ব্রয়লার মুরগিতে আইবিএইচ রোগের মারাত্মক সেরোটাইপ শনাক্ত

বাকৃবি প্রতিনিধি প্রকাশিত: মে ২৯, ২০২৫, ০৪:৪৭ পিএম

দেশে প্রথমবারের মতো ব্রয়লার মুরগির দেহে ইনক্লুশন বডি হেপাটাইটিস (আইবিএইচ) রোগ সৃষ্টিকারী ফাউল অ্যাডেনোভাইরাসের দুটি মারাত্মক সেরোটাইপ—৮বি ও ১১—সনাক্ত করেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক এবং সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সিকৃবি) উপাচার্য ড. মো. আলিমুল ইসলাম ও তাঁর গবেষক দল।

বাস-ইউএসডিএ'র অর্থায়নে পরিচালিত এ গবেষণায় অধ্যাপক আলিমুল ইসলামের সঙ্গে কো-পিআই হিসেবে ছিলেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম এবং বাকৃবির একাধিক স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী।

অধ্যাপক আলিমুল ইসলাম জানান, ইনক্লুশন বডি হেপাটাইটিস (আইবিএইচ) একটি উদীয়মান ভাইরাসজনিত রোগ। এর উৎস ফাউল অ্যাডেনোভাইরাস, যার ১১টি সেরোটাইপ ও ৫টি জেনোটাইপ রয়েছে। এর মধ্যে ৮বি ও ১১ সেরোটাইপ সবচেয়ে ভয়াবহ এবং তা ব্রয়লার ছাড়াও লেয়ার মুরগিকে আক্রান্ত করতে পারে। 

তিনি বলেন, ২০১৮ সালের দিকে দেশে হঠাৎ করে তিন থেকে ছয় সপ্তাহ বয়সী ব্রয়লার মুরগির ব্যাপক মৃত্যু শুরু হয়, যা প্রথমে বার্ড ফ্লু বা রানীক্ষেত বলে ধারণা করা হলেও পরবর্তীতে এটি একটি নতুন ভাইরাস হিসেবে চিহ্নিত হয়। তখন শুধু ভাইরাসটির উপস্থিতি শনাক্ত করা গেলেও আইসোলেশন সম্ভব হয়নি।

আইবিএইচ ভাইরাসে আক্রান্ত মুরগিতে খাবার গ্রহণে অনীহা, দুর্বলতা, ডায়রিয়া এবং অবসন্নতা দেখা দেয়। রোগের প্রকোপ ১৪-২১ দিন বয়সের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এবং এতে মুরগি বাজারজাতের আগেই মারা যায়, ফলে খামারিরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন।

পোস্টমর্টেমে গিজার্ডের অভ্যন্তরীণ স্তর নরম হয়ে খসে পড়ে, লিভার ও কিডনিতে ফোকাল নডুলার গ্রোথ এবং হৃদপিণ্ডে হাইড্রোপেরিকার্ডিয়াম দেখা যায়।

ভাইরাসটি উভয়ভাবে—ভার্টিক্যাল (ডিমের মাধ্যমে) ও হরিজন্টাল (এক মুরগি থেকে অন্য মুরগিতে)—সংক্রমিত হতে পারে।

গবেষকরা কনভেনশনাল পিসিআর, আরটি-পিসিআর এবং এভিয়ান এমব্রায়োতে ভাইরাস আইসোলেশনের মাধ্যমে আংশিক জিনোম সিকোয়েন্স বিশ্লেষণ করেন। হোল জিনোম সিকোয়েন্সের কাজ চলমান রয়েছে।

পরবর্তীতে তারা একটি পরীক্ষামূলক ভ্যাকসিন তৈরি করেন এবং ফিল্ড ট্রায়ালের মাধ্যমে এর কার্যকারিতা প্রমাণ করেন। এক বছর ধরে পর্যবেক্ষণের পর দেখা যায়, ভ্যাকসিনপ্রাপ্ত মুরগিগুলো আইবিএইচে আক্রান্ত হয়নি।

ভ্যাকসিনটি এখনও পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। তিনটি ট্রায়ালের পর একটি পূর্ণাঙ্গ গবেষণাপত্র আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশের পরিকল্পনা রয়েছে। বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন বলে জানান অধ্যাপক আলিমুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “দেশে এখন পর্যন্ত কেউ আইবিএইচের ভ্যাকসিন তৈরি করেনি। কয়েকটি কোম্পানি বিদেশ থেকে আমদানি করলেও তা সহজলভ্য নয়। ফলে প্রান্তিক খামারিরা এটি ব্যবহার করতে পারছেন না।”

স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ডিম ব্যবহার করে ভ্যাকসিন তৈরির ফলে খরচ কম হয় এবং প্রতিটি ডিম থেকে গড়ে ২১ ডোজ তৈরি করা সম্ভব। আমদানিকৃত ভ্যাকসিনের তুলনায় এর দাম অর্ধেকেরও কম হবে। এ ভ্যাকসিন স্থানীয় ভাইরাসের অ্যান্টিজেন ব্যবহার করে তৈরি হওয়ায় তা অধিক কার্যকর এবং দ্বিগুণ অ্যান্টিবডি উৎপাদনে সক্ষম।

রোগ প্রতিরোধে খামারিদের শুধু ভালো চিকিৎসায় নির্ভর না করে এমন হ্যাচারি থেকে বাচ্চা সংগ্রহের পরামর্শ দেন যাদের প্যারেন্ট বা গ্র্যান্ড প্যারেন্ট স্টকে ভ্যাকসিন দেওয়া আছে। এতে মায়ের অ্যান্টিবডির মাধ্যমে বাচ্চা অন্তত ২১ দিন পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকবে।

আইবিএইচ ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হয় না (জুনোটিক নয়)। তবে আক্রান্ত মুরগির কলিজা ও হৃদপিণ্ড খাওয়ার পরিবর্তে ফেলে দেওয়া উচিত। রান্নার তাপে ভাইরাসটি ধ্বংস হয়ে যায়, ফলে মাংস ও ডিম খাওয়া নিরাপদ।

ভবিষ্যতে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP) মডেলে এই ভ্যাকসিনটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের মাধ্যমে খামারিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব। এতে কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন গবেষক দল।

ইএইচ