি প্রজ্ঞাপন দিয়ে নিশ্চিত করতে হবে। হাফ ভাড়ার জন্য কোনো সময় বা দিন নির্ধারণ করে দেয়া যাবে না। বর্ধিত বাস ভাড়া প্রত্যাহার করতে হবে। সব রুটে বিআরটিসির বাসের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।

৩. গণপরিবহনে ছাত্র-ছাত্রী এবং নারীদের জন্য অবাধ যাত্রা ও সৌজন্যমূলক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। 

৪. ফিটনেস ও লাইসেন্সবিহীন গাড়ি এবং লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।গাড়ি ও ড্রাইভিং লাইসেন্স নিয়ে বিআরটিএর দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। 

৫. সব রাস্তায় ট্রাফিক লাইট, জেব্রা ক্রসিং নিশ্চিত করাসহ জনবহুল রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়াতে হবে। ট্রাফিক পুলিশের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। 

৬. বাসগুলোর মধ্যে বেপরোয়া প্রতিযোগিতা বন্ধে এক রুটে এক বাস এবং দৈনিক আয় সব পরিবহন মালিকের মধ্যে তাদের অংশ অনুযায়ী সমানভাবে বণ্টনের নিয়ম চালু করতে হবে। 

৭. শ্রমিকদের নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র নিশ্চিত করতে হবে। চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করতে হবে। চুক্তিভিত্তিতে বাস দেয়ার বদলে টিকিট ও কাউন্টারের ভিত্তিতে গোটা পরিবহন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। শ্রমিকদের জন্য বিশ্রামাগার ও টয়লেটের ব্যবস্থা করতে হবে।

৮. গাড়ি চালকের কর্মঘণ্টা একনাগাড়ে ৬ ঘণ্টার বেশি হওয়া যাবে না। প্রতিটি বাসে দুজন চালক ও দুজন সহকারী রাখতে হবে। পর্যাপ্ত বাস টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। পরিবহন শ্রমিকদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। 

৯. যাত্রী, পরিবহন শ্রমিক ও সরকারের প্রতিনিধিদের মতামত নিয়ে সড়ক পরিবহন আইন সংস্কার করতে হবে এবং এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। ১০. ট্রাক, ময়লার গাড়িসহ অন্যান্য ভারী যানবাহন চলাচলের জন্য রাত ১২টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। 

১১. মাদকাসক্তি নিরসনে গোটা সমাজে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। চালক-সহকারীদের জন্য নিয়মিত ডোপ টেস্টের ও কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এসব দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলমান থাকবে বলে জানিয়েছেন আন্দোলনের একজন সমন্বয়কারী ক্যামব্রিয়ান স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থী সাজ্জাদ হোসেন অনি। 

তবে আজ এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর দিন সড়কে অবস্থান না নেয়ার কথা জানিয়ে তারা বলছে, আজ নিজ প্রতিষ্ঠানে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ হবে। আজ বিক্ষোভ থেকে পরবর্তী কর্মসূচি জানানোর কথা রয়েছে। কার্যত এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের একটি দাবিও আদায়ের আশ্বাস মেলেনি পরিবহন মালিকপক্ষ কিংবা সরকার পক্ষ থেকেও।