Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

ফারইস্টে অভিযুক্তরা প্রাইমের কাণ্ডারি

জাহিদুল ইসলাম

জুন ২১, ২০২২, ০১:২৪ এএম


ফারইস্টে অভিযুক্তরা প্রাইমের কাণ্ডারি

কৃত্রিমভাবে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ, কর ফাঁকি এবং অতিরিক্ত কমিশনে ব্যবসা করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ উঠেছে পুঁজিবাজারভুক্ত প্রাইম ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদের বিরুদ্ধে। এমনকি ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্সে অনিয়মের ঘটনায় জড়িতদের অধিকাংশই স্থান পেয়েছেন এই প্রতিষ্ঠানে। 

ফলে সাধারণ বিমা খাতের কোম্পানিটিকেও ফারইস্ট ইসলামী লাইফের ভাগ্য বরণ করতে হতে পারে বলে শঙ্কা জানিয়েছেন বিমা-সংশ্লিষ্টরা। বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে আরেকটি বিপর্যয় সামলানোর সক্ষমতা নেই বিমা খাতের। ফলে এখনই অর্থ মন্ত্রণালয় ও আইডিআরএসহ সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। 

প্রতিষ্ঠানটির নির্ভরযোগ্য এক সূত্রে জানা যায়, আইডিআরএর নির্ধারিত কমিশনের চেয়ে বেশি অর্থ দিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির ব্যবসা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স। বর্তমানে নন-লাইফ খাতে এ প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি কমিশন দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

নন-লাইফের কয়েকজন সিইও জানান, তাদের ব্যবসা অধিক কমিশনে প্রাইম ইন্স্যুরেন্স নিয়ে গেছে। মূলত চলতি দায়িত্বে থাকা দুই সিইওর (সুজিত কুমার ও  আবদুল্লাহ আল মামুন) সময়কালে এ অনিয়ম চালু হয়েছে। যে কারণে বিমা খাতে ফের অনৈতিক প্রতিযোগিতা শুরু হতে পারে। এই অতিরিক্ত কমিশন দিতে জালিয়াতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে। সাজানো কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেখিয়ে তাদের বেতন-ভাতা বাবদ প্রতি মাসে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে। 

প্রায় সাত শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এভাবে কাগজে-কলমে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। এ কারণে গত বছরের জুলাই মাসে যেখানে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও অন্যান্য ব্যয় বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় ৬২ লাখ টাকা, সেখানে চলতি বছরের সর্বশেষ তথ্যমতে এই ব্যয় দেখানো হয়েছে তিন কোটি টাকারও বেশি। এভাবে প্রতি মাসেই বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে কোম্পানির অসাধু চক্রটি। 

শুধু অসাধু নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অর্থ আত্মসাৎই নয়, দাবি পরিশোধের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগও পাওয়া গেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। সাধারণ বিমা কর্পোরেশন থেকে বিমা দাবি আদায়ে ঘুষ প্রদানে গ্রাহক থেকেই ৩০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে জানা গেছে। 

পাবনার এমএম জুট মিলের কাছ থেকে এই অর্থ নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী দুই ভাই সাহাবুদ্দিন মল্লিক ও সামিউদ্দিন মল্লিক। অবশ্য এটি দুই মাস আগের ঘটনা হলেও সর্বশেষ তথ্যমতে গত বৃহস্পতিবার ওই গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। আবার দাবি প্রদানের ক্ষেত্রে গ্রাহকের কাছ থেকে সেটিসফেকশন নোট এবং লস ভাউচার পাওয়ার পরও দাবি পরিশোধ না করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রায় আট মাস ধরে গ্রাহকের ৫৫ হাজার টাকা দাবি ঝুলে রয়েছে। 

এসব ছাড়া মিথ্যা তথ্য দিয়ে তহবিলের অর্থ আত্মসাৎ, কর ফাঁকি, অনৈতিকভাবে পলিসি কাভার নোট বাতিল, বাতিলকৃত কাভারনোটের বিপরীতে প্রাপ্ত অর্থ হাতিয়ে নেয়া, অবৈধভাবে আইওইউ স্লিপের মাধ্যমে প্রতিবার কয়েক লাখ টাকা উত্তোলন, স্ল্লপের মাধ্যমে উত্তোলিত অর্থ পরবর্তীতে সমন্বয় না করা এবং স্বজনপ্রীতিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ভেতরে কাজ করা কারসাজিচক্রের বিরুদ্ধে। মূলত ফারইস্ট লাইফের অনিয়মে জড়িত কারসাজিচক্রের সদস্যরা প্রাইম ইন্স্যুরেন্সে নতুন আস্তানা গেড়ে এই অপকর্মগুলো ঘটাচ্ছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। 

সূত্রের দেয়া তথ্যমতে, ফারইস্ট লাইফে অনিয়মের মূল হোতা সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম, প্রাইম ইন্স্যুরেন্সেরও পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান তিনি। বিভিন্ন কারসাজির মাধ্যমে তিনি যেভাবে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, একই কাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছেন প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের ক্ষেত্রেও। এজন্য ফারইস্ট লাইফ থেকে চাকরি হারানো কর্মকর্তাদের পুনরায় প্রাইম ইন্স্যুরেন্সের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিচ্ছেন। 

