দেশে গত ১ বছরে পানিতে ডুবে মৃত্যু হাজারের উপরে: জরিপ

বরগুনা প্রতিনিধি প্রকাশিত: জানুয়ারি ৪, ২০২৩, ১২:৪৪ পিএম

বাংলাদেশে দারিদ্র্য, অসচেতনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের অভাবের কারণে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর মত অনেক ঘটনা ঘটে চলছে। বাংলাদেশে ২০২২ সালে পানিতে ডুবে ৯ বছরের কম বয়সী শিশুদের মৃত্যুর হার বেড়েছে ৮ শতাংশ। এ সময় পানিতে ডুবে মৃতদের মধ্যে ৮১ শতাংশের বয়স ছিল ৯ বছরের কম। আগের বছরের তুলনায় এ হার ৮ শতাংশের বেশি। বেশিরভাগ সময়েই দেখা মিলছে বাড়ির ২০ গজ কিংবা ৩০ গজের আশেপাশে পুকুর কিংবা ডোবা-জলাশয়ে শিশু মৃত্যুর ঘটনাগুলো ঘটছে। মূলত সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে শিশু মৃত্যুর ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। 

এসময়ে মা-বাবা, বড় ভাই-বোন বা পরিচর্যাকারীরা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন। এছাড়াও উদ্বেগের বিষয় হলো বাড়ি আশেপাশের ডোবা-নালা-পুকুর- খাল-বিল সবকিছু উন্মুক্ত থাকা শিশু মৃত্যুর বড় কারন হিসেবে চিহ্নিত। শিশুরা অন্যদের অলক্ষ্যে অবাধে জলাশয়ে চলে যায় এবং দুর্ঘটনার শিকার হয়।

সম্প্রতি বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু বিষয়ক প্রশিক্ষণে এসব তথ্য জানিয়েছে গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান “সমষ্টি” ।

এছাড়াও গত ১২ মাসে অর্থাৎ ২০২২ সালে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী পানিতে ডুবে ১ হাজার ১৩০টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে ২০২০ ও ২০২১ সালে ৯ বছর বয়সীদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার ছিল যথক্রমে ৬৫% ও ৭৩%। এ দুই বছরে যথাক্রমে ৮০৭ ও ১ হাজার ৩৪৭টি মৃত্যুর খবর সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের গণমাধ্যম এবং বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে প্রকাশিত পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদন তৈরি করে গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ‍‍`সমষ্টি‍‍` ।

প্রকাশিত সংবাদের তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালে চট্টগ্রাম বিভাগে সর্বোচ্চ ২৮২ জন পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া রংপুর বিভাগে ১৬০, ঢাকা ১৪৯, বরিশালে ১৩১, রাজশাহীতে ১১০, ময়মনসিংহে ১০৪, খুলনা বিভাগে ১০৩ ও সিলেট বিভাগে ৯১ জন মারা যায়। ২০২২ সালে পানিতে ডুবে মৃতদের ৯৪ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। এদের মধ্যে ৪ বছর বা কম বয়সী ৫৫৬ জন, ৫ থেকে ৯ বছর বয়স ৩৬৩ জন, ১০-১৪ বছরের ১০২ জন এবং ১৫-১৮ বছরের ৪৩ জন। ৬৬ জনের বয়স ছিল ১৮ বছরের বেশি। এছাড়াও জেলাগুলোর মধ্যে বরগুনা ১০,পঞ্চগড় ৪৭, নেত্রকোণা ৪৭, চাঁদপুর ৪৬, কক্সবাজার ৪১ ও পটুয়াখালী জেলায় ৩৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ।

