Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪,

বর্ষায় চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু

মাহমুদুল হাসান

জুলাই ২৮, ২০২২, ০১:১৮ এএম


বর্ষায় চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু

মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে এখন থেকে বাড়বে বৃষ্টিপাত। বাসা বাড়ির আঙিনায়, আনাচে-কানাচে জমে থাকবে বৃষ্টির পানি। সচেতনতা, অসতর্কতা আর সিটি কর্পোরেশনের অব্যবস্থাপনায় জন্ম নিচ্ছে এডিস মশার লার্ভা। ফলে তৈরি হচ্ছে ডেঙ্গুর বড় ঝুঁকি।

গত ছয় মাসে যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে তার চেয়ে বেশি রোগী চলতি মাসের ২৭ দিনে ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। জুলাইয়ে গত ২৭ দিনে এক হাজার ২৭৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। অথচ জুনে ৭৩৭ জন, মে মাসে ১৬৩, এপ্রিলে ২৩, মার্চে ২০, ফেব্রুয়ারিতে ২০ এবং জানুয়ারিতে আরও ১২৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছে।

বছরের প্রায় সাত মাসে মৃত আটজনের সাতজনই মারা গেছে জুলাইয়ে। গত মঙ্গলবার মারা গেছে একজন, তার আগের দিন মারা গেছে আরও একজন। এভাবেই বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। যদিও ২০১৯ সালের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি  হয়নি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের বলছে, আগামী মাসে বাড়বে বৃষ্টি। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপে হাসপাতালে রোগী ভর্তি ও মৃত আরও বাড়বে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গতকাল বুধবার রাজধানীসহ সারা দেশে আরও ৬১ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

এর আগেরদিন দেশে ৯৯ জন রোগী ভর্তি হয়েছিল এবং একজনের মৃত্যুও হয়েছিল। গতকাল বুধবার ভর্তিকৃতদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৫৮ জন এবং ঢাকার বাইরের হাসপাতালে তিনজন। এতে জানানো হয়, বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট ৩১১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছেন।

তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ২৩৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৭৩ জন। চলতি বছরের পয়লা জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আটজনের মৃত্যু হয়েছে। একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সর্বমোট দুই হাজার ৩৬৬ জন। তার মধ্যে ঢাকার দুই হাজার ৯জন।

দেশের অন্যান্য জেলার ৩৫৭ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে দুই হাজার ৪৭ জন। তার মধ্যে ঢাকার সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছে এক হাজার ৭৬৮ জন। ঢাকার বাইরের আরও ২৭৯ জন। মাসের হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০, এপ্রিলে ২৩, মে মাসে ১৬৩, জুনে ৭৩৭ এবং জুলাই মাসের গত ২৭ দিনে সর্বোচ্চ এক হাজার ২৭৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মৃত আটজনের মধ্যে চলতি মাসেই সাত জনের মৃত্যু হয়েছে।

অপর একজন গত মাসে মারা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ বলেন, এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র যদি সমূলে ধ্বংস না করা যায়। তাহলে শুধু রোগীর চিকিৎসা করে ডেঙ্গু মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। আমাদের সিটির কাউন্সিলররা কোনোদিন বাড়ির মালিক কিংবা ভাড়াটিয়াদের ডাকেই না। জনগণকে সম্পৃক্ত না করে অল্প কর্মী দিয়ে ডেঙ্গুর মতো মনুষ্যসৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না। সেই সাথে দুই সিটিতে রোগতত্ত্ববিদের সংখ্যাও বাড়াতে হবে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক মৌসুম এডিস সার্ভে-২০২২ শীর্ষক জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে প্লাস্টিক ড্রামে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, সেখানে ২০২২ সালে মৌসুমপূর্ব জরিপে লার্ভার পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে জলমগ্ন ফ্লোরে লার্ভা ছিল ২০ শতাংশ, এখন সেটি ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। প্লাস্টিক বালতিতে ছিল ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, চলতি বছর তা ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ।

পানির ট্যাংকে ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, এ বছর ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ। যা ২০১৯ সালের চেয়েও ভয়াবহতা ছড়াতে পারে। রাজধানীর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৮, ৪০, ৪৫ নম্বর ওয়ার্ড এবং উত্তর সিটির (ডিএসসিসি) ২০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ড বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ডিএনসিসির ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ব্রুটো ইনডেক্স (মশার ঘনত্ব) ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ৩৮ ও ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ শতাংশ। এসব এলাকায় পরিত্যক্ত কনটেইনারে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

এছাড়া জলমগ্ন মেঝে ও প্লাস্টিক কনটেইনারে বেশি মাত্রায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ডিএসসিসির ২০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে এডিস মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। এই দুটি এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ।

এসব এলাকায় পরিত্যক্ত কনটেইনার, প্লাস্টিক ড্রামে এডিস মশার লার্ভা সবচেয়ে বেশি ২৩ দশমিক ১৯ শতাংশ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া জলমগ্ন মেঝেতে ২১ দশমিক ৭৪ শতাংশ লার্ভা পাওয়া গেছে।

জরিপের জন্য ২১টি দল নির্বাচন করা হয়। সবগুলো দল ১০ দিনে ঢাকার দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডের ১১০টি সাইটে তিন হাজার ১৫০টি বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। এদের মধ্যে উত্তর সিটির ৬৩টি এবং দক্ষিণ সিটির ৯৬টি বাড়িতে এডিস মশা অতিরিক্ত মাত্রায় চিহ্নিত হয়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। ২০০০ সালে সর্বপ্রথম দেশে ডেঙ্গুজ্বর দেখা দেয়। সে বছর ৯৩ জন মারা যান। তিন বছর পর মৃত্যুর সংখ্যা ধীরে ধীরে প্রায় শূন্যে নেমে আসে।

তবে ২০১৮ সালে ডেঙ্গু আবার ফিরে আসে। সে বছর জ্বরটিতে ২৬ জন মারা যায় এবং ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হন। ২০১৮-এর আগে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০০২ সালে। সে বছর সারা দেশে ছয় হাজার ২৩২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন।

গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত ২০১৯ সালে। সেই বছর রাজধানীসহ সারা দেশে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। সরকারি হিসেবে মারা গিয়েছিল ১৭৯ জন। বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরো কয়েকগুণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ছিল ৩৩ জন। ২০১৭ সালে তা বেড়ে গিয়ে হয় ১৮৬ জন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫২ জন।

Link copied!