 এদের মধ্যে রয়েছেনু কোম্পানি সেক্রেটারি মাহমুদুল ইসলাম, অডিট ও ইন্টারনাল কন্ট্রোল বিভাগের প্রধান কামাল হোসেন হাওলাদার এবং আইডিআরএর পদত্যাগকারী চেয়ারম্যান ড. এম মোশাররফ হোসেনের বোন ও মানবসম্পদ প্রশাসন বিভাগের প্রধান ফারহানা ইয়াসমিন। এছাড়া উপদেষ্টা হিসেবে এক্সপ্রেস ইন্স্যুরেন্সের সাবেক সিইও সাইদুর রহমানকে কোম্পানিতে নিয়োগ দেয়া হলেও এখনও নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন পাননি তিনি। ফলে কোম্পানি থেকে নেয়া তার বেতন-ভাতাও আইন অনুসারে অবৈধ হিসেবে গণ্য হবে। 

প্রতিষ্ঠানটির এসব অনিয়ম সম্পর্কে আইডিআরএ অবগত থাকলেও সংস্থাটির সাবেক চেয়ারম্যানের সাথে নজরুল ইসলামের গভীর সখ্য থাকায় এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। শুধু প্রাইম ইন্স্যুরেন্সই নয়, বিমা খাতের বিভিন্ন কোম্পানির বিষয়ে এমন অনিয়মের অভিযোগ থাকলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা থেকে তেমন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। ফলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বিমা খাত ধ্বংসে ড. মোশাররফ হোসেনের সময়কালকে ‘বিমার কালো অধ্যায়’ বলে অভিহিত করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

এদিকে বিমা খাতের সুশাসন ও শৃঙ্খলা ফেরাতে আইডিআরএর নতুন নেতৃত্বের কাছে প্রত্যাশা বেড়েছে খাত-সংশ্লিষ্টদের। ফলে আইডিআরএর নতুন নেতৃত্বকে এই অনিয়ম দূর করতে কয়েকটি পরামর্শ রয়েছে তাদের। এর মধ্যে রয়েছে, চলতি দায়িত্ব পালনকারী দুই সিইওর (সুজিত কুমার ভৌমিক ও আব্দুল্লাহ আল মামুন) সময়কালকে নিবিড় নিরীক্ষা করে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা এবং গত বছরের জুন থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটিতে আইডিআরএর বিশেষ নিরীক্ষা পরিচালনা করা। 

এর মধ্যে অডিটে যেসব বিষয়ে বিশেষ নজর দিতে হবে, সেগুলো হলো- ১) আইনবহির্ভূত কমিশন, ২) এক বছরের সব নিয়োগের পর্যবেক্ষণ, নিয়োগকৃতদের শিক্ষা-অভিজ্ঞতা যাচাই-বাছাই, নিয়োগে রিক্রুটমেন্ট পলিসির কতটুকু পরিপালন, এনআরসি কমিটির অনুমোদন, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর ইত্যাদি। 

এছাড়া বেআইনিভাবে আইওইউ স্লিপের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা লোন রয়েছে, অথচ বোর্ডের নির্দেশনা রয়েছে এক স্লিপে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নিতে পারবে এবং পূর্বে লোন নেয়া থাকলে প্রথমে সেটা সমন্বয় করতে হবে। রি-ইন্স্যুরেন্স যথাযথ হয়েছে কি না, নেট রেটের ব্যবসায় কমিশন বিল দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা উত্তোলন— এজেন্ট এসব জানে না কারা নিয়েছে। বিগত এক বছরে ১৫ কোটি টাকা বাকি, এ নিয়ে চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামও অসন্তুষ্ট হয়েছেন ব্যবস্থাপনা পর্ষদের ওপর। 

এসব বিষয়ে জানতে কোম্পানির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) সুজিত কুমার ভৌমিকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, আমার মাধ্যমে কোনো গ্রাহক তৈরি হলে আমি যেখানে যাব, তিনিও সুবিধা পেলে সেখানে যাবেন। এখানে অনৈতিক কিছু নেই। কিন্তু এক কোম্পানি থেকে আরেক কোম্পানিতে গ্রাহক চলে যাওয়ার এই প্রবণতা তৈরি হলে তা বিমা খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করবে কি না— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখন তো প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। যে লোক অন্য কোম্পানি থেকে আমার এখানে জয়েন করবেন, তিন ব্যবসা না দিতে পারলে তো আমি রাখব না। আমরা কমিশন বেশি দিচ্ছি এটা ঠিক নয়।

কয়েক মাসের ব্যবধানে তিন কোটি টাকারও বেশি বেতন প্রদানের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের ব্রাঞ্চের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ বেড়েছে। আমাদের ব্যবসাও দ্বিগুণ হয়েছে। তাই বেতন বৃদ্ধি পাওয়াই স্বাভাবিক। তবে বিমা বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিগুণ ব্যবসা করতে গিয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেতন বৃদ্ধি পাওয়া স্বাভাবিক নয়। 

ফারইস্ট লাইফে অনিয়মের ঘটনায় চাকরিচ্যুতদের প্রাইম ইন্স্যুরেন্সে পদায়ন করা হচ্ছে— এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি এর কোনো উত্তর দেননি। আবার উপদেষ্টা হিসেবে কেএম সাইদুর রহমানের নিয়োগ অনুমোদন প্রশ্নে জানান, তিনি আমাদের কনসালটেন্ট। এ ক্ষেত্রে অনুমোদন লাগে না।

Link copied!