জুলাই সনদের খসড়া প্রস্তুত করে ফেলেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। খসড়াটি সোমবার (২৮ জুলাই) দেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এর আগে খসড়াটি সোমবার (২৮ জুলাই) দেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছে পাঠানো হবে বলে জানিয়েছিলেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, দলগুলো দ্রুত মতামত দিলে সেটা সন্নিবেশিত করা হবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের জুলাই সনদের খসড়ায় যা রয়েছে-
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ঐকমত্য কমিশন গঠিত হয় ৬ টি সংস্কার কমিশনের প্রধানকে নিয়ে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. আলী রিয়াজ কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার বৈঠকগুলোতে সভাপতিত্ব করেন।
জুলাই সনদের খসড়ার ব্যাপারে ২/৩ দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চূড়ান্ত মতামত দিবে। সেটা বিবেচনায় নিয়ে ৫ আগস্টের আগেই জুলাই সনদ চূড়ান্ত হওয়ার কথা। রাজনৈতিকগুলোর নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষরসহ জুলাই সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
৫ আগস্ট হাসিনা সরকারে পতন দিবস ও জুলাই বিপ্লবের বার্ষিকী ও ৮ আগস্ট ড. ইউনূস সরকারর দায়িত্ব গ্রহণের বছরপূর্তির মধ্যে যে কোন দিন জাতির উদ্দেশ্য ভাষণ দেয়ার কথা রয়েছে। সেদিন তিনি নির্বাচনের সম্ভাব্য সময় ইতোপূর্বে ঘোষিত আগামী এপ্রিলের প্রথমার্ধের পরিবর্তে ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে করার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাও দিতে পারেন।
যেসব বিষয়ে রাজনৈতিকদলগুলো ঐকমত্য হয়েছে সেগুলো হচ্ছে
এক. তত্ত্বাবধায়ক সরকার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা এবং এর পূর্বতন গঠন প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সরকারি ও বিরোধীদলের নেতা ও অন্যান্যদের নিয়ে কমিটি গঠন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান নিয়োগ।
দুই. সর্বোচ্চ ১০ বছর কোন একজন ব্যক্তি প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন।
তিন. সংসদের ১০০ সদস্যের উচ্চ কক্ষ গঠন এবং নারী আসন ৫০ থেকে বৃদ্ধি করে ১০০ করা। উচ্চ কক্ষের সদস্য দলগুলোর মোট ভোটের আনুপাতিকহারে করার পক্ষে জামায়াত এনসিপিসহ বেশ ক’টি দল অবস্থান নিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ বেশ কিছু দল নির্বাচিত ৩০০ সংসদ সদস্যের আনুপাতিকহারে উচ্চ কক্ষের সদস্য নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
এখন পর্যন্ত যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে
১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন : জাতীয় সংসদে অর্থবিল ও আস্থাভোট ছাড়া সব বিষয়ে দলের বিপক্ষে ভোট দিতে পারবেন সংসদ সদস্যরা। তবে বিষয়টিতে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে একমত হয়েছে বিএনপি। দলটি জানিয়েছে, তারা ক্ষমতায় গেলে দুটোর সঙ্গে সংবিধান সংশোধন এবং জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যুতে দলের বিপক্ষে এমপিরা ভোট দিতে পারবেন না, এ বিধান যুক্ত করবে।
২. সংসদীয় স্থায়ী কমিটি : সরকারি হিসাব কমিটি, অনুমিত হিসাব কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি ও বিশেষ অধিকার-সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি-এই চারটি সংসদীয় কমিটির সভাপতি যিনি হবেন বিরোধী দল থেকে নেওয়া হবে। চারটি স্থায়ী কমিটিসহ জনগুরুত্বপূর্ণ কমিটিগুলোতে সংখ্যা আনুপাতিক হারে বিরোধী দল থেকে সভাপতি পদ দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়েছে দলগুলো।
৩. নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় যথাযথ দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের নিয়ে একটি বিশেষায়িত কমিটি গঠনের মাধ্যমে সংসদীয় এলাকার সীমানা নির্ধারণের কথা বলা হয়। এরপর প্রতি আদমশুমারি অনধিক ১০ বছর পর সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণের জন্য সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদের দফা একের ‘ঘ’ শেষে আইনের দ্বারা একটি বিধান যুক্ত করা। এর অর্থ হচ্ছে, সংসদীয় আসন নির্ধারণ করার জন্য একটি কমিটি গঠন করা।
৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান : রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের বিষয়ে একটি সুপারিশ কমিটি বা বোর্ড গঠন করা হবে। এ কমিটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমার বিষয়ে পরামর্শ দেবে।
৫. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ: বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্টের স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপনে একমত হয়েছে দলগুলো। তবে বিএনপির পক্ষে প্রস্তাব করা হয়েছে বিষয়টির জন্য সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ নিতে হবে। নাগরিক সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য উপজেলা পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে অধস্তন আদালত স্থাপনে একমত হয়েছে দলগুলো। একই সঙ্গে বিদ্যমান চৌকি আদালত, দ্বীপাঞ্চল ও ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত উপজেলা আদালতকে স্থায়ী আদালত করে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণের পরামর্শ দিয়েছে দলগুলো।
৬. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ: আপিল বিভাগ থেকে জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেবেন। কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট নির্বাচনে ইশতেহার-পূর্বক যদি জনগণের ম্যান্ডেট লাভ করে, তাহলে তারা আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দুজন বিচারপতি থেকে একজনকে রাষ্ট্রপতি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ করবেন। এমন বিধান সংযোজন করতে পারবে। তবে অসদাচরণ বা অসামর্থ্য অভিযোগের কারণে ৯২ অনুচ্ছেদের অধীন কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান থাকলে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
