বরিশাল মহানগর বিএনপির সম্মেলন কবে, জানে না কেউ ?

আরিফ হোসেন, বরিশাল ব্যুরো প্রকাশিত: জুলাই ১৩, ২০২৫, ০৩:৫৯ পিএম
  • ‘তৃণমূলের ভোটেই স্থানীয় পর্যায়ে নেতা নির্বাচিত হবেন—এটাই তারেক রহমানের নির্দেশনা’ 
  • মহানগরের ৩০ ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের কার্যক্রম শেষ হলেই মহানগর বিএনপির সম্মেলন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিভাগের দায়িত্বে থাকা নেতৃবৃন্দরা

তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রশ্ন

  • ব্যর্থ নেতৃত্ব দিয়েই কি আগামীতে মহানগর বিএনপি চলবে, নাকি কাউন্সিল করে কিংবা নতুন নেতৃত্ব এনে দল পুনর্গঠন করা হবে?
  • কেন কেন্দ্রের নির্দেশ বারবার পিছিয়ে যায় !
  • হতাশা বাড়ছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মাঝে
  •  নির্বাচনের আগে কি সম্মেলন সম্পন্ন করা যাবে
  • ঢেলে কি সাজানো হবে সহযোগী সংগঠনগুলো

বরিশাল মহানগর বিএনপির পূর্ণাঙ্গ কমিটি ২০২১ সালে বিলুপ্ত করে নতুন ভাবে গঠন করা হয় আহ্বায়ক কমিটি। তবে তিন মাসের মধ্যে মহানগরকে সম্মেলনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে। কিন্তু চার বছরের বেশি সময় পার হলেও সেই নির্দেশনার বাস্তবায়ন হয়নি আজও।

তবে এর মধ্যে দুইবার কমিটি বদল হয়েছে, কিন্তু ফলাফল শূণ্যের কোঠায়। এমন অবস্থা যে শুধু মহানগরের ক্ষেত্রে তা কিন্তু নয়। বিভাগের অধিকাংশ জেলার একই চিত্র। 

এদিকে বরিশাল মহানগর বিএনপির বর্তমান ও সাবেক নেতারা কয়েকভাগে বিভক্ত হওয়ায় দলীয় কোন্দল চরম আকার ধারণ করেছে। দলীয় কর্মসূচির ক্ষেত্রেও বর্তমান ও সাবেকরা কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে পৃথক পৃথকভাবে পালন করায় বিশৃঙ্খলা দেখা গেছে। বার বার নির্ধারণ করা সময় অতিক্রম করলেও এখনও পর্যন্ত হয়নি সম্মেলন। 

বরিশাল মহানগর বিএনপিকে শক্তিশালী করার জন্য দলটি কাজ করলেও অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলো ঢেলে সাজানোর তেমন কোন উদ্যোগ দেখছেন বলে অভিযোগ নেতাকর্মীদের।

ইতিমধ্যে ২০২৫ সালের গত ১২ জুলাই অর্থাৎ দুই দিন আগে বিএনপি জাতীয় নির্বাহী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম প্রধান আবদুল আউয়াল মিন্টু স্বাক্ষরিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বরিশাল মহানগরের প্রতিটি ওয়ার্ডের কমিটি পুনর্গঠন করতে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক, সদস্য সচিব, যুগ্ম আহ্বায়ক ও নেতৃবৃন্দকে চিঠি দিয়েছেন। যার অনুলিপি বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, বরিশাল বিভাগের সহ-সাংগঠকিন সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান, সহ-সাংগঠকিন সম্পাদক মাহবুবুল হক নান্নু, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও বরিশাল মহানগর সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক ও বিভাগের সদস্য হাসান মামুন এর কাছে স্বাক্ষরিত অনুলিপি পৌঁছানো হয়েছে। 

চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, বরিশাল মহানগরের ওয়ার্ড কমিটি সমূহ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় গঠন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে সকল ওয়ার্ড বিএনপির সম্মেলনে ভোটার হওয়ার ক্ষেত্রে আহ্বায়ক, সদস্য সচিব ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়কের স্বাক্ষরিত ফরমে জমা দিতে হবে। 

মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব কর্তৃক গঠিত সাংগঠনিক টিমের মাধ্যমে জমাকৃত ফরম ব্যতীত কোন ফরম গ্রহণ করা হবে না এবং ওয়ার্ড বিএনপির সম্মেলনে ভোটার হিসেবে গণ্য করা হবে না। মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব কর্তৃক গঠিত সাংগঠনিক টিমের প্রধান কিংবা কোন সদস্য যদি উপরোক্ত নির্দেশনা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন না করেন, তাহলে যথাসময়ে সম্মেলন করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট টিম প্রধান ও সদস্যকে পরিবর্তন করে নতুন টিম লিডার ও সদস্য নিযুক্ত করবেন। এরপর বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক টিম ও সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিবেন বলে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

তৃণমূলের নেতাকর্মীদের প্রশ্ন আসছে—ব্যর্থ নেতৃত্ব দিয়েই কি আগামীতে বরিশাল বিএনপি চলবে, নাকি কাউন্সিল করে কিংবা নতুন নেতৃত্ব এনে দল পুনর্গঠন করা হবে? তবে দলের হাই কমান্ডের নেতারা বলছে, দল পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গ সংগঠনগুলোও ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

পর্যায়ক্রমে মেয়াদোত্তীর্ণ সব কমিটিই নতুন করে সাজানো হবে। তাই বরিশাল বিভাগের ছয় সাংগঠনিক জেলা ও বরিশাল মহানগর, উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটি পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে থাকা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা কাজ করে যাচ্ছে।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক নেতারা জানান, বরিশালে যোগ্য নেতৃত্ব না থাকায় কেউ কাউকে মানছেন না। অতীতে হেভিওয়েট নেতাদের ভুলের মাশুল গুনতে হচ্ছে বর্তমানে। এ নিয়ে সম্প্রতি বিএনপির স্থানীয় একাধিক নেতা অসন্তোষ প্রকাশ করে আসছেন। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বর্তমান কমিটি কাউন্সিল প্রশ্নে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা মানছেন না বলে অভিযোগ করছেন বর্তমান ও সাবেক নেতারা। 

সার্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, বর্তমানে মহানগর বিএনপি প্রধানত তিন ধারায় বিভক্ত। বর্তমান আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের একটি অংশ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা নাসরিনসহ অপর যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যদের একটি অংশ এবং মহানগর বিএনপির সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদুল কবির জাহিদের একটি অংশ। তারা যে যার মত দলীয় কর্মসূচি গুলো পালন করে যাচ্ছে। 

তবে একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, মহানগর বিএনপির বর্তমান কমিটির ওপর তাদের ক্ষোভের কারণেই এ বিভক্তি। দীর্ঘ ৩০ বছর বরিশাল বিএনপির নেতৃত্বে ছিলেন মজিবর রহমান সরোয়ার। এ সময়কালে বরিশাল বিএনপিতে সরোয়ার অনুসারী একটি বৃহৎ নেতা-কর্মী-সমর্থক গোষ্ঠী তৈরি হয়। কিন্তু ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলে সরোয়ার কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হন। এরপর ২০২১ ও ২০২৪ সালে বরিশাল মহানগর বিএনপির দুটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন হলেও ঐ দুই কমিটিতেই সরোয়ারের অনুসারীদের বাদ দেওয়া হয়। 

সরোয়ারের বিপুল কর্মী-সমর্থক ও বিএনপির সিনিয়র নেতৃবৃন্দ সাবেক সদস্য সচিব মীর জাহিদের সঙ্গে সমন্বয়ে রাজনীতির মাঠে ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় বরিশালের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের সৃষ্টি হয়েছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নেতারা বলেন, মহানগর বিএনপির কোন্দল দেখা দেওয়ায় গত বছরের ২৫ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের নির্দেশনা আসে কেন্দ্র থেকে। ঐ চিঠিতে ৯০ দিনের মধ্যে সম্মেলন শেষ করে কমিটি চূড়ান্ত করার নির্দেশ দেয় কেন্দ্র। পুরো বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টুকে। কিন্তু প্রস্তুতির শুরুতেই দেখা দেয় নেতৃত্বের কোন্দল। ৩০ নভেম্বর দলীয় কার্যালয়ে সভা আহ্বান করা হলেও অনুপস্থিত থাকেন অধিকাংশ সদস্য। সেখানে মহানগরের ৩০টি ওয়ার্ড কমিটি ভেঙে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি করার প্রস্তাব করেন সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার। সরাসরি সেই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা খানম নাসরিন। 

এরপর চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি বরিশাল মহানগর বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক করা হয় সাবেক ছাত্রনেতা বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য হাসান মামুনকে। ইতিমধ্যে আব্দুল আউয়াল মিন্টু, হাসান মামুন এবং সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানসহ মহানগর বিএনপির বিবদমান নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একাধিক বৈঠক করলেও কোনো সুরাহা হয়নি। পরে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান ফারুক ও সদস্য সচিব জিয়া উদ্দিন সিকদার স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় মহানগর বিএনপির বিলুপ্ত ৩০টি ওয়ার্ডের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের লক্ষ্যে যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্যদের সমন্বয়ে আটটি টিম গঠন করা হয়েছে। টিমগুলোর দায়িত্বে রয়েছেন মোট ৩৯ নেতা। 

সর্বশেষ রাজধানীতে বিবদমান মহানগর বিএনপির নেতৃবৃন্দকে নিয়ে বৈঠকে বসেন সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা দলের ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু, সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হাসান মামুন, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমানসহ অন্যরা। 

এদিকে দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে গত ২ জুলাই শুধুমাত্র সম্মেলন সম্পূর্ণ করতে পেরেছে পটুয়াখালী জেলা বিএনপি। আর সেই সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন (ভার্চুয়ালে) দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। 

তবে বরিশাল জেলা ও মহানগরের বিএনপির সম্মেলন কবে হবে সেই বিষয়টি স্পষ্ট করতে পারছেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠনের জন্য বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা দফায় দফায় নেতাদের সাথে বৈঠক করে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেননি এখনো। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলের মধ্যে বিভাজন আর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতার কারণে সংগঠনের এ অবস্থা তৈরি হয়েছে। দলের চেয়ে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার আর আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতায় সংগঠনের বারোটা বাজছে। গত চার বছর ধরে এখানে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। বিএনপির এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। অনেকে বলছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এখানে সম্মেলন সম্পন্ন করা যাবে কিনা এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। কারণ ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা কমিটি পুনর্গঠন এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। কবে যে শেষ হবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। অথচ সম্মেলন করে নতুন কমিটি উপহার দিতে গেলো বছরের ২৫ নভেম্বর কেন্দ্র থেকে সময় বেধে দেওয়া হয়েছিল ৬০ দিন। কিন্তু সম্মেলন না হওয়ায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। বেশির ভাগ জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় দলীয় শৃঙ্খলা হচ্ছে বিঘ্নিত। 

মহানগর ও কয়েকটি জেলার নেতারা হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ইতিমধ্যে বর্ষা মৌসুম শুরু হয়ে গেছে, এই সময়ে সম্মেলন আয়োজন বেশ কঠিন। ফলে আগামী শুষ্ক মৌসুমের আগে সম্মেলন সম্পন্ন করা যাবে কি না এ নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। 

অপর একটি সূত্র বলছে সম্মেলনের আগে দলীয় কোন্দলের বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে পুনর্গঠন প্রক্রিয়া সম্ভব হবেনা। এই মুহূর্তে সম্মেলন করতে গেলে নেতাকর্মীরা নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়াতে পারে। যা নির্বাচনী মাঠে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। 

