Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২৪,

বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিতে বস্তিবাসী

রায়হান উদ্দিন তন্ময়

জুলাই ১, ২০২২, ০২:১৪ এএম


বর্জ্য অব্যবস্থাপনায় ঝুঁকিতে বস্তিবাসী

রাজধানীর বস্তিগুলোতে নেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। নিজ উদ্যোগে পৌঁছে দিতে হচ্ছে গৃহস্থালির ময়লা। বস্তিতেই থেকে যাচ্ছে অনেক আবর্জনা। সেগুলো আবার নানা স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছে। এমন অব্যবস্থাপনায় স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন বস্তির বাসিন্দারা। 

পাশাপাশি পানি ও বায়ুবাহিত রোগসহ নানা জটিল রোগেও আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। এসব রোগ-জীবাণু শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা নগরবাসীর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে পানি ও বায়ু দূষিত হবে। দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি ক্ষতিকারক গ্যাসও তৈরি হবে। ফলে শারীরিক ও মানসিক সমস্যাসহ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকবেন বস্তি ও শহরের বাসিন্দারা। 

কড়াইল, চলন্তিকা, বাসানটেক, তেজগাঁওয়ের বেগুনবাড়িসহ রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সবচাইতে বড় বস্তিগুলোর একটি কড়াইল বস্তি। প্রবেশ পথগুলো সরু ও অলিগলির সংখ্যা হিসেবের বাইরে। একটি চৌকি বসলেই একটি ঘর। 

গোসলখানা, টয়লেট, খুপরি ঘরগুলো নোংরা ও অপরিষ্কার। সব জায়গায় জমে আছে ময়লা আবর্জনা। সবগুলো বস্তির চেহারা একই রকম। পোশাককর্মী, গৃহকর্মী, দিনমজুর, রিকশাচালক, খুচরা ব্যবসায়ী ও নিম্ন আয়ের লোকেরা এসব বস্তিতে বসবাস করেন। 

তারা জানান, নিজ উদ্যোগেই ময়লা দিয়ে আসতে হয়। মাঝে মাঝে তারা ময়লা নিতেও চায় না। ফলে বস্তিতেই ময়লা থেকে যাচ্ছে। ময়লা থেকে বস্তির পরিবেশও খারাপ হয়ে যায়। এসব থেকে বাচ্চাদের ক্রিমির সমস্যা দেখা দেয়। পাশাপাশি বেশিরভাগ বস্তিবাসীর চর্মরোগসহ নানা রোগ-শোকে ভুগতে হয়। তবে মশা নিরোধ স্প্রে করা হয় নিয়মিত।  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে কড়াইলসহ রাজধানীর বিভিন্ন বস্তি এলাকায় স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। ওই এলাকার লোকজন, ডায়রিয়া, জ্বর, সর্দি, মাথাব্যথা, চর্মরোগ, ইউরিন ইনফেকশন, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্যান্সার, জন্ডিস, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড রোগের মতো বিপজ্জনক রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। 

পরে এই রোগ গুলশান, বনানী, বারিধারাসহ শহরের নানা স্থানে ছড়িয়ে পড়ছে। ময়লার কারণে বাতাসে দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং ক্ষতিকারক গ্যাস তৈরি হয়। ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকির মধ্যে থাকে। বর্জ্য অব্যবস্থাপনার ফলে বস্তির ৩৪ শতাংশ মানুষ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। 

গবেষণায় বস্তির ২৭ শতাংশ মানুষ ময়লা পানির জন্য এবং ১৯ শতাংশ জলাবদ্ধতার কারণে নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। তাই টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে হবে। গত ২৩ জুন রাজধানীতে ডিএসকে কনসোর্টিয়াম আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন তারা। 

টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় একযোগে স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করতে পারে। প্রতিটি মন্ত্রণালয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যঝুঁকি নিরসনে কাজ করতে পারে। বস্তি এলাকাগুলোতে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহসহ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিতে পারে। 

পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিদ্যমান আইনগুলোতে জনস্বাস্থ্য অনুপস্থিত। তা শুধু বন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রাখা হয়েছে। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে এই দায়িত্বের আওতায় আনতে হবে। 

কড়াইল বস্তি উন্নয়ন কমিটির সভাপতি মাহমুদুল হাসান বলেন, ‘আমরা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ময়লা সংগ্রহ করি। ভ্যান সংকটে সব ময়লা সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। অনেক সময় ময়লা সংগ্রহ করার পর সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য স্থানান্তর কেন্দ্রে (এসটিএস) দিলে, তারা নিতে চায় না। এতে বস্তির পরিবেশ খারাপ হয়ে যায়। দুর্গন্ধ ও রোগ-শোক ছড়ায়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ ইকোনমিক্সের পরিচালক অধ্যাপক শারমিন মবিন ভূঁইয়া দৈনিক আমার সংবাদকে বলেন, ‘বর্জ্যের অব্যবস্থাপনার কারণে বস্তির বাসিন্দারা নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। বিশেষ করে শিশুরা কৃমিতে বেশি আক্রান্ত হতে পারে। ময়লার কারণে পরিবেশ যেমন খারাপ হয় তেমনি শরীরও খারাপ হতে পারে। তাই দুই সিটি কর্পোরেশনকে সেখান বর্জ্য সরানোর বিষয়ে সঠিক ব্যবস্থা নিতে হবে।’

আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করা যাবে না, পাশাপাশি যতদিন তাদের জন্য বিকল্প না ব্যবস্থা হয় ততদিন তারা সেখানে থাকতে পারবেন এ মর্মে ২০১৬ সালে হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। সে মোতাবেক বস্তির বাসিন্দারা দুই সিটি কর্পোরেশনের সব সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। 

অতএব বস্তির বর্জ্য অপসারণসহ পানির ব্যবস্থা করতে হবে। যদিও কয়েকটি বস্তিতে ওয়াসা পানি সরবরাহ করছে এটা একটা গুড প্র্যাকটিস। তবে বেশিরভাগ বস্তির ময়লা আবর্জনা সরানো হচ্ছে না। ফলে সেখানকার বাসিন্দারা নানান রোগে ভুগতেছেন। 

পাশাপাশি সেসব রোগও অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে। সর্বোপরি বস্তির ব্যাপারে সচেষ্ট সিটি কর্পোরেশনকে আন্তরিক হতে হবে।’ 

নগরপরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘দুই সিটি কর্পোরেশনরই বস্তি উন্নয়নের নামে আলাদা স্থায়ী কমিটি রয়েছে। ১১টি স্থায়ী কমিটির অধীনে তারা সব কাজ সম্পন্ন করে। এ কমিটিগুলো সাংবিধানিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী। 

আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নামে আলাদা কমিটি রয়েছে। তারা সমন্বয় করে বস্তিবাসীর জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নেয়ার মানে হচ্ছে শহরবাসীর অর্থাৎ সবাইকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেয়ার উপক্রম। 

কারণ বস্তিবাসীর যদি  ডেঙ্গু, ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগ হয় তাহলে শহরের কেউই তা থেকে বাঁচবে না। এ বস্তিতে যারা বাস করেন তারা আমাদের ড্রাইভার, কাজের লোকসহ অন্যান্য কর্মক্ষেত্রেও নিয়োজিত রয়েছে। ফলে তারা এই শহরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বাসিন্দা।

তাই বস্তির বর্জ্য, পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনাকে এড়িয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে সবাইকে নিয়ে যে অন্তর্ভুক্তিমূলক  ব্যবস্থাপনা রয়েছে তাতে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। তাই এসব বিষয়ে বস্তিবাসীকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। কারণ এখানে অনেক মানুষ অল্প জায়গায় থাকে। কাজেই তাদের এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।’ 

এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সমাজ কল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন-উল-হাসান বলেন, ‘আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না। আমাদের যেকোনো বক্তব্য জনসংযোগ কর্মকর্তার মাধ্যমে দেয়া হবে।’

Link copied!