কৃষকের অধিকার নিশ্চিত হলে বাড়বে উৎপাদন, কমবে আমদানি নির্ভরতা

জিহাদ হোসেন রাহাত প্রকাশিত: মার্চ ২৭, ২০২৩, ১২:২৩ পিএম

চিরসবুজের দেশ বাংলাদেশ। এ দেশের অর্থনীতি কৃষক-কৃষির সঙ্গে ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত। তাই বলা চলে, কৃষক হাসলে হাসবে দেশ, ফল-ফসলে ভরে উঠবে আমার সোনার বাংলাদেশ। আমাদের কৃষকরা দেশের সুসময়-দুঃসময় সব কালেই দেশের অর্থনীতির মূল খাত কৃষিকে আঁকড়ে ধরে আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তির সহায়তায় চাষাবাদ করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কাজ করে যাচ্ছেন।

করোনা মহামারির সময়ে আমরা দেখেছি কৃষি ছাড়া দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ কর্মহীন হয়ে একপ্রকার বেহাল দশায় পতিত হয়েছিলো। লকডাউন কেন্দ্রিক সরকারি কঠোর নিষেধাজ্ঞায় সব পেশার কার্যক্রম একপ্রকার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। অথচ এতো ঝড়ঝাপ্টার মধ্যেও আমাদের চাষা ভাইয়েরা মরণের ভয়কে উপেক্ষা করে ঠিকই কৃষিকাজ চালিয়ে গিয়েছিলেন। যা প্রসংশার যোগ্যতা রাখে।

হাজী শরিয়ত, মীর নিসার আলী তিতুমীর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রমানের এই দেশে প্রতিটি বিপদ-মহাবিপদে কৃষি ছিল জাতির ভরসার নাম। যুদ্ধ, মন্দায় যখন বিশ্ব অর্থনীতির চাকা থেমে গেছে, যখন সূচকের পতন ঘটছে ঠিক এ মুহুর্তে এসেও সৃষ্টিকর্তার পরে আমাