Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪,

ঋণ বিতরণে মহোৎসব

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

আনোয়ার হোসাইন সোহেল

আগস্ট ১৫, ২০২৪, ১২:০৮ এএম


ঋণ বিতরণে মহোৎসব

দেশের আর্থিক খাতের দুরবস্থার মধ্যেই রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক ঋণ বিতরণের মহোৎসব চালিয়েছে। এর মধ্যে আলোচিত-সমালোচিত এস আলম গ্রুপ থেকে ব্যাংকটির একটি শাখার পাওনা এক হাজার ২১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনের পর জনতা ব্যাংকসহ সবগুলো রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেয়া ও এমডিদের অপসারণের জোর দাবি উঠেছে। ব্যাংকিং আইন লঙ্ঘন করে এস আলম গ্রুপকে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক। ওই ঋণের মধ্যে জনতা ব্যাংকের সাধারণ বীমা কর্পোরেশন শাখা, চট্টগ্রাম থেকেই এস আলম গ্রুপের খেলাপি এক হাজার ২১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা। যা ব্যাংকিং আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকে দেয়া ব্যাংকটির সবশেষ আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এই তথ্য জানা যায়। ওই সময় এস আলম গ্রুপসহ আওয়ামী লীগ সরকার সমর্থিত নেতাদের কয়েকটি গ্রুপকে দেয়ার ঋণের এক টাকাও আদায় করতে পারেনি বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জানায় জনতা ব্যাংক।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদন নিয়ে এস আলম গ্রুপ বছরের পর বছর মেয়াদ বাড়িয়ে কৌশলে নিয়মিত দেখাচ্ছে খেলাপি ঋণ। ব্যাংক আইন অনুযায়ী যেখানে একক গ্রুপকে মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ অর্থাৎ ৫৭৮ কোটি টাকা দেয়া যায় তবে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে পণ্য আমদানির বিপরীতে এ ঋণ সৃষ্টি হলেও তা শোধ করেনি এস আলম। নতুন করে ঋণের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন সদ্য পদত্যাগ করা বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তবে এখন আর ওপরের চাপ না থাকায় বেআইনি এ সুবিধা না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে পুরোটাই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৬(খ)(১) অনুযায়ী, একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা গ্রুপকে একটি ব্যাংক তার মূলধনের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ ফান্ডেড এবং ১০ শতাংশ নন-ফান্ডেড ঋণ দিতে পারে। আর গ্রুপ বলতে কোনো ঋণগ্রহীতা তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানিকে বোঝানো হয়। গত জুন পর্যন্ত জনতা ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন ছিল দুই হাজার ৩১৪ কোটি টাকা। এর মানে একক কোনো গ্রুপকে ফান্ডেড ও নন-ফান্ডেড মিলিয়ে জনতা ব্যাংক সর্বোচ্চ ৫৭৮ কোটি ৫০ লাখ টাকা দিতে পারবে। কিন্তু এস আলম গ্রুপকে শুধুমাত্র জনতা ব্যাংকের একটি শাখা থেকেই দেয়া হয়েছে এক হাজার ৬৮৫ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। যদিও নতুন করে সুবিধার জন্য গত ২৫ জুন জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চেয়ে জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. আব্দুল জব্বারকে একাধিকবার মুঠোফোনে কল দিয়ে ও তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এসএমএস পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

এই ধরনের ঋণ প্রধান বন্ধ করা হবে কিনা জনতে চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক আমার সংবাদকে বলেন, ‘এস আলম গ্রুপের ঋণ প্রসঙ্গে আমি সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের (ডিওএস) সঙ্গে কথা বলে জানাতে পারব। তার আগে এ নিয়ে কিছু বলতে পারব না।’