মহানগর বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আফরোজা নাসরিন বলেন, বরিশালে বিএনপির সম্মেলন হবে। তার আগে মহানগরের ৩০ ওয়ার্ডের বিএনপির নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম চলছে। এই কার্যক্রম শেষে সম্মেলনের মাধ্যমেই প্রতিটি কমিটি গঠন করা হবে। এর পরই ইউনিটির কাউন্সিলদের ভোটের মাধ্যমে মহানগরের বিএনপির নতুন নেতৃত্ব আসবে। আশা করি সেই নেতৃত্বে কোন বিরোধ থাকবে না। সেভাবেই কাউন্সিলের ভোটাররা ভোট দিয়ে নেতা বানাবেন। 

নাসরিন আরও বলেন, পটুয়াখালী জেলায় যে রকমের সম্মেলন হয়েছে ঠিক একই ভাবে বরিশালেও বিএনপির সম্মেলন হবে। যেমন পটুয়াখালী সম্মেলনের দুই দিন আগে ইউনিটির কাউন্সিলরের সদস্যদের গোপন ভোটে নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত হয়েছে। বরিশালেও ঠিক সম্মেলনের আগে ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। যারাই নির্বাচিত হবে তারাই আগামী দিনে বরিশাল মহানগর বিএনপির নেতৃত্ব দিবে। তবে কবে বরিশাল বিএনপির সমাবেশ হবে তা তিনি নিজেও সঠিক জানেন না। জানেন বরিশালে বিএনপির সম্মেলন হবে নির্বাচনের আগে। 

মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব জিয়াউদ্দিন শিকদার জিয়া বলেন, মূলত আমাদের মধ্যে কোন গ্রুপিং না। বড় দল হিসেবে প্রতিযোগিতা। যেমন নেতৃত্বে যাওয়ার মত নেতাও বেশি, তাই প্রতিযোগিতা আছে এবং থাকবেই। আর প্রতিযোগিতা থাকাটাই ভালো মনে করি। 

মহানগর বিএনপির সমাবেশ কবে হবে জানাতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের হাই কমান্ড থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আগামী দেড় অথবা দুই মাসের মধ্যেই মহানগর বিএনপির সম্মেলন হবে। সেই নির্দেশ অনুযায়ী আমরা ইতি মধ্যে প্রস্ততিমূলক কার্যক্রম করছি। ওয়ার্ডগুলোতে সমাবেশের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হচ্ছে। কিছু দিনের মধ্যে সুষ্ঠু ও সুন্দর ভাবে মহানগর বিএনপিরও সম্মেলন হবে। সম্মেলনে কাউন্সিলের সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে মহানগরের বিএনপির নেতৃত্ব দেওয়ার মত ব্যক্তিকে নির্বাচিত করবে এটাই আমার আশা। 

নতুন নেতৃত্ব আসবে কী না জানতে চাইলে জিয়া বলেন, হাইকমান্ড গণতান্ত্রিকভাবে কমিটি গঠন করছে এবং করে যাবে। বিগত দিনের যারা রাজপথে থেকে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। মামলা-হামলা, জেল জুলুমের শিকার হওয়া নেতাদেরই কমিটিতে অধিকার দেওয়া হবে বলে আশা করেন। দলের ত্যাগী, জনবান্ধব, বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী এবং ক্লিন ইমেজের নেতাদের গুরুত্ব দেবে বিএনপি। 

বরিশাল বিএনপির ভোটের খনি হিসেবে পরিচিত। আর সেইখানে ইতিমধ্যে হানা দিতে চায় ইসলামী জোট এ প্রশ্নের উত্তরে জিয়া বলেন, যারাই যে দল করছে, তারাই জনগণকে জানান দিতে মাঠে নেমেছে। বিএনপির তো বরিশালের ঘরে ঘরে আছে। আমাদের চেয়ারর্পাসনের নির্দেশনা আসলেই দেখতে পারবেন আমরা ভোটের রাজনীতিতে আমরা কতটা ঐক্যবদ্ধ। 

