Amar Sangbad
ঢাকা শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪,

আগ্রাসী হয়ে উঠছে ডেঙ্গু

মাহমুদুল হাসান

সেপ্টেম্বর ১২, ২০২২, ০১:০৯ এএম


আগ্রাসী হয়ে উঠছে ডেঙ্গু

ভরদুপুর কিংবা মাঝরাতে মনকে শীতল করছে এক পশলা বৃষ্টি। কাঠফাটা রৌদ্র আর ভ্যাপসা গরম থেকে স্বস্তি মিললেও অবহেলা, অসতর্কতা আর অসচেতনতায় বাড়ির আঙিনা, ছাদের নিচু জায়গা, ফুলের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, বেজমেন্ট কিংবা কনস্ট্রাকশন এলাকায় বিভিন্ন পাত্রে জমে থাকা পানিতে জন্মাচ্ছে এডিসের লার্ভা। এ জন্য ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ডেঙ্গু। গতকাল পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।

আবহওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, আগামী নভেম্বরের আগে বৃষ্টিপাত কমার সম্ভাবনা নেই। তাই অক্টোবরের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ডেঙ্গুর বিস্তার আগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য ও কিটতত্ত্ববিদরা।

তাদের ভাষ্যমতে, বর্ষা মৌসুমে জমে থাকা পানিতে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার হয়। আগস্ট থেকে অক্টোবর এই তিন মাসে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু হয়। চলতি বছরে বিলম্বে বৃষ্টিপাত শুরু হলেও আগামী দুই মাস ডেঙ্গু ভয়াবহভাবে ছড়াতে পারে। এরপর শীতের আগমন ও বর্ষার বিদায়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে শুরু করবে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গতকাল সারা দেশে আরও ৩৬০ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তার মধ্যে ঢাকায় ২৩৯ জন এবং ১২১ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি  রয়েছেন।

এতে আরও জানানো হয়, বর্তমানে দেশের সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে মোট এক হাজার ১২৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রয়েছেন। তাদের মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৮৯৩ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিচ্ছেন ২৩৫ জন। চলতি বছরের পয়লা জানুয়ারি থেকে গতকাল পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

একই সময়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সর্বমোট আট হাজার ৭৫০ জন। তার মধ্যে ঢাকার সাত হাজার ৭১ জন। দেশের অন্যান্য জেলার এক হাজার ৬৭৯ জন। এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছে সাত হাজার ৫৮৯ জন। তার মধ্যে ঢাকার সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়েছে ছয় হাজার ১৬৫ জন। ঢাকার বাইরের আরও এক হাজার ৪২৪ জন।

মাসের হিসেবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০, এপ্রিলে ২৩, মে মাসে ১৬৩, জুনে ৭৩৭, জুলাইয়ে ১৫৭১ জন, আগস্টে ৩৫২১ জন এবং চলতি মাসের গত ১১ দিনে আরও ২৫৬৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। মৃত ৩৩ জনের মধ্যে চলতি মাসের গত ১১ দিনে মারা গেছে ১২ জন, আগস্টে ১১ জন, জুলাইয়ে ৯ জন এবং অপর একজন জুনে মারা গেছে। এছাড়াও মৃত ৩৩ জনের মধ্যে ১৩ জন রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন।

এছাড়াও ২০ জনের মধ্যে কক্সবাজারের বিভিন্ন হাসপাতালে ১৬ জন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে একজন এবং বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আরও তিনজন মারা গেছেন। এদিকে পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী রাজধানীর এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে মাঠে তৎপরতা বাড়িয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)।

গতকাল ডিএনসিসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ের আওতাধীন এলাকায় শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ অভিযান। ডিএনসিসি উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল ডা. মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, সকাল থেকে ডিএনসিসি আওতাধীন প্রতিটি এলাকায় এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সপ্তাহব্যাপী বিশেষ অভিযান পরিচালনা শুরু হয়েছে। উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১০টি অঞ্চলে ১০টি টিম এই অভিযান পরিচালনা করছে।

রাজধানীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত ১৩ জনের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, স্যার সলিমুল্লা মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে, জাতীয় শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে এবং বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে দুইজন করে মোট আটজন মারা গেছে। হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতাল, শমরিতা হাসপাতাল, ডেলটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সেন্ট্রাল হাসপাতাল এবং গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একজন করে পাঁচজন মারা গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ আমার সংবাদকে বলেন, ডেঙ্গুজ্বরের বিস্তারের সঙ্গে নগরায়ণ সরাসরি জড়িত। যত উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ ঘটবে ততবেশি ডেঙ্গু ঝুঁকি তৈরি হবে। কনস্ট্রাকশন এলাকায় বিভিন্ন প্রয়োজনে পানি ধরে রাখতে হয়। এসব পাত্রে দীর্ঘদিন পড়ে থাকা পানিতে এডিস মশার লার্ভা জন্মায়। আগামী দুই মাস ডেঙ্গুর ভয়াবহতা থাকবে।

