Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪,

চট্টগ্রাম বহদ্দারহাটে গার্ডার ধসের ৯ বছর

সাক্ষী খুঁজে পাচ্ছে না রাষ্ট্রপক্ষ

শরিফ রুবেল

আগস্ট ১৭, ২০২২, ০১:৩২ এএম


সাক্ষী খুঁজে পাচ্ছে না রাষ্ট্রপক্ষ

দেশের বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও সেতু নির্মাণ কাজ চলছে। নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে শত শত টন ওজনের ভারী নির্মাণযন্ত্র। তবে নির্মাণযন্ত্রগুলোর অরক্ষিত রক্ষণাবেক্ষণে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। গেল কয়েক বছরে উড়ালসেতুর গার্ডার ধসে অন্তত ২০ জন মারা গেছেন।

তবে অধিকাংশ ঘটনায়ই মামলা হয়নি। নিহতের স্বজনরা কাউকে অভিযুক্তও করেননি। কেউ কেউ মামলা করলেও বিচার আটকে আছে বছরের পর বছর। দেশে গার্ডার ধসে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে। ২০১২ সালে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসে ১৩ জনের মৃত্যুর ঘটনার পর সাড়ে ৯ বছরের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও মামলার বিচার শেষ হয়নি।

২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে অভিযোগ গঠন করার আট বছর পার হলেও রাষ্ট্রপক্ষ সব সাক্ষীকে হাজির করতে পারেনি। ১৫ আগস্ট রাজধানীর উত্তরায় বিআরটিএর গার্ডার ধসে একই পরিবারের পাঁচজন মারা যায়। এ ঘটনায় মামলাও হয়েছে।

কিন্তু অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আইনজীবীরা বলেছেন, এ মামলায় বিচার পাওয়া দুরূহ হবে। কারণ এসব ঘটনায় মামলা হলেও বিচার হয় না। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেছেন, ঘটনার সময় উপস্থিত যেসব মানুষকে সাক্ষী করা হয়েছে, ঘটনার ৯ বছর পর অনেকের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তারা অনেকে ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলায় সাক্ষী নেয়া যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অনুপম চক্রবর্তী।

চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর অনুপম চক্রবর্তী বলেন, সাক্ষীদের মধ্যে তিনজন পুলিশ কর্মকর্তা, দুজন চিকিৎসক এবং স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রত্যক্ষদর্শীসহ ২৭ জন ছিলেন। এর মধ্যে ১৯ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। বাকিদের উপস্থিত হতে সমন জারি করা হয়েছে। অন্যান্য সাক্ষীদের বেশিরভাগ অস্থায়ী হওয়ায় অন্যত্র চলে গেছেন।

এছাড়া একজন গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৎকালীন সহকারী রেজিস্ট্রার পুলক কুমার বিশ্বাসের সাক্ষ্য গ্রহণ বাকি। তিনি ঢাকায় আছেন বলে জেনেছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করছি। আশা করছি, পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ১০ অক্টোবর তাকে হাজির করা যাবে।

অনুপম চক্রবর্তী জানান, বাকি থাকা একজন চিকিৎসকের সাক্ষ্য পেলে মামলাটি প্রমাণ করা যাবে। ২০ জন সাক্ষী যথেষ্ট, তিনটি ধারায় মামলাটি চলছে। ধারা অনুযায়ী, আসামিদের সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। মামলার কার্যক্রম গুছিয়ে আনা হয়েছে। আশা করছি, চলতি বছরের শেষ দিকে মামলাটির ফলাফল আসবে। চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের বেঞ্চ সহকারী ওমর ফুয়াদ বলেন, বহদ্দারহাটে নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে প্রাণহানির ঘটনার মামলায় ১৯ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ৩ অক্টোবর সাক্ষীর জন্য দিন ধার্য রয়েছে।

এদিকে তদন্ত, চার্জশিট দাখিলে গাফিলতি ও সময়মতো সাক্ষী হাজির না হওয়াই মামলা নিষ্পত্তির মূল বাধা— এমনটিই জানান আইনজীবীরা। তারা বলেন, আদালতে সাক্ষী করতে না পারার দায় রাষ্ট্রপক্ষের। রাষ্ট্রপক্ষের গাফিলতিতেই যেকোনো মামলার সাক্ষী হাজির করা সম্ভব হয় না।

বিচার না হওয়ার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জামিউল হক ফয়সাল বলেন, এ ধরনের ঘটনার বিচার নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। কারণ বিচার না হওয়া অতীতের নজির খুব উদ্বেগজনক। আর বিষয়টির সাথে সরকারের লোক জড়িত থাকে বিধায় বিচার করা সম্ভব হয় না। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রভাবশালী হওয়ায় তারা টাকা ঢেলে মামলা বিলম্বিত করে। অনেক সময় ভুক্তভোগীরা আপস করে ফেলে। বিচার নিশ্চিতে তদন্তকারী সংস্থা ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের মধ্যে সমন্বয় আরও বাড়ানো উচিত।

অনেকে আটক হয়েও জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছেন। আবার হয়রানির ভয়ে প্রত্যক্ষদর্শীরা সাক্ষী হতে চান না। অনেক সময় কোনো সাক্ষী একবার সাক্ষী দিলেও পরের হাজিরার দিন তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। নিজ খরচে বারবার আদালতে আসতেও অনীহা দেখান তারা। যদিও জেলা প্রশাসককে তার যাতায়াত খরচ বাবদ টাকা দেয়ার কথা।

আইন কর্মকর্তাদের দাবি, এসব মামলায় সাক্ষী পাওয়া কঠিন, তাই সহজে বিচার কাজ শেষ করাও কঠিন। অধিকাংশ মামলায় সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে আসামিদের খালাস দেন আদালত। সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে সমন দিলেও তারা আদালতে উপস্থিত হন না। এতে তাদের কোনো দায় নেই।

এ ঘটনায় কর্তব্যে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগ এনে মামলা করেন চান্দগাঁও থানার তৎকালীন এসআই আবুল কালাম আজাদ। মামলায় ফ্লাইওভার প্রকল্পের পরিচালক চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) নির্বাহী প্রকৌশলী হাবিবুর রহমান, সহকারী প্রকৌশলী তানজিব হোসেন ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী সালাহ উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আখতার অ্যান্ড পারিসা ট্রেড সিস্টেমসের ১০ জন এবং বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএআরএম অ্যাসোসিয়েটসের ১২ জনসহ ২৫ জনকে আসামি করা হয়।

২০১৪ সালের ১৮ জুন তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ এস এম মজিবুর রহমান অভিযোগপত্র গ্রহণ করে আট আসামির বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন। ২০২০ সাল থেকে মামলাটি চতুর্থ অতিরিক্ত চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শরীফুল আলম ভূঁঞার আদালতে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।

মামলায় অভিযুক্তরা হলেন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মীর আখতারের সে সময়ের প্রকল্প ব্যবস্থাপক গিয়াস উদ্দিন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মনজুরুল ইসলাম, প্রকল্প প্রকৌশলী আব্দুল জলিল, আমিনুর রহমান, আব্দুল হাই, মো. মোশাররফ হোসেন রিয়াজ, মান নিয়ন্ত্রণ প্রকৌশলী শাহজান আলী ও রফিকুল ইসলাম। তাদের মধ্যে রফিকুল ইসলামের নাম মামলার এজাহারে ছিল না। তদন্ত শেষে পুলিশ তার নাম অভিযোগপত্রে যুক্ত করে।

 

Link copied!