মহানগর বিএনপির সাবেক কমিটির সদস্য সচিব মীর জাহিদুল ইসলাম বলেন, বরিশাল মহানগর বিএনপির পূর্নকমিটি গঠনের লক্ষ্যে হাইকমান্ড থেকে কয়েকবার নির্দেশ এসেছিল। সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্নকমিটি গঠন নির্দেশ দিয়েছিলো কয়েকবার। কিন্তু বিভাগীয় টিম সেটা করতে সক্ষম হয়নি এখন পর্যন্ত। নতুন করে যে সিদ্ধান্তটি কেন্দ্র থেকে দেওয়া হয়েছে, সেটা করতে পারলে খুবই ভালো হয়। তবে যতদিন, যতসময় পিছিয়ে দেওয়া হবে ততই নিজেদের মধ্যে কোন্দল বাড়বে বলে মনে করি। 

তিনি আরও বলেন, বর্তমানে যারা সদস্য ফরম বিতরণ করছে তাদের মধ্যে ফ্যাসিস্ট বাহিনীর লোকও রয়েছে। তবে সম্মেলনের সময় কাউন্সিলের মাধ্যমে ওয়ার্ডের নেতৃত্ব দেওয়া সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে মহানগরের নতুন কমিটির ঘোষণা এবং নেতা নির্বাচন হবে, এটা খুবই একটা ভালো দিক। তবে সেটা কতটা বাস্তবায়ন হয় সেটাই হলো মূল বিষয়।  

মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান ফারুক বলেন, গত ২৮ জুন আমাদের বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ও টিম প্রদান বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু তিনি বিএনপির নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম উদ্বোধন করেছে। তারই ধারাবাহিকতা হিসেবে আমরা পুরো দমে মহানগরের ৩০ ওয়ার্ডের নতুন সদস্য সংগ্রহ ও নবায়ন কার্যক্রম চলছে। এটা শেষ হলেই আমরা প্রতিটি ওয়ার্ডে সম্মেলন করবো। তার পরে মহানগর বিএনপির সম্মেলন হবে। 

তবে কবে হবে মহানগরের সম্মেলন সেই সিদ্ধান্ত অথবা সময় এখন পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়নি। নির্বাচনের আগে মহানগর বিএনপির সম্মেলন হবে কী না জানতে চাইলে তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে আমরা চেষ্টা করবো সম্মেলন করার। 

মহানগর বিএনপির মধ্যে বিরোধ দেখা যাচ্ছে কেন! প্রশ্নের উত্তরে মনিরুজ্জামান বলে, এটা বিরোধ কোথায়, বিরোধ কীসের। বিএনপি সর্ববৃহৎ দল বাংলাদেশে। এখানে হাজার হাজার নেতাকর্মী। এখানে প্রতিযোগিতা আছে কিন্তু বিরোধ নাই, বিরোধ কীসের। আমরা তো বলি না আমাদের মধ্যে কোন বিরোধ আছে। এটা প্রতিযোগিতা চলতেছে। প্রতিযোগিতা থাকবেই। এখানে সব মিলিয়ে কত জন। তার মধ্যে বিরোধ থাকবে কি ভাবে। 

বরিশালের বিএনপির ভোটে মাঠে ইসলামী জোট দখলে চেষ্টা প্রশ্নের উত্তরে মনিরুজ্জামান বলেন, বিএনপি তো মাঠেই রয়েছে। আজ ১৭ বছর ধরে মাঠে রয়েছে। ভোটের মাঠে এখন তাদের দেখা যাচ্ছে না কেন! নির্বাচনী শিডিউল ঘোষণার পরে বিএনপি নির্বাচনী প্রচারণায় মাঠে নামবে। তখন দেখবেন ভোটের মাঠ কাঁধের দখলে।  

