Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

‘মোমেন নাহিদ মোকাব্বির কোনাও’

আবদুর রহিম ও মুহাজিরুল ইসলাম

আবদুর রহিম ও মুহাজিরুল ইসলাম

জুন ২০, ২০২২, ১২:৩২ এএম


‘মোমেন নাহিদ মোকাব্বির কোনাও’

‘আমরা ডুবিয়া মরি যাইয়ার আমরার মন্ত্রী মোমেন সাব কিতা আইতানায়নি। আপনারা সাংবাদিক আইছইন। তাইন (মোমেন) কই’— এভাবেই কথাগুলো বলেন সিলেট সিটি ধোপাদীঘি পাড়ের স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষক আব্দুল হাই। আক্ষেপ আছে বিয়ানীবাজারের অনেক মানুষেরও। 

সেখানকার এক সমাজকর্মী রশিদুল হক বলেন, ‘আগে টিভি খুলেলে আমরার সাবেক মন্ত্রী নাহিদ সাবরে দেখতাম। গত মাসও যেবলা পানি (বন্যা) অইছিল ওই সময়ও তাইন আইলানা। ইবারও আইলানা। আমরাতো ভোট দিয়া মন্ত্রী-এমপি বানাই। তারা এখন কই।’ বুকে আগুন জ্বলছে বিশ্বনাথ এলাকার মানুষের মনেও। 

স্থানীয় ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমরার গাঁওর (গ্রামের) কত মানষে মোকাব্বির সাবরে ফোন দিয়া ফাইরানা। তাইন কই। আমরার লাগি নাও (নৌকা) পাঠাইন, খানি (খাবার) পাঠাইন। বড় বিপদও আছি।’ অজানা যন্ত্রণা হবিগঞ্জ সদরের মানুষের মধ্যেও। আইনজীবী আতিকুল্লাহ করিম বলেন, ‘টিভিত বড় বড় মাতমাতনই আমরার রেজা সাব। তাইন আমরারে লইয়া কুন্তা মাতইননা কেনে। আমরা খত কষ্টর মাঝে আছি। খালি সরকারের বিপক্ষে মাতলে অইব নি।’ 

সিলেট এলাকা প্লাবিত হওয়ার শতঘণ্টা পার হলেও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান, হবিগঞ্জ সদরের প্রভাবশালী ব্যক্তি ড. রেজা কিবরিয়াকে এখনো তাদের নিজ নিজ এলাকায় দেখা যায়নি। দু-একজন সাহায্য-সহযোগিতার কথা বললেও অনেককে ফোনেও পাওয়া যাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে ক্ষোভ ও হতাশা স্থানীয় মানুষের মধ্যে। 

গত মাসের বন্যায়ও এসব শীর্ষ ব্যক্তিদের দেখা যায়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী আসার খবরে সিলেটের মানুষের মধ্যে আশা জেগেছে। যে সব রাজনীতিবিদ নদী দখল করে স্থাপনা তৈরি করেছে, আবাসন তৈরি করেছে, পানিপথ রুদ্ধ করে রেখেছে— এগুলো প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে উদ্ধার হবে। বরাদ্দ হওয়া হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের বিষয়েও তদন্ত হবে। প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে স্থায়ী সমাধান হবে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চার দিন পর গতকাল সকালে সিলেটের বুকে সূর্য দেখা গেছে। তবে সিলেট শহরের সাথে সড়কপথে শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। পাঁচ দিন থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন, নাই মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কও। মলমূত্র ত্যাগের পানিতেই পানি পান ও রান্নাবান্না হচ্ছে। ক্ষুধার জ্বালা সইছে না কোম্পানিগঞ্জের মানুষের। আশ্রয় ক্যাম্পে পশুদের সাথে গাদাগাদি করে থাকতে হচ্ছে। নৌকার অভাবে এখনো দুর্গম এলাকা থেকে লোকজন উদ্ধার করা যায়নি। সব মিলিয়ে এক বিপর্যস্ত নগরীতে পরিণত হয়েছে সিলেট। ইতোমধ্যে  প্রায় এক হাজার মানুষকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করেছে। এখনো অভিযান চলছে। তবে থেমেছে ভারী বৃষ্টি। কমতে শুরু করেছে নদ-নদীর পানি। উজানের ঢলের কারণে জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত আছে। নগরের কিছু জায়গায় পানি দ্রুত কমলেও নিচু জায়গা থেকে ধীরগতিতে নামছে বানের পানি। কোথাও কোথাও পরিস্থিতি এখনো অপরিবর্তিত আছে। 

