Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

বৈষম্যমুক্ত অর্থনীতির ভিত গড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

রেদওয়ানুল হক

আগস্ট ১৫, ২০২২, ০১:১৬ এএম


বৈষম্যমুক্ত অর্থনীতির ভিত গড়েছিলেন বঙ্গবন্ধু

বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরো জাতিকে তার স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রামের মূল জায়গাতেই ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে প্রান্তিক মানুষের পক্ষের একটি রাষ্ট্র গড়ে তোলা।

স্বাধীনতার আগে তিনি এ ভূখণ্ডের মানুষ যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের শিকার হচ্ছিল তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন, ‘দুই অর্থনীতি’র তত্ত্বের ভিত্তিতে জনমত গঠন করে রাজনৈতিক আন্দোলন করেছেন এবং সফলও হয়েছিলেন। বিজয়ের পর স্বাধীন দেশের অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করাই ছিল তার প্রধান চ্যালেঞ্জ।

কৃষি ও শিল্প খাতের পরিপূরকতাকে বিবেচনায় রেখে প্রান্তিক মানুষের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোও নিশ্চিত করেছিলেন। তার সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। অর্থনীতিকে ঢেলে সাজাতে তিনি যেসব নীতি ও পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার পথ ধরেই দেশের অর্থনীতি আজকের অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, একটি সদ্য স্বাধীন দেশ পরিচালনায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হয় কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ। বিশেষ করে টেকসই অর্থনৈতিক ভিত গড়ে তুলতে দীর্ঘমেয়াদি যে পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণ করা দরকার হয় সেটি তিনি সফলতার সাথে করতে পেরেছিলেন।

ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তার সামনে ছিল আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক অঙ্গনে নানাবিধ চ্যালেঞ্জ। ছিল বৈরী প্রকৃতি আর সীমিত সম্পদে অসাধ্য সাধনের লক্ষ্য। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীন দেশেও প্রতিক্রিয়াশীল চক্র সক্রিয় ছিল। তাদের দুর্নীতি আর অসহযোগিতা যখন স্বাধীনতার সব অর্জনকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছিল সে সময়ই বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক।

দল-মত নির্বিশেষে সব অংশীজনকে এক ছাতার নিচে নিয়ে এসে ঐক্যবদ্ধভাবে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করার এক সাহসী উদ্যোগ তিনি নিয়েছিলেন। বড়ই দুর্ভাগ্য এর শেষ তিনি দেখে যেতে পারেননি।

বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে মনের গহিনতম তল থেকে উচ্চারণ করেন, ‘আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে, পূর্ণ হবে না। আমাদের তাই অনেক কাজ করতে হবে।’ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সবার জন্য উন্নয়নের এই অভিযাত্রায় নিবিষ্টভাবে নিবেদিত ছিলেন।

অপরদিকে শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য তিনি এক সুদীর্ঘ সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন। শোষণহীন সমাজ ছিল বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন ভাবনার মূল জায়গা। তিনি তার মতো করে ‘সমাজতন্ত্র’ অর্জনের স্বপ্ন দেখতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলে গেছেন, ‘আমি বিশ্বের কাছ থেকে সমাজতন্ত্র ধার করতে চাই না।

বাংলার মাটিতে এই সমাজতন্ত্র হবে বাংলাদেশের মানুষের। এই সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মানুষের, যেখানে কোনো শোষণ এবং সম্পদের বৈষম্য থাকবে না। ধনীকে আমি আর ধনী হতে দেব না। কৃষক, শ্রমিক এবং জ্ঞানীরা হবে এই সমাজতন্ত্রের সুবিধাভোগী।’ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৭ জুন ১৯৭২)।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি দেশকে দাঁড় করানো মোটেও সহজ ছিল না। সে সময় আমাদের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র আট বিলিয়ন ডলার। আমাদের সঞ্চয়-জিডিপির হার ছিল ৩ শতাংশ। আমাদের রিজার্ভ ছিল শূন্য। বিনিয়োগ ছিল জিডিপির ৯ শতাংশ। এমন শূন্য হাতে তিনি রওনা হয়েছিলেন সোনার বাংলা গড়ার জন্য।

তাকে যুদ্ধবিধ্বস্ত অবকাঠামো পুনর্নির্মাণ করতে হয়েছে একেবারে গোড়া থেকে। এক কোটি শরণার্থীকে পুনর্বাসন করতে হয়েছে। দেশের ভেতরে বাস্তুচ্যুত ২০ লাখ মানুষের ঘর-বাড়ির ব্যবস্থা করতে হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে শুরু করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজাতে হয়েছে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়েছে। শিক্ষা কমিশন, ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্টস কমিশন গঠন করেছেন। এসবই করতে হয়েছে প্রতিকূল পরিস্থিতি ও বিরূপ আন্তর্জাতিক পরিবেশ মোকাবিলা করে।

তিনি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মুখবন্ধে লিখেছেন, ‘এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভবিষ্যৎ বিকাশের দিক-নির্দেশনা এবং উন্নয়ন অগ্রাধিকার চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে স্বল্প সময়ে প্রণয়ন করা হয়েছে। জাতি গঠনে আমাদের সবাইকে একাগ্রচিত্তে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে যেমনটি আমরা মুক্তিযুদ্ধে সাহস ও উদ্দীপনার সঙ্গে করেছিলাম।’