তিনি আরও বলেন, জামায়েত ইসলাম কখনো বলছে তারা নির্বাচনে যাবে, আবার কখন বলছে যাবে না। তার মধ্যে ইতিপূর্বে প্রার্থী ঘোষণাও করেছে তারা। 

বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য ও বরিশাল সদর-৫ আসনের বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী আবু নাছের মোহাম্মদ রহমতুল্লাহ জানিয়েছেন, নেতৃত্বে প্রতিযোগিতা থাকা ভালো কিন্তু নোংরামি করে পরস্পরের বিরুদ্ধে কাদা ছোড়াছুড়ি করা দলের জন্য মঙ্গলজনক নয়। তাই বরিশালের রাজনৈতিক অভ্যন্তরীণ বিরোধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ছোট খাটো যে বিরোধ গুলো রয়েছে সব সমাধানের মধ্যে দিয়ে চলতি বছরের জুলাই মাস বা আগস্টের মাসের মধ্যে বরিশালে বিএনপির সম্মেলন হবে। আর এই সম্মেলনের নির্যাতন আর জেল-জুলুমের শিকার হওয়া প্রবীণ ও তরুণরা অগ্রাঅধিকার পাবে বলে তিনি আশা করেন। আর আগামী দিনে তারাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে বিএনপিকে নতুন একটি রূপে নিয়ে আসবে। 

বরিশাল মানেই ধানের র্শীষের খনি, সেই খনির স্থান ইসলামী জোট নেওয়ার জন্য ইতিপূর্বে তারা মাঠে নেমেছে। জনগণের দ্বারে ছুটে গিয়ে কৌশল বিনিময় ও দোয়া চাচ্ছেন ইসলামী জোটের দলগুলোর নেতৃবৃন্দরা। এমন প্রশ্ন তাকে করা হলে রহমতুল্লাহ বলেন, রাজনৈতিক দল মানেই জনগণের সেবা করা। তাই তারা তাদের দলের পক্ষ থেকে মানুষকে কাছে যাচ্ছে। তবে এই দেশের মালিক হচ্ছে দেশের জনগণ। জনগণ নির্ধারিত করবে কে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। 

তিনি আরও বলেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে গণতন্ত্রের বাংলাদেশ। নির্বাচন হলে আল্লাহর রহমতে বিএনপিকে দেশের জনগণ আবারও ভোট দিয়ে দেশ চালানোর দায়িত্ব দিবে বলে তিনি আশা করেন। তবে আগামীর বাংলাদেশ হবে গণতন্ত্রের বাংলাদেশ। নির্বাচন হলেই তারেক রহমান আল্লাহর রহমতে এই দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। আগামী দিনে আমরা জনগণের পাশে থাকবো। বিএনপি জনগণকে নিয়ে পথ চলতে চায়।’ 

বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য, বরিশাল বিভাগে বিএনপির কমিটি পুনর্গঠনের দায়িত্বে থাকা এবং বরিশাল মহানগর বিএনপির সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক হাসান মামুন বলেন, আসলে আমরা তো কমিটি পুনর্গঠনের জন্য বরিশাল বিভাগের তৃণমূল থেকে শুরু করেছি। তাই প্রথমে ওয়ার্ড ভিত্তিক সম্মেলন হবে। যদি ওয়ার্ডভিত্তিক সম্মেলন না হয় তাহলে সাধারণ সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে ওয়ার্ডগুলোতে পুর্নাঙ্গ কমিটি গঠন করা হবে। আর সেই কমিটির সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে বরিশাল মহানগর বিএনপির কমিটি হবে। 