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতে, সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারাসহ সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি এখনো অব্যাহত আছে। পানিবন্দি মানুষের খোঁজখবর নিতে আগামীকাল মঙ্গলবার সিলেট আসছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

মলমূত্র ত্যাগের পানি পান ও রান্নাবান্না : বানভাসি মানুষ জানিয়েছে, কোনোমতে মাথাগোঁজার ঠাঁই পেলেও তারা খাদ্য সংকটে ভুগছেন। আশ্রয় সেন্টারগুলোয় বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। আছে শৌচাগারের সংকটও। ফলে অনেকেই বন্যার পানিতে মলমূত্র ত্যাগ করছে আবার সেই পানি পান ও রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার করছেন। এতে ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। বানভাসিরা বলেন, তারা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে আছেন। দ্রুত এসব তাদের কাছে না পৌঁছালে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হবে। সরেজমিন সদরের বাদাঘাট মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে অবস্থিত শেল্টার সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, এখানে আশপাশ এলাকা থেকে আসা প্রায় সাড়ে তিনশ মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তারা জানান, তাদের এখানে খাবারের তেমন সংকট নেই। তবে বিশুদ্ধ পানি ও শৌচাগারের সংকট রয়েছে। ফলে বাধ্য হয়েই তারা বন্যার পানি করছেন। তাদেরই একজন সদরের লামারগাঁও এলাকার বাসিন্দা গৃহবধূ পান্না বেগম আমার সংবাদকে জানান, বন্যায় তাদের বাড়িঘর তলিয়ে গেছে। আশ্রয় নিতে ২০ দিনের শিশুপুত্র সাকিবকে নিয়ে এখানে এসেছেন। পাঁচদিন ধরে তিনি এখানে আছেন। খাবারের তেমন সংকট না থাকলেও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট এখানে। ঘরবাড়ি হারিয়ে  সপরিবারে এখানে এসেছেন নলকট এলাকার যুবক লুৎফর রহমান। তিনি জানান, তিনদিন ধরে এখানে আছি, এখনো পর্যন্ত কেউ বিশুদ্ধ পানি দেয়নি। বাধ্য হয়ে বন্যার পানি পান করছি।

নৌকা সংকটে খাদ্য পৌঁছানো যাচ্ছে না : পর্যাপ্ত ত্রাণ মজুত থাকলেও নৌকা সংকটের কারণে দুর্গত এলাকায় ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মজিবর রহমান। তিনি বলেন, শনিবার বিকেল পর্যন্ত বন্যার পানিতে আটকেপড়া সিলেটের প্রায় এক হাজার মানুষকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা উদ্ধার করে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে এসেছেন। এ ছাড়া বন্যাকবলিত এলাকায় সরকার পর্যাপ্ত ত্রাণ বরাদ্দ দিয়েছে। নতুন করে সিলেটের জন্য আরও ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ এসেছে। তবে সমস্যা হচ্ছে, নৌকা সংকটে সব জায়গায় ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না। তবে স্থানীয় প্রশাসন এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আন্তরিকভাবে চেষ্টা করছে। এদিকে বন্যাকবলিত এলাকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও সেনাবাহিনীর উদ্ধার তৎপরতা দেখতে রোববার সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ সিলেটে এসেছেন বলে জানান ডিসি।

উঁচু এলাকা থেকে পানি নামছে : গতকাল সকালে নগরের কয়েকটি এলাকায় গেলে দেখা যায়, নগরের কিছু উঁচু এলাকা থেকে পানি নেমেছে। তবে নিচু এলাকা এখনো প্লাবিত আছে। সেখানে কোমর থেকে গলা সমান পানি আছে। বিশেষ করে নগরের উপশহরের অবস্থা খুবই নাজুক। এ এলাকার অধিকাংশ স্থানে বুক থেকে গলা সমান পানি। এ ছাড়া কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, দক্ষিণ সুরমা, সিলেট সদর, বিশ্বনাথসহ বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকায় এখনো বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। পাউবো সিলেট কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, সিলেটের সুরমা, কুশিয়ারা, লোভা, সারি, ধলাইসহ সবকটি নদ-নদীর পানি আরও বেড়েছে। সুরমা ও কুশিয়ারার তিনটি পয়েন্টে এখনো পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