স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ যাতে আর কোনোদিন অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার না হয়, গ্রামপ্রধান-কৃষিপ্রধান বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ যাতে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারে সে জন্য তিনি সংবিধান রচনা করান চারটি মূলনীতির ভিত্তিতে। সংবিধানের চার মূলনীতিই প্রমাণ করে তিনি ভেদ-বৈষম্যহীন একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে কতটা আন্তরিক ছিলেন। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও তিনি প্রাধান্য দেন সুষম একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে।

প্রথম এ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যগুলোর দিকে নজর দিলেই এই সাক্ষ্য মেলে যে তিনি একটি সুষম, দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই একটি অর্থনৈতিক বুনিয়াদ গড়ে তুলতে কতটা আন্তরিক ছিলেন। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যগুলো ছিল— (১) দারিদ্র্য দূরীকরণ।

বেকারদের কর্মের সুযোগ সৃষ্টি, কম মজুরিতে নিযুক্তদের মজুরি বৃদ্ধি, জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সমতাভিত্তিক আইন ব্যবস্থা। (২) পুনর্নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখা। কৃষি ও শিল্প খাতসহ অর্থনীতির প্রধান প্রধান ক্ষেত্রে উৎপাদন সামর্থ্য ও সময়োপযোগী মাত্রায় বৃদ্ধি করা। (৩) বাৎসরিক জিডিপি অন্তত ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি (বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩.৩ শতাংশ হারকে অতিক্রম করা) সার্বক্ষণিক চাকরির সংখ্যা ৪১ হাজারে উন্নীতকরণ, অসংগঠিত খাতের শ্রমশক্তিকে সংগঠিত করা, উন্নয়নমুখী স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করা। (৪) খাদ্য, বস্ত্র, ভোজ্যতেল, কেরোসিন এবং চিনির মতো অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রীর প্রাপ্তি ও স্বল্পমূল্য নিশ্চিত করা। (৫) দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করা এবং অপরিহার্য দ্রব্যসামগ্রীর ক্ষেত্রে মূল্য কমানো। (৬) মাথাপ্রতি বাৎসরিক আয় অন্তত ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা। এমনভাবে গতি-নির্ধারণ করা, যাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠী সম্পদের তুলনায় অধিক হারে বাৎসরিক আয় ভোগ করতে পারে। আয় এবং সম্পদের ওপর সিলিং ধার্য করে এবং আদায়কৃত রাজস্বের পুনর্বণ্টন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করা। (৭) সমাজতন্ত্রে রূপান্তর প্রচেষ্টায় অর্জিত সাফল্যকে সমন্বিত করা, প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে সমাজতন্ত্রমুখী করা এবং এই উদ্দেশ্যে সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধন করা। (৮) দেশীয় সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির মাধ্যমে পরনির্ভরতা কমিয়ে আনা। রপ্তানি বৃদ্ধি ও বহুমুখীকরণ এবং দক্ষতার সঙ্গে আমদানি বিকল্প খুঁজে বের করার মাধ্যমে বৈদেশিক বিনিময়ের ভারসাম্যহীনতা রোধ করা। (৯) খাদ্য-শস্য উৎপাদনে আত্মনির্ভরতা অর্জন, কৃষি ক্ষেত্রে সুযোগ সমপ্রসারণ এবং শহরমুখী শ্রমিক স্রোত ঠেকানোর উদ্দেশ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ও কারিগরিভিত্তিক কৃষি ভিত্তি গড়ে তোলা। (১০) জনসংখ্যা পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের একটি উচ্চাভিলাসী গ্রাউন্ডওয়ার্ক সম্পাদন করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতির অঙ্গীকার ও সামাজিক সচেতনতা নিশ্চিত করা, জনসংখ্যা পরিকল্পনার জন্য একটি যথোপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো সৃষ্টি, অনবরত ও নিবিড় মূল্যায়ন এবং গবেষণার ব্যবস্থাসম্পন্ন পরিবার-পরিকল্পনার বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বাৎসরিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে ২.৮ শতাংশে কমিয়ে আনা। (১১) শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গ্রামীণ গৃহায়ণ এবং জল সরবরাহ ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে চিরাচরিতভাবে অবহেলিত সামাজিক ও মানবসম্পদের উন্নয়ন সাধন। (১২) সমগ্র দেশে ভৌগোলিক অঞ্চল নির্বিশেষে সমহারে আয় ও কর্মের সুযোগ সমপ্রসারিত করা, অর্থনৈতিক সুযোগ সমপ্রসারিত অঞ্চলে শ্রমিকের গমনাগমন উৎসাহিত করা।

তবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্য নিয়ে বর্তমানে যে অর্থনৈতিক বিপ্লব চলছে তার বড় খুঁত হিসেবে ধরা হয় বৈষ্যম্যমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করতে না পারা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে দেশে বর্তমানে নানাবিধ আর্থিক বৈষম্য দৃশ্যমান হচ্ছে। ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক বিপ্লবকে উত্তর-দক্ষিণের বৈষম্য হিসেবে চিহ্নিত করছেন অনেকে। যা পাকিস্তান আমলে ছিল পূর্ব-পশ্চিমের বৈষম্য। আবার কেউ কেউ কর্পোরেট মাফিয়ার উত্থানের অভিযোগও তুলছেন। বলা হচ্ছে, দেশে রাজনীতিবিদদের হাতে রাজনীতি নেই, আর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে কতিপয় সুবিধাবাদি শিল্পগ্রুপ। তারা ভিনদেশি এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছেন কি-না তা নিয়েও সংশয় আছে অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মাঝে।

Link copied!