এছাড়াও বরগুনা সিভিল সার্জন অফিসের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বরগুনায় গত ৫ বছরে পানিতে ডুবে ১১৩ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে ২৫, ২০১৯ সালে ৩৪, ২০২০ সালে ২৮, ২০২১ সালে ১৬ ও ২০২২ সালে ১০ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রতিদিন পানিতে ডুবে ৫০ জনের মৃত্যু হয় যা বেসরকারি সংস্থা ‘সমষ্টি’ গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। এর মধ্যে ৫ বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যা ৩০ জন। ২০২২ সালে পানিতে ডুবে নিহতদের মধ্যে ৪১২ জন নারী। এদের মধ্যে কণ্যা শিশু ৪০০ জন। পুরুষ মারা যায় ৭০৮ জন, যাদের মধ্যে ৬৬৪ জনই শিশু। গত বছর প্রকাশিত সংবাদ থেকে মৃত ১০ জনের পরিচয় এখনো সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি । মৃত্যূর ঘটনাগুলো দিনের প্রথম ভাগে অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ৩৫৫ জন এবং দুপুর থেকে সন্ধার আগে ৬৮৬ জন মারা যায়। এছাড়া সন্ধার দিকে ৭০ জন মারা যায় এবং ১৯ জন রাতের বেলায় পানিতে ডোবে। বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর পানিতে ডুবে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। প্রতি ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টি ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যেখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়া পানিতে ডোবার কারণে বছরে প্রায় ১৩ হাজার শিশু স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর পানিতে ডুবে ২ লাখ ৩০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। প্রতি ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টি ঘটে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে যেখানে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়া পানিতে ডোবার কারণে বছরে প্রায় ১৩ হাজার শিশু স্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করে। শহরের চেয়ে গ্রামে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার বেশি, অধিকাংশ শিশুই বাড়ি থেকে ২০ মিটার এবং কম বয়সিরা ১০ মিটার দূরত্বেও কোনো পুকুর বা জলাশয়ের মধ্যে পড়ে মারা যায়। পরিবারের খুদে সদস্যের ওপর সঠিক নজরদারির অভাবে এমন করুণ পরিণতি দেখা যায়। সংখ্যায় বলতে গেলে, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনার ৬০ শতাংশ ঘটনা সকাল ৯টা থেকে বেলা ১টার মধ্যে হয়ে থাকে। কারণ এ সময় মায়েরা ব্যস্ত থাকেন গৃহস্থালি কাজে, বাবারা কাজের তাগিদে বাইরে থাকেন এবং ভাই-বোন থাকলে তারা হয়তো স্কুলে বা অন্য কাজে থাকেন।

মৃত্যুর কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিবছর বন্যার কারণে বাংলাদেশের স্থলভূমির একটি বড় অংশ পানিতে তলিয়ে যায়, ফলে সচেতনতা ও সাঁতারে দক্ষতার অভাব জীবনের জন্য হুমকি বয়ে আনে। গ্রামীণ এলাকার শিশুরা, যারা জলাশয়ের আশপাশে বেড়ে ওঠে, তারাও প্রতিদিন পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এ অঞ্চলে প্রলম্বিত বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণেই এত পানিতে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‍‍`সমষ্টি‍‍` জানায়- পানিতে ডুবে মৃত্যুর বেশিরভাগ ঘটনার তথ্য গণমাধ্যমের নজরে কমই আসে। এ নিয়ে জাতীয় ও স্থানীয় ভাবে কোনো কার্যকর তথ্য সংগ্রহের ব্যবস্থা এখনো গড়ে উঠেনি। আবার গণমাধ্যম প্রতিবেদনগুলো শুধুমাত্র ঘটনাকেন্দ্রিক হয়। যার কারনে এ নিয়ে গভীরতাধর্মী প্রতিবেদন চোখের সামনে কমই আসে। পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর মত গভীরতাধর্মী প্রতিবেদনে গণমাধ্যমগুলো গুরুত্ব দিলে ও প্রকাশ হলে বিষয়টি নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের গুরুত্ব পাবে এবং এ নিয়ে জাতীয় কর্মসূচি গ্রহণে বিষয়টি তরান্বিত হবে।

এবি