শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র‍্যাগিং

নতুনের মুখে ভয় আর শঙ্কা, সিনিয়রদের ভাবনায় কি শুধুই নিষ্ঠুরতা?

আবু হাসনাত তুহিন প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২৩, ১২:০৮ পিএম
আবু হাসনাত তুহিন

ফাগুনের নবীন আনন্দে/ গানখানি গাঁথিলাম ছন্দে॥/ দিল তারে বনবীথি কোকিলের কলগীতি,/ ভরি দিল বকুলের গন্ধে॥

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার এই চরণগুলো নবীনদেরকে গান, ছন্দ, কোকিলের গীতি ও বকুলের গন্ধ দিয়ে আলিঙ্গন করতে পারলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেন তার উল্টোচিত্র। যেখানে পা রাখতেই সিনিয়রদের ধরাশয়ী হতে হয় ‘মোস্ট জুনিয়র’ খ্যাত নবীনদের। অনেকটা ফাঁদে আটকে পড়ার মতো। পাখি শিকারীরা ফাঁদ পেতে ওত পেতে থাকে কখন শিকারী আসবে ঠিক তেমনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পা রাখতে না রাখতেই নবীনদের পড়তে হয় শিকারের কবলে। এক্ষেত্রে আগে থেকেই যেন প্রস্তুত হয়ে থাকেন শিকারী নামক সিনিয়ররা। নির্দিষ্ট করে ধরতে গেলে বলতে হবে ইমিডিয়েট সিনিয়র খ্যাত মোসাহেবদের কথা। যারা অনেকটা ক্যাম্পাসে ত্রাসের রাজত্ব করেন, জড়িয়ে পড়েন র‍্যাগিং নামক ব্যাধিতে।

প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নতুনরা যখন আসতে থাকেন তখন তারা এমনিতেই অনেকটা ভয়ে থাকেন। নতুন স্থানে এসে অনেকটা অপ্রস্তুতও থাকেন বটে। ঠিক এমন সময় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়ররা নেমে পড়েন ম্যানার শেখানোর কাজে। তাদের ভাবনায় উঁকি দেয় যেন তারা আগে ম্যানার শিখে আসেন নাই। বিশেষ করে নবীনরা হলে র‍্যাগিংয়ের শিকার হন বেশি। কারণ হলে নতুন যারা আসেন তারা শুরুতেই রুম পান না। তাদেরকে দীর্ঘ একটা সময় থাকতে হয় গণরুমে। এমন পরিস্থিতিতেও তাদেরকে  অমানবিক জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়। হলে অবস্থানরত কোনো সিনিয়রই তাদেরকে ভালোভাবে নিতে পারেন না। তাদেরকে ছোট ভাই-বোনের আসনটি ছেড়ে দিতে নারাজ থাকেন সিনিয়ররা। ঠিক এমন সময় হলগুলোতে মাস্টার রোলের ভূমিকায় থাকেন ইমিডিয়েট সিনিয়ররা।

নির্যাতন, অত্যাচার ও জুলুমের ঘটনাগুলোকে আমি শিল্পরুপ কিংবা কাব্যিক রুপ দিতে চাই না। কারণ সেগুলো আমাকে অনেক অনেক বেশি পীড়া দেয়। এগুলোর মাত্রা এত বেশি যা কোনো সাধারণ মানুষ সহজভাবে মেনে নিবেন না। যাঁরা তাদের সন্তানকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঠান তাদের জন্য এগুলোর বর্ণনা হয়তো আরও পীড়াদায়ক। যাইহোক নতুনরা যখন গণরুমে অবস্থান করেন তাদেরকে রাতভর কানে ধরে কয়েকশত থেকে কয়েকশতবার উঠবোস করানোর সাথে সাথে ননস্টপ সালাম , অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করা, খাট কিংবা টেবিলের নিচে মাথা রেখে শরীর ভারসাম্য অবস্থায় রাখা, গ্রিলে ঝোলানো, খাটের নিচ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়া, অশালীন কাজ করানোসহ প্রতিষ্ঠানভেদে র‍্যাগিংয়ের মাত্রা থাকে আরও ভয়ানক।

এভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকে। সবকিছু সয়ে সকাল সকাল নতুন শিক্ষার্থীদের গায়ে-পায়ে ব্যাথারত অবস্থায় ক্লাস করতে যেতে হয়। কেউ কেউ তীব্র ব্যাথায় ঘুম থেকে উঠে ক্লাস করার আগ্রহ পান না। কোনো কোনো শিক্ষার্থী এসব সহ্য করতে না পেরে হল থেকে পালিয়েও যায়। অনেকে মনে করে হল থেকে পালালেই বুঝি নিস্তার মিলবে। তবে নতুনদের নিস্তার এত সহজে শেষ হয় না। কারণ হল থেকে পালালেও র‍্যাগিংয়ের শিকার হতে হয় নিজ নিজ বিভাগের সিনিয়রদের কাছে। নতুনদের ডেকে মিটিং দেয়া হয়। মিটিংয়ে উপস্থিত না হলে আরও বেশি সমস্যায় পড়তে হয়। ডেকে এনে মিটিংয়ে উপস্থিত করিয়ে শাসানো হয়, হলে উঠার জন্য দেয়া হয় আল্টিমেটাম। এত সবকিছুর পরও তাদের সবসময় চলতে হয় নিয়মকানুনের মধ্যে।

নিয়মকানুনগুলোর মধ্যে অনেকসময় দেখা যায়- সবসময় চলতে ফিরতে সালাম দেয়া, শার্টের হাতা না গুটানো, ট্রাউজার পরিধান না করা, টি-শার্ট পরিধান না করা, চুল ছোট রাখা, নির্দিষ্ট সময় গোসল শেষ করা, হলের ডাইনিং এ খাওয়ার ক্ষেত্রে লাইন ধরে ধরে খাবার নেয়া, ক্যাম্পাসের নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় প্রবেশ না করা। এছাড়াও নতুনদের মধ্যে একটু চটপটে ছেলেমেয়ে দেখলেই তাদেরকে দেওয়া হয় স্পেশাল র‍্যাগ। কাউকে কাউকে হলের ছাদে নিয়ে গিয়ে করানো হয় নির্যাতন। অনেকক্ষেত্রে জুনিয়র মেয়েদেরকে সিনিয়র আপুদের উচ্চবাক্য, তাদের কাপড় ধুইয়ে দেয়া, রাতভর দাঁড় করিয়ে রাখাসহ নানা ধরনের নির্যাতন করা হয়।

র‍্যাগিংয়ের ঘটনা বহুবার মিডিয়ার সামনে আসে। তবুও সকল নির্যাতন প্রতিষ্ঠানের কর্তারা যেন কোনো এক অশুভ শক্তির কারণে দেখেও না দেখে থাকে। নবীনদের দেয়া হয় সাময়িক সাহস, পেছনে থাকেন মোসাহেবদের সাপোর্টে।

যাইহোক সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিনিয়রদের এমন নিষ্ঠুর আচরণ বিশেষ করে মাস্টার রোলে থাকা ইমিডিয়েট সিনিয়ররা তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাবে। কারণ র‍্যাগিং একধরনের অপরাধ। এ অপরাধ দমনে প্রতিষ্ঠান প্রশাসনকে কঠোর হতে হবে। প্রত্যাশা থাকবে- র‍্যাগিংমুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নবীনরা যেখানে বাজাবে আনন্দের জয়গান।

শিক্ষার্থী : আইন ও ভূমি প্রশাসন, দ্বিতীয় বর্ষ,

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

এআরএস