Amar Sangbad
ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪,

মূলধন ঘাটতি সাড়ে ১১ হাজার কোটি

রেদওয়ানুল হক

মার্চ ১৯, ২০২৩, ০১:১৭ এএম


মূলধন ঘাটতি সাড়ে ১১ হাজার কোটি
  • সবচেয়ে বেশি ঘাটতি কৃষি ব্যাংকের
  • বেসরকারি চার ব্যাংকের ঘাটতি তিন হাজার ৩২৩ কোটি টাকা

 নানা কৌশল ও সুবিধার পরও মূলধন ঘাটতি এড়াতে পারেনি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। সম্প্রতি একক গ্রুপকে মোটা অঙ্কের সুদ মওকুফ করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে জনতা ব্যাংক। এছাড়া প্রভিশন সংরক্ষণে ডেফারেল সুবিধাসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নীতি সহায়তার সুযোগ কাজে লাগিয়েও ঘাটতি কমাতে ব্যর্থ সোনালী, রূপালী, অগ্রণী, বেসিকসহ সরকার নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে ১১ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা মুলধন ঘাটতিতে পরে রাষ্ট্রায়ত্ত পাঁচটি ব্যাংক। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ঘাটতি অগ্রণী ব্যাংকের তিন হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। এ ছাড়া সোনালী, জনতা, বেসিক ও রূপালী ব্যাংকের ঘাটতি যথাক্রমে এক হাজার ৮৩২ কোটি, এক হাজার ৫০০ কোটি, দুই হাজার ৩০৫ কোটি ও দুই হাজার ১০৭ কোটি টাকা। তবে একক ব্যাংক হিসেবে সবচেয়ে বেশি ১৩ হাজার ৬৩২ কোটি টাকার মূলধন ঘাটতি রয়েছে বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকে। এ খাতের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের ঘাটতি রয়েছে দুই হাজার ২৬১ কোটি টাকা। অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ব্যাংকগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ এক হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ঘাটতি আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের এক হাজার ১৪৪ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ১৮৪ কোটি ও পদ্মা ব্যাংকের ৩১৫ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘অনেকদিন ধরেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে। নানা অনিয়মের কারণেই এসব ব্যাংক ঘাটতিতে পড়ছে। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হচ্ছে, ঘাটতি পূরণের জন্য এসব ব্যাংককে সরকারি তহবিল থেকে সহায়তা দেয়া হয়। এতে জনগণের অর্থ ঝুঁকিতে পড়ছে। কারণ ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি শক্তিশালী না হওয়ায় এখানে অর্থায়ন তলাবিহীন পাত্রে অর্থ ঢালার শামিল।’ অতিরিক্ত সহনশীলতার কারণে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।

তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২ সালের শেষ তিন মাসে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ নবায়নের মাধ্যমে নিয়মিত করার পরও ব্যাংক খাতে মূলধন পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর শেষে সরকারি-বেসরকারি ১১টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে অন্তত ছয়টি ব্যাংকের মূলধন ভিত্তির অনুপাত (সিএআর) ঋণাত্মক ধারায় নেমেছে। আগের তিন মাসেও (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এই ১১ ব্যাংক মূলধন ঘাটতিতে ছিল। ওই সময় ব্যাংকগুলোর ঘাটতির পরিমাণ ছিল আরও বেশি, প্রায় ৩২ হাজার ৬০৬ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ব্যাংক খাতে ২৯ হাজার ২৭৯ কোটি ৮২ লাখ টাকার ঋণ পুনঃতফসিল করা হয়েছে। এর মধ্যে শেষ তিন মাসেই করা হয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ ২০২১ সালের পুরো সময়ে পুনঃতফসিল করা ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১২ হাজার ৩৭৯ কোটি টাকা। আর বিপুল পরিমাণ ঋণ পুনঃতফসিলের কারণে গত বছরের শেষ তিন মাসে কাগজ-কলমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ খেলপি ঋণ কমেছে। এর পরিমাণ প্রায় ১৩ হাজার ৭৩৯ কোটি টাকা। তারপরও পুরো বছরের হিসাবে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার ৩৮৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত বছরের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে প্রায় এক লাখ ২০ হাজার ৬৫৭ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের হার ছিল ৭ দশমিক ৯৩ শতাংশ, যা গত বছর বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ।

সাধারণত যে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ যত বেশি, ওই ব্যাংককে তত বেশি মূলধন রাখতে হয়। আর ডিসেম্বর শেষে মূলধন ঘাটতির তালিকায় থাকা ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের আধিক্য অত্যধিক বেশি রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, বছরের শেষ তিন মাসে কাগজ-কলমে খেলাপি ঋণ কমানোর কারণে সার্বিক ব্যাংক খাতে মূলধন ভিত্তির সামান্য উন্নতি হয়েছে। এ সময়ে মূলধন পর্যাপ্ততা অনুপাত (সিএআর) দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৮৩ শতাংশ, যা গত সেপ্টেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ০১ শতাংশ। আর ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১১ দশমিক ০৮ শতাংশ। যদিও এ সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সিএআর অনুপাত ঋণাত্মক ধারায় নেমে গেছে। এর মধ্যে বেসিক ব্যাংকের ঋণাত্মক ২ দশমিক ৩৪ শতাংশ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ঋণাত্মক ২০ দশমিক ৪০ শতাংশ, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ঋণাত্মক ১৩৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ঋণাত্মক ৫১ দশমিক ৪১ শতাংশ ও রাকাবের ঋণাত্মক ২৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ। এ ছাড়া একই সময়ে বেশ কয়েকটি ব্যাংকের সিএআর ১০ শতাংশের নিচে রয়েছে। এ তালিকায় আছে— অগ্রণী, জনতা, সোনালী, রূপালী, ন্যাশনাল ও পদ্মা ব্যাংক।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের মূলধন ভিত্তি দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায়ও দুর্বল। বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের সিএআর অনুপাত ছিল যথাক্রমে ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ ও ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশের ২০২২ সালেও ১১ শতাংশের ঘরেই আটকে আছে।

আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশ (৪০০ কোটির কম নয়) পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক এ পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এ ছাড়া বিদেশি ব্যাংকগুলো কোনো স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার আগে ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে থাকে।

Link copied!