তিনি আরও বলেন, আয়োজনের মাধ্যমেই মহানগর বিএনপির সম্মেলন হবে। 

তবে তরুণ নেতৃত্ব আসবে কী না জানতে চাইলে হাসান মামুন বলেন, ওয়ার্ড বিএনপির কমিটিতে থাকা সদস্যরা তাদের ভোটে মাধ্যমে মহানগরের নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিকে নির্বাচিত করবে। সেখানে তরুণ অথবা পুরানো যে কেউ নির্বাচিত হতে পারে। কবে বরিশালে সম্মেলন হবে সেই সময় নির্ধারণ করা হয়েছে কিনা এবং দলের মধ্যে কোন্দল-গ্রুপিং রয়েছে সেটা সমাধান হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গ্রুপিং এবং দ্বন্দ্ব সব সমস্যা মিটিয়ে যখন ভোটের মাধ্যমে নেতৃত্বদানকারী নির্বাচিত হবে। আশা করি তখন আর দলের মধ্যে গ্রুপিং এবং দ্বন্দ্ব নিরসন ঘটবে। 

সার্বিক বিষয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির বরিশাল বিভাগের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আকন কুদ্দুসুর রহমান বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল। এখানে অভ্যন্তরীণ বিরোধ, প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে। কিন্তু বরিশাল মহানগর কমিটিতে যা হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না। বিষয়টি নিয়ে হাইকমান্ড অবগত। তারা বিষয়টি দেখবেন। 

তিনি আরও বলেন, তারেক রহমানের নির্দেশনা মেনে সকল দ্বন্দ্ব নিরসন করে একসাথে পথ জন্য কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা সেদিকে আগাচ্ছে। আশা করি খুব শীঘ্রই দ্বন্দ্ব নিরসন করে মহানগর বিএনপির সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বকারীকে নির্বাচিত করবে কাউন্সিল। যেখানে কোন দ্বন্দ্ব অথবা বিরোধ থাকবে না। 

বরিশাল বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সহ-সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলেন, আমি মনে করি দলের মধ্যে বিভাজন নেই, আছে প্রতিযোগীতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এটা গণতন্ত্রেরই একটা অংশ। বিগত সময়ে সরকারের দমন-নিপীড়ন এবং করোনার কারণে সঠিক লক্ষ্যে পৌঁছানো যায়নি। ইতি মধ্যে আমরা বেশ কিছু জায়গায় সম্মেলন করেছি। আশা করি খুব শীঘ্রই বরিশালেও বিএনপির সম্মেলন হবে। 

তবে তা কবে হচ্ছে তা নিদিষ্ট কোন সময় এখনও দেয়নি তারা। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের ত্যাগী, জনবান্ধব, বিগত সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী এবং ক্লিন ইমেজের নেতাদের গুরুত্ব দেবে বিএনপি।  

তিনি আরও বলেন, যারা দলকে ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করে সুবিধা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন, তাদের বিষয়ে বিভাগীয় টিম সতর্ক রয়েছে। 

এ বিষয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, আমরা লক্ষ্য করছি বরিশাল জেলা ও মহানগর বিএনপির নেতারা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়েছেন। এতে করে দলের ক্ষতি হচ্ছে। কিন্তু দলের স্বার্থে ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। আশা করি বরিশালে সম্মেলনের মাধ্যমে কোন বিরোধ থাকবে না। 

এছাড়াও বরিশাল জেলা বিএনপির কমিটি পুনর্গঠনের কার্যক্রম প্রায় শেষে দিকে। নেতাকর্মীরা আশা চলতি মাসেই জেলা বিএনপির সম্মেলন হবে। সেখানে ভোটের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব আসবে। 

এছাড়াও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি কয়েকজন নেতা বলেন, বিএনপি একটি বড় রাজনৈতিক দল, এখানে মতবিরোধ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকতেই পারে, তবে সেটি দ্বন্দ্ব নয়।’ এটা প্রতিযোগিতা। দীর্ঘ ১৭ বছরের ব্যবধানে সংগঠনের কার্যক্রমে কিছু ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক। তবে যেকোনো পরিস্থিতিতে নেতারা তৃণমূলের ভোটেই নির্বাচিত হবেন-এটাই তারেক রহমানের নির্দেশনা।’

ইএইচ