Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

উপেক্ষিত লোডশেডিং নির্দেশনা

মহিউদ্দিন রাব্বানি

আগস্ট ৫, ২০২২, ০৬:৪৪ এএম


উপেক্ষিত লোডশেডিং নির্দেশনা

জ্বালানি সংকটের ফলে লোডশেডিংয়ের কবলে পুড়ছে গোটা দেশ। চলমান জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রতা সাধনে কঠোর সিদ্ধান্তের কথা জানায় সরকার। সে হিসাবে দেশব্যাপী এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু কোনো স্তরে মানা হচ্ছে না লোডশেডিংয়ের শিডিউল।

এক ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে কথা থাকলেও দেশের কোথাও হচ্ছে না এক ঘণ্টার লোডশেডিং। আট থেকে ১০ ঘণ্টার টানা লোডশেডিংয়ের অভিযোগও উঠেছে খোদ রাজধানীতে। শহর, উপশহর কিংবা গ্রাম পর্যায়ে ১৫-১৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের খবর পাওয়া যায়। এমনিতেই প্রচণ্ড গরমে জনগণের ত্রাহিত্রাহি অবস্থা তার ওপর মারাত্মক লোডশেডিং। এ যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।  

১৫ দিনের অধিক সময় ধরে চলতে থাকা লোডশেডিংয়ের শেষ কোথায় জানে না কেউ। বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী প্রথমে এক সপ্তাহ লোডশেডিং ঘোষণা দেন। সপ্তাহ শেষে আবারও ১০ দিন সময় চেয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন তিনি। কত দিনে চলমান সংকটের সমাধান হবে এ ব্যাপারে স্পষ্ট কেউ বলতে পারেনি। এদিকে বর্ষা মৌসুমেও তেমন বৃষ্টি হচ্ছে না। তাই বলা যায় বিদ্যুৎ বিভাগ এখন তাকিয়ে আছে শীত মৌসুমের দিকে।

এদিকে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন জানান, অক্টোবর নাগাদ একটা সমাধানে আসবে জ্বালানি খাত। অর্থাৎ অক্টোবরের মধ্যে আমাদের দেশের আবহাওয়া পরিবর্তন হয়ে শীত আসতে শুরু করবে।

তিনি বলেন, পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে বলে আমরা মনে করি না। এবার শ্রাবণে তেমন বৃষ্টি হয়নি। তাই তাপমাত্রা বেশি। কিন্তু অক্টোবর থেকে আবার ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করবে। তখন বিদ্যুতের চাহিদা কমবে। লোডশেডিংয়েরও প্রয়োজন হবে না। ফলে বিদ্যুৎ চাহিদা কমে আসবে অনেকখানি। বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিল্প ও বাণিজ্যে। অসন্তোষ বিরাজ করছে শহর, নগর, গ্রাম, গঞ্জ— সর্বত্র। রাজধানীর কদমতলীর

তুষারধারার বাসিন্দা আব্দুর রহমান জানান, তার এলাকায় গতকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত টানা লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে পুরো এলাকা।

লোডশেডিং ঘোষণার পর রাজধানী ঢাকায় প্রথমে এক ঘণ্টার লোডশেডিং থাকলেও দিন দিন বাড়ছে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ। চার-পাঁচবার লোডশেডিংয়ের অভিযোগ তোলেন নগরবাসী। কখনো আধা ঘণ্টা কখনো দুই-তিন ঘণ্টাও লোডশেডিং থাকছে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়। ঢাকার দুই সিটিতে প্রতিদিন গড়ে চার ঘণ্টার মতো বিদ্যুৎ থাকে না। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন সবাই।

অন্যদিকে গ্রাম পর্যায়ে শুরুতে ১২-১৪ ঘণ্টার লোডশেডিং থাকলেও তা কমে আট থেকে ১০ ঘণ্টায় নেমেছে। এদিকে রাজধানীর সরকারি অফিস, বাণিজ্যিক এলাকা, ব্যাংক পাড়া ও গুরুত্বপূর্ণ বিপণি এলাকাগুলোতে এক ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং থাকছে না বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট এলাকার লোকজন।

সারা দেশে তীব্র লোডশেডিং থাকলেও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ থাকছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও আবাসিক হলগুলোতে লোডশেডিং নেই বলে জানা গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. শহীদুল্লাহ হলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র নুরুন্নবী বিন মোস্তফা আমার সংবাদকে জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে এখন পর্যন্ত লোডশেডিং দেখা যায়নি। এখানে বিদ্যুৎ না থাকলে বিপাকে পড়বে হলের সহস্রাধিক শিক্ষার্থী। অপরদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন থেকে সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবার অনলাইনে ক্লাস অনুষ্ঠিত হবে।

পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে লিফটের ব্যবহার সীমিত করা, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের তাপমাত্রা একটি নির্দিষ্ট পর্যায় পর্যন্ত রাখার মতো সিদ্ধান্ত হয়েছে। যেদিন অনলাইন ক্লাস চলবে সেদিন নতুন একাডেমিক ভবনে কেবল একটি লিফট চালু থাকবে। তবে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অফিস ও দপ্তর চালু থাকবে। গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ইমদাদুল হক এ তথ্য জানিয়েছেন।

নিউমার্কেট এলাকার বাসিন্দা ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী রহমত উল্লাহ আমার সংবাদকে জানান, নিউমার্কেট এলাকায় অনেকগুলো মার্কেট থাকায় নিয়মতান্ত্রিক এক ঘণ্টাই লোডশেডিং থাকছে।

রাজধানীর যাত্রবাড়ী এলাকার থেকে আয়শা খাতুন বলেন, লোাডশেডিংয়ের প্রভাবে দৈনন্দিন কাজে ব্যত্যয় ঘটছে। মেয়ে-ছেলেদের পড়াশোনায় বিঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে। অসহনীয় এই লোডশেডিংয়ের ফলে ফ্রিজে থাকা মাছ, মাংস, সবজি নষ্ট হওয়ারও খবর উঠে এসেছে। বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, দিন দিন ঘাটতি বাড়ছে। এ জন্য লোডশেডিংয়ের পরিমাণ বাড়াতে হচ্ছে। বর্তমানে সারা দেশে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ৭০টি সমিতি রয়েছে।

এছাড়া পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (পিডিবি) আওতায় চারটি অফগ্রিড এলাকায় ও পার্বত্যাঞ্চলের ২৬টি উপজেলায় বিদ্যুৎ বিতরণ করা হচ্ছে। খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে কাজ করছে ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি, রংপুর রাজশাহী অঞ্চলে আছে নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)।

আরইবির সমিতিগুলোর অভিযোগ, তারা প্রতিদিন চাহিদার অর্ধেকেরও কম বিদ্যুৎ পাচ্ছে। এ কারণে তারা সরকারি শিডিউল মানতে পারছেন না। তাদের বক্তব্য, সাধারণ সময়েও সমিতিগুলো গড়ে দুই থেকে তিন ঘণ্টা লোডশেডিং করে থাকে। এখন বিদ্যুৎ সাশ্রয় করতে গিয়ে তাদের প্রতিদিন গড়ে সাত থেকে আট ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হচ্ছে। গরম বাড়লে এ লোডশেডিং আরও এক-দুই ঘণ্টা বেড়ে যায়। এছাড়া নানা কারণে প্রতিদিন একাধিকবার লাইন ট্রিপ করে। গ্রাহকরা সেটিকেও লোডশেডিং বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে হালকা বৃষ্টি হলে লোডশেডিং কিছুটা কম হয়। তারপরও গড়ে পাঁচ থেকে সাত ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন ছিল ঢাকার বাইরের গ্রামগুলো।

সাতক্ষীরা পল্লী বিদ্যুৎ অফিস থেকে ঘোষণা দিয়েছে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত লোডশেডিং হবে। তবে সেটি তারা মানছেন না। রাতে চার-পাঁচবার বিদ্যুৎ বন্ধ হয়। প্রতিবারই এক ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছে। একদিকে তীব্র গরম অন্যদিকে মশার অত্যাচার। রাতে ঘুমাতে পারছে না সাধারণ মানুষ। এমনই অভিযোগ ছিল এখনকার ভুক্তভোগীদের।

এদিকে গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করতে ‘জিডিএফ থেকে অস্থায়ী ঋণ’ হিসেবে দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের জন্য গত ৬ জুলাই অর্থ বিভাগের অনুমোদন পায় পেট্রোবাংলা। তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জিডিএফ কেবল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য চালু হয়েছিল, গ্যাস আমদানির জন্য নয়। আর জিডিএফের প্রবিধান অনুযায়ী, এই তহবিল থেকে অর্থ ব্যয়ের জন্য পেট্রোবাংলা বিইআরসির অনুমতি নিতে আইনত বাধ্য।

জ্বালানি খাতের সংকট দূর করতে ভুক্তভোগীর কথা শোনা ছাড়া কোনো উপায় নেই বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক এম শামসুল আলম।

এই বিশেষজ্ঞ মনে করেন, সরকারের ভুল নীতি আর অব্যবস্থাপনাই মূলত আজকের সংকটের জন্য দায়ী। অধ্যাপক শামসুল আলম বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের সংকট ও সংকট উত্তরণে করণীয় প্রসঙ্গে বলেন, যে মূল্যে জ্বালানি কিনছে জনগণ, তা তাদের সামর্থ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আবার সরকার এ খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এ পরিস্থিতির মধ্যে সরকার যখন ফের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির জন্য গণশুনানির আয়োজন করল— আমরা তখন প্রতিবাদ করলাম। আমরা বলেছি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। জ্বালানি নিয়ে সরকার একের পর এক যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা অনেকাংশেই ভুল এবং আত্মঘাতী বলে মনে করি। আজকের সংকট যার প্রমাণ।’

 

Link copied!