জনতা ব্যাংকের আবেদন পর্যালোচনা করে বাংলাদেশ ব্যাংক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। ওই প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জনতা ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের ঋণ নবায়নের অনুমোদন দিলে মোট ঋণ সুবিধা হবে ১০ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। যা ব্যাংকটির মূলধনের ৪৫১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। ব্যাংক থেকে দেনা পরিশোধ করায় বারবার পেমেন্ট এগেইনেস্ট ডকুমেন্টের (পিএডি) মাধ্যমে ফোর্সড ঋণ সৃষ্টি হয়েছে। এ অবস্থায় ঋণ নবায়নের কোনো সুযোগ নেই।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। ওই দিন দুপুরেই দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার পলাতক থাকা অবস্থায় শুক্রবার পদত্যাগ করেছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিক্ষোভের মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করেছেন তার চারজন ডেপুটি গভর্নর, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন উপদেষ্টা ও বিএফআইইউ প্রধানসহ শীর্ষ ছয় কর্মকর্তা। জানা গেছে, এখন থেকে কেউ আর বেআইনি কোনো সুবিধা পাবে না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক বলেন, ২০১৬ সাল থেকে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ কোনো আইনের তোয়াক্কা না করেই প্রভাবশালীদের ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য থাকলেও ঋণ শোধ না করে ব্যাংকের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। বছরে বছরে কেবল সীমা বাড়িয়ে সুদও পরিশোধ করছে না। আবার ঋণ নিয়মিত থাকায় ব্যাংকও সুদ আয় খাতে নিতে পারছে। তিনি বলেন, আমদানিকারকের ব্যাংকের সমুদয় পাওনা শোধ করে পণ্য খালাস করার কথা। কোনো কারণে তখন দিতে না পারলে পণ্য বিক্রি করে দেয়ার কথা। অথচ এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এখন দেখার বিষয় পণ্য বিক্রির টাকা পাচার হয়েছে কিনা। এ বিষয়ে ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।

জনতা ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশেষ অনুমোদনের নামে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বেআইনি এ সুবিধা দেয়ার কারণে ঠিকমতো ঋণ আদায় করতে পারছেন না। অনাদায়ী ঋণ কেবল কাগুজে নিয়মিত দেখিয়ে ব্যাংকের স্বাস্থ্য ভালো দেখানো হচ্ছে। আইন লঙ্ঘন করে ব্যাংক এবং ঋণগ্রহীতা দুপক্ষকে সুবিধায় রেখে ঝুঁকিতে  ফেলা হচ্ছে আমানতকারীকে। চলতি বছরের ২৫ জুন জনতা ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের বৈঠকে এস আলম গ্রুপের ঋণ পুনঃতফসিল ও নবায়নের সিদ্ধান্ত হয়। এ ক্ষেত্রে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লি., এস আলম ট্রেডিং  কোম্পানি, এস আলম ভেজিটেবল অয়েল, গ্লোবাল ট্রেডিংয়ের নামে জনতা ব্যাংকের একটি শাখা থেকেই নেয়া হয়েছে এক হাজার ২১৫ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

এছাড়া এস আলম সুপার এডিবল অয়েল এবং এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলের নামে ৬৩০ কোটি টাকা নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। মোট ছয় প্রতিষ্ঠানের এক হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা চার বছরের জন্য পুনঃতফসিলের অনুমোদন দেয় জনতা ব্যাংকের পর্ষদ। একই দিন তিন হাজার ৯০০ কোটি টাকার চলতি মূলধন হিসেবে নেয়া ঋণসীমা ২০২৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নবায়ন প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এ প্রস্তাবে অনাপত্তির জন্য গত ৩০ জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি দেয় জনতা ব্যাংক। তবে সদ্য সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারের কথা বলে দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর খুরশীদ আলম দ্রুত নোট আকারে ওপরে পাঠানোর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দেয়। এই ধরনের ফাইল ওপরের নির্দেশে নোট প্রস্তুত করেন।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের কর্তৃত্বে থাকা সাত ব্যাংক ও চরম আর্থিক দুরবস্থায় থাকা দুটি ব্যাংকে ঋণ দানের ক্ষেত্রে নতুন নিয়ম জারি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত সপ্তাহে ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের ৮৪৮ কোটি টাকার বেনামি ঋণ আটকে দেয়া হয়। নতুন করে এসব ব্যাংক আর গ্রুপটির কোনো ঋণও ছাড় করছে না। জানা যায়, ৯টি ব্যাংকের এক কোটি টাকার বেশি চেক অন্য ব্যাংকগুলোকে উপস্থাপন বা ক্লিয়ারিং না করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

আরএস

Link copied!