৯৬ ঘণ্টা বৃষ্টির রেকর্ড : সিলেটের আবহাওয়া অফিস জানায়, গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে সিলেটে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। সে হিসাবে রোববার সকাল পর্যন্ত টানা ৯৬ ঘণ্টা বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। চলতি বছর জুন মাসের ১৮ তারিখ পর্যন্ত এক হাজার ২২৪ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এর আগে ২০০৬ সালে জুন মাসে এক হাজার ২৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। তবে চলতি বছর জুন মাসজুড়ে সিলেটে আরও বৃষ্টিপাত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বিগত বছরগুলোর জুন মাসের রেকর্ড ছাড়িয়ে যেতে পারে। সিলেট আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, সিলেট অঞ্চলে গত ২৪ ঘণ্টায় ৩০৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটি ওই অঞ্চলের আবহাওয়ার ইতিহাসে তৃতীয় সর্বোচ্চ। এর আগে সিলেটে ২০০০ সালের ১২ জুন ৩৬২ দশমিক ৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৃষ্টি হয়েছে ১৯৫৮ সালের ১৯ জুন ৩৩৬ মিলিমিটার।

২৫০ বছরের ঐতিহ্যের টিলা ধসে পড়ল : সিলেটে চলছে টানা বর্ষণ ও প্রলয়ঙ্করী বন্যা। চারদিকে পানির ভয়াল গ্রাস। মহাবিপর্যয়ে জনপদ। মানুষের সর্বস্ব কেড়ে নেয়া বানের সাথে ঘটছে টিলা ধস। চলতি মহাদুর্যোগের ভয়াল থাবা এবার পড়েছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপরূপ লীলাভূমি সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মুরারিচাঁদ কলেজে (এমসি কলেজ)। টানা বর্ষণে ধসে পড়েছে মুরারিচাঁদ কলেজের বাংলো সংলগ্ন টিলা। ২৫০ বছর আগে ১৭৭২ সালে এখানে ডিস্ট্রিক্ট কালেক্টর উইলিয়াম মেইকপেস থেকারের অফিস ছিল। ১৯২১ সালে এটি তৈরি হয়েছিল। শনিবার দুপুর থেকে প্রিন্সিপালের শতবর্ষী বাংলোর টিলার ধস শুরু হয়।  প্রায় ১০০ ফুট টিলা ভেঙে গাছপালাসহ নিচে চলে গেছে। ধসের ফলে বাংলোর উত্তরদিকে প্রায় ২০-২৫টি গাছ উপড়ে মাটিসহ নিচে চলে গেছে। ধস ঠেকাতে বাংলোতে কলেজের কর্মচারীরা বড় বড় বাঁশ এনে বেড়া দিয়ে চেষ্টা চালায়। সরেজমিন দেখা যায়, অধ্যক্ষ বাংলো সংলগ্ন এ টিলাটি প্রায় ১০০ ফুট নিচে গাছপালাসহ ধসে পড়েছে। এতে পুরো বাংলোটি অরক্ষিত হয়ে পড়লে কলেজ কর্মচারীরা ওই অংশে বেশ কয়েকটি বাঁশের বেড়া দিয়ে রক্ষা করার চেষ্টা চালান। তাতেও কোনো কাজ হয়নি। গতকাল এমসি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো. সালেহ আহমদ জানান, শুক্রবার বেলা পৌনে ১টার দিকে তিনি টিলা ধসের ঘটনা শুনতে পান। সেদিনই  ধস ঠেকাতে বাংলোর টিলায় কলেজের কর্মচারীরা ৪০টি বড় বড় বাঁশ এনে বেড়া দেন। কিন্তু এটি স্থায়ী কোনো সমাধান নয়। গতকাল এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সিভিল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. মোস্তাক আহমদ ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী নজরুল হাকিমসহ অন্যান্যরাও এ টিলা পরিদর্শন করেন। তারা বলেছেন, এই বাংলো রক্ষায় শক্ত পাইলিংসহ আরও নানা ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। এটি শুধু সিলেট নয়, পুরো দেশের একটি ঐতিহ্য হিসেবে চিহ্নিত। ইতোমধ্যে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোকে অবহিত করা হয়েছে। 

Link copied!