এরপর শীতের আগমনে ও বর্ষার বিদায়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে শুরু করবে। তিনি বলেন, দ্বিতীয়বার যাদের ডেঙ্গু হচ্ছে তাদের মৃত্যু ঝুঁকি বেশি। দেশের মানুষের চার ধরনের ডেঙ্গু হতে পারে। সেই হিসেবে আমরা যদি আনুমানিকভাবে ১৭ কোটি মানুষ ধরি তাহলে এদের চারবার করে ডেঙ্গু হলে প্রায় ৬৮ লাখ রোগী সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য এখনই ডেঙ্গু মোকাবিলায় নেমে পড়তে হবে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রাক মৌসুম এডিস সার্ভে-২০২২ শীর্ষক জরিপের তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে প্লাস্টিক ড্রামে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যায় ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, সেখানে ২০২২ সালে মৌসুমপূর্ব জরিপে লার্ভার পরিমাণ দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, ২০১৯ সালে জলমগ্ন ফ্লোরে লার্ভা ছিল ২০ শতাংশ, এখন সেটি ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ। প্লাস্টিক বালতিতে ছিল ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ, চলতি বছর তা ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। পানির ট্যাংকে ছিল ৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ, এ বছর ১০ দশমিক ৫৩ শতাংশ।

যা ২০১৯ সালের চেয়েও ভয়াবহতা ছড়াতে পারে। রাজধানীর দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩৮, ৪০, ৪৫ নম্বর ওয়ার্ড এবং উত্তর সিটির (ডিএসসিসি) ২০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ড বেশি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ডিএনসিসির ৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে সর্বোচ্চ ব্রুটো ইনডেক্স (মশার ঘনত্ব) ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ৩৮ ও ৪০ নম্বর ওয়ার্ডে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ শতাংশ। এসব এলাকায় পরিত্যক্ত কনটেইনারে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে সর্বোচ্চ ২৫ দশমিক ৪৯ শতাংশ।

এছাড়া জলমগ্ন মেঝে ও প্লাস্টিক কনটেইনারে বেশি মাত্রায় এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। অন্যদিকে ডিএসসিসির ২০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডে এডিস মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে। এই দুটি এলাকায় ব্রুটো ইনডেক্স ১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ। এসব এলাকায় পরিত্যক্ত কনটেইনার, প্লাস্টিক ড্রামে এডিস মশার লার্ভা সবচেয়ে বেশি ২৩ দশমিক ১৯ শতাংশ পাওয়া গেছে।

এছাড়া জলমগ্ন মেঝেতে ২১ দশমিক ৭৪ শতাংশ লার্ভা পাওয়া গেছে। জরিপের জন্য ২১টি দল নির্বাচন করা হয়। সবগুলো দল ১০ দিনে ঢাকার দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডের ১১০টি সাইটে তিন হাজার ১৫০টি বাড়িতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। এদের মধ্যে উত্তর সিটির ৬৩টি এবং দক্ষিণ সিটির ৯৬টি বাড়িতে এডিস মশা অতিরিক্ত মাত্রায় চিহ্নিত হয়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) তথ্যমতে, সাধারণত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু মৌসুম হিসেবে ধরা হয়। ২০০০ সালে সর্বপ্রথম দেশে ডেঙ্গুজ্বর দেখা দেয়। সে বছর ৯৩ জন মারা যান। ৩ বছর পর মৃত্যুসংখ্যা ধীরে ধীরে প্রায় শূন্যে নেমে আসে। তবে ২০১৮ সালে ডেঙ্গু আবার ফিরে আসে। সে বছর জ্বরটিতে ২৬ জন মারা যায় এবং ১০ হাজার ১৪৮ জন আক্রান্ত হন।

২০১৮-এর আগে সর্বোচ্চ আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২০০২ সালে। সে বছর সারা দেশে ছয় হাজার ২৩২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু আক্রান্ত ২০১৯ সালে। সেই বছর রাজধানীসহ সারা দেশে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল। সরকারি হিসেবে মারা গিয়েছিল ১৭৯ জন। বেসরকারি হিসেবে এ সংখ্যা আরও কয়েকগুণ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব মতে, ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগী ছিল ৩৩ জন। ২০১৭ সালে তা বেড়ে গিয়ে হয় ১৮৬ জন। ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫২ জন।

Link copied!