Amar Sangbad
ঢাকা মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪,

মৃত্যু ছাড়া টনক নড়ে না

নুর মোহাম্মদ মিঠু

আগস্ট ১৭, ২০২২, ০১:২৫ এএম


মৃত্যু ছাড়া টনক নড়ে না

রাজধানীর উত্তরায় বিআরটি প্রকল্পের ক্রেন থেকে ১২০ টন ওজনের গার্ডার চাপায় গত সোমবার পাঁচজন নিহতের ঘটনার আগেও গত মাসে গাজীপুরে লঞ্চিং গার্ডারের চাপায় নিহত হয় প্রকল্পে নিয়োজিত এক নিরাপত্তাকর্মী। অথচ সে সময় ওই প্রকল্পের কোনো অংশেই যেন এমন দুর্ঘটনা আর না ঘটে সে জন্য কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি। আসেনি সরকার কিংবা প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের থেকেও কোনো নির্দেশনা।

এক কথায় মাথাব্যথাই ছিল না এ নিয়ে। যে কারণে ‘গার্ডার চাপা’ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল উত্তরায়। এ ক্ষেত্রে এবার সরকারের কিছুটা টনক নড়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। তবে বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন, মৃত্যু ছাড়া কেন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয় না। মৃত্যু ছাড়া কেন সরকারের টনক নড়ে না।

এ প্রশ্নের উত্তর আপাতত কারো থেকেই পাওয়া না গেলেও সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরীর বক্তব্যে এটুকু পরিষ্কার যে, উত্তরার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে এখনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে না। শুধু শোকজ করা হচ্ছে।

অথচ প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অবহেলায় এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে প্রতিয়মানও হয়েছে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের কথাও বলেছেন সচিব।  

বিআরটি প্রকল্পের যে অংশে আলোচিত এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সে অংশের মেয়রের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। দুর্ঘটনার পর গতকাল  বিআরটির সব ধরনের কাজ বন্ধ ঘোষণা করেছেন উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম।

এসময় তিনি বলেন, কমপ্লায়েন্স (নিরাপত্তা ব্যবস্থা) নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত ঢাকায় বিআরটি প্রকল্পের সব ধরনের কাজ বন্ধ থাকবে।

তিনি বলেন, বিআরটি কর্তৃপক্ষ আমার সামনে আছেন। আমি গতকালও তাদের সাথে কথা বলেছি। সচিবের সাথেও কথা হয়েছে। আমি বলেছি, বিআরটির কাজ বন্ধ করে দেবো। আপনারা আমার সাথে পরশু বসবেন। শুধু এই প্রজেক্টই নয়, ঢাকা শহরে যতগুলো প্রজেক্ট চলছে, সবগুলো বন্ধ থাকবে।

তিনি বলেন, এ প্রকল্প কাজ পরিচালনায় ন্যূনতম নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। ফলে কিছু দিন পরপরই দুর্ঘটনা ঘটছে। জনদুর্ভোগ বাড়ছে। এভাবে উন্নয়ন কাজ চলতে দেয়া যাবে না। আগে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। আতিকুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় বিআরটি, মেট্রোরেলসহ অনেকগুলো প্রকল্পের কাজ চলছে। সব প্রকল্পের পরিচালকদের আগামী বৃহস্পতিবার নগর ভবনে ডাকা হয়েছে।

তারা নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করলেই কাজ শুরু করতে পারবে। অথচ চলমান এই প্রকল্পগুলো বেশ কবছর ধরেই চলছে। এ সময়ের মধ্যে কখনো মেয়রকে সরেজমনি স্পটে গিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিতের বিষয়ে কথা বলতে দেখা যায়নি। বিভিন্ন মহলের প্রশ্ন— পাঁচজনের মৃত্যুর পর কেন মেয়রের এমন তৎপরতা।

দুর্ঘটনার প্রাথমিক তদন্তে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ কর্পোরেশনের (সিজিজিসি) গাফিলতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী।

তিনি বলেন, ‘প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী— ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অবহেলা, গাফিলতি পেয়েছে তদন্ত কমিটি। সোমবার কাজ করার কথা ছিল না, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাউকে না জানিয়ে কাজ করছিল। সাংবাদিকরা প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে শোকজ করব। চূড়ান্ত প্রতিবেদন এলে সিদ্ধান্ত নেবো।’

এদিকে শিশুসহ পাঁচজন নিহতের এ ঘটনায় রিট দায়ের করা হয়েছে। রিটে ঘটনার তদন্ত করে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা ও জনগণের চলাফেরায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে।

গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাগুফতা আহমেদ এ রিট দায়ের করেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, সড়ক ও জনপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের রিটে বিবাদী করা হয়েছে। বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চে আজ বুধবার রিট আবেদনটির ওপর শুনানি হতে পারে।

এরই মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়নার গ্যাঝুবা গ্রুপ কর্পোরেশনের দায় দেখার পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়টিও তারা বারবার লঙ্ঘন করেছে বলে জানতে পেরেছে তদন্ত কমিটি। বিষয়টি বাংলাদেশে অবস্থিত চীনের দূতাবাসকে জানানো হবে। তদন্ত কমিটির প্রধান ও সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আক্তার এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের এই তদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, তারা (ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান) সেফটির বিষয়টি অনেকবারই লঙ্ঘন করেছে।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এক কথায় বলতে চাই, দায় এড়ানোর প্রশ্নই আসে না। বাংলাদেশের নাগরিকদের মূল্যবান জীবন চলে গেছে, এ ক্ষেত্রে আমরা কোনোরকম কমেপ্রামাইজ করতে চাই না। এ ঘটনার জন্য কে দায়ী সেটা কিন্তু স্টেপ বাই স্টেপ আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হবে।

সবগুলোর সাথে একটা লিগ্যাল কানেকশন আছে। সে জিনিসগুলো আমাদের ফলো করতে হবে। এটি আপনারা এভাবে ভাবার কারণ নেই যে, আমরা একটি চাইনিজ কোম্পানিকে দায়ী করে আমাদের দায় ছেড়ে দিচ্ছি। আমাদের নাগরিকের জীবন মূল্যবান।

তিনি আরও বলেন, আমাদের কাজটি প্রায় ৮০ ভাগ হয়ে গেছে। এখন আমরা শাস্তি দিতে পারি, তাদের বাতিল করে দিতে পারি। সে ক্ষেত্রে আমরা যদি পুনরায় কন্ট্রাক্টর সিলেকশনে যাই তাহলে আমাদের জনগণকে আরও ভোগান্তির দিকে ঠেলে দেয়া হবে। কিন্তু ভোগান্তি এক জিনিস আর লাশ দেখা আরেক জিনিস। সে জন্য আমরা আর কমেপ্রামাইজ করছি না।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ কে এম মনির হোসেন পাঠান বলেন, সড়ক নিরাপত্তা যেকোনো কনস্ট্রাকশন কাজের অন্যতম সেফ গার্ড ইস্যু। এগুলো ছাড়া কোনো চুক্তি হয় না। চুক্তির মধ্যে ঠিকাদার নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশগত ইস্যুগুলো নিশ্চিত করবে, তখনই সে কেবল তার কাজে যেতে পারবে। সেগুলো কনফার্ম করছে কি-না, সেটি যাচাই করার জন্য কনসালটেন্ট আছে, প্রজেক্ট পার্সন আছে। তারা যাচাই করে দেখবে সেফটি মেজারমেন্টগুলো ঠিক আছে কি-না, যদি সেগুলো ঠিকমতো কাজ করে তাহলে সে কাজ করার অনুমতি পাবে। অন্যথায় পাবে না।

এছাড়াও প্রকল্পের মধ্যে আলাদা প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টশন ইউনিট আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দাতা সংস্থা এডিবির (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) কনসালটেন্টও আছে। তারাও বিষয়গুলো মনিটরিং করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি ও কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন গতকাল। একই সঙ্গে অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান এসব কাজে অবহেলা করে তাদের কালো তালিকাভুক্ত করতে বলেছেন তিনি।

এদিকে এ ঘটনায় নিহতদের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল দুপুরে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মর্গে ময়নাতদন্ত হয়।

ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক নাসেদ জামিল বলেন, ‘নিহত ব্যক্তিদের বিষয়ে সুরতহাল প্রতিবেদনে যা লেখা আছে, আমরা ময়নাতদন্তে তাই পেয়েছি, ব্যতিক্রম কিছু নয়। নিহত প্রত্যেকের একাধিক পর্যবেক্ষণ (মাল্টিপল ফাইন্ডিংস) রয়েছে। প্রতিটির আলাদা করে বর্ণনা (ডেসক্রাইব) দেয়া সম্ভব নয়। সুরতহাল প্রতিবেদনে যেভাবে বর্ণনা করা আছে, হুবহু আমরা তাই পেয়েছি।’

এদিকে সোমবার দিবাগত রাতে নিহত ফাহিমা আক্তার ও ঝরনা আক্তারের ভাই আফরান মণ্ডল বাবু উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করেন। অবহেলার কারণে এ ঘটনা ঘটায় ক্রেনের চালক, সিজিজিসি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বপ্রাপ্ত অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে।
 

Link copied!