৭. জরুরি অবস্থা ঘোষণা: জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ সংশোধনের প্রস্তাব করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে বলা হয়েছে, ১৪১-এর ক(১) ধারা মতে, রাষ্ট্রপতির নিকট যদি সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হয় যে, এমন জরুরি অবস্থা বিদ্যমান রয়েছে, যা যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের দ্বারা বাংলাদেশ বা এর যেকোনো অংশের নিরাপত্তার বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন, তাহলে তিনি অনধিক নব্বই দিনের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার আগেই মন্ত্রিসভার লিখিত অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। মন্ত্রিসভার ওই বৈঠকে বিরোধীদলীয় নেতা বা বিরোধীদলীয় উপনেতা উপস্থিত থাকবেন।
৮. সংবিধান সংশোধন: সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে আলোচনায় দলগুলো প্রায় ঐকমত্যে পৌঁছেছে। কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়, নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ, উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোট। নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ, উচ্চকক্ষে সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, গণভোটের ব্যবস্থা না থাকা এবং উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে পর্যন্ত নিম্নকক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ এবং সুনির্দিষ্ট বিষয়ে গণভোট। বিদ্যমান সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অন্তর্ভুক্তির পর ভবিষ্যতে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পরিবর্তনের ক্ষেত্রে গণভোটের প্রয়োজন হবে।
যে সাতটি বিষয়ে এখনো একমত হয়নি দলগুলো
১. সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি (আগে ছিল জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল-এনসিসি)। প্রস্তাবটিতে আপত্তি বিএনপি, এনডিএম, লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের। এ ছাড়া জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, সিপিবি, বাসদসহ সংলাপে অংশ নেওয়া বাকি ২৪টি দল প্রস্তাবের পক্ষে।
২. দ্বিকক্ষের সংসদ: দ্বিকক্ষের সংসদের বিরোধিতা করছে সিপিবি ও বাসদ। বাকি ২৮টি দল একমত। নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোর মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপি, এনডিএম, লেবার পার্টি, ১২-দলীয় জোট ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট বিদ্যমান সংরক্ষিত নারী আসন বণ্টনের মতো উচ্চকক্ষের আসন বণ্টনের পক্ষে মত দিয়েছে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন সংখ্যানুপাতিকে উভয় কক্ষের নির্বাচনের দাবি করেছে। এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, এবি পার্টি, জেএসডি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ বাকি ২১টি দল সংখ্যানুপাতিকে (পিআর) উচ্চকক্ষের প্রস্তাব করেছে। এরই মধ্যে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রস্তাবটি প্রত্যাহারের জন্য অনানুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে। তবে কমিশন সূত্রে জানা গেছে, এরপর বিষয়টি নিয়ে দলটির উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ করা হচ্ছে।
৩. সংসদে নারী আসন: সংসদে নারী আসন বাড়ানোর পক্ষে অধিকাংশ দলই একমত। বিএনপি ও তার সমমনা চারটি দল বিদ্যমান ব্যবস্থায় আসন বণ্টনের পক্ষে। জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন সংখ্যানুপাতিক হারে নির্বাচন হলে ১০০ আসনের পক্ষে। এনসিপি, গণসংহতি আন্দোলন, সিপিবি, বাসদসহ কয়েকটি দল সরাসরি নির্বাচনের পক্ষে।
৪. রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি: বিএনপি ও তার সমমনা চারটি দলে এবং জোট সংসদ সদস্যদের গোপন ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে। জামায়াতসহ অধিকাংশ দল ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের পক্ষে। দু-একটি দল সরাসরি ভোট চেয়েছে।
৫. রাষ্ট্রের মূলনীতি: বিএনপি, জামায়াতসহ অধিকাংশ দল কমিশনের প্রস্তাবিত পাঁচটি মূলনীতির পাশাপাশি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত হওয়া আল্লাহর ওপর অবিচল আস্থা ও বিশ্বাস যুক্ত করার পক্ষে। এনসিপি কমিশনের প্রস্তাবে একমত। সিপিবি, বাসদসহ বামপন্থি দলগুলো কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে বিদ্যমান মূলনীতি রাখার পক্ষে।
৬. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল: একজন ব্যক্তি জীবনে সর্বোচ্চ ১০ বছর প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। বিষয়টি নিয়ে দলগুলো একমত হয়েছে। তবে বিএনপি বলেছে, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি হলে (এনসিপি) তারা প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে।
৭. তত্ত্বাবধায়ক সরকার: দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা আবার প্রবর্তন করতে দলগুলো একমত। তবে গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে দলগুলোতে দ্বিমত রয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে।
এখনো আলোচনা হয়নি
১. সংসদ সদস্যদের একাধিক পদে থাকার বিধান।
২. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান।
৩. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত বিধান।
৪. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব (অনুচ্ছেদ ৪৮) (৩)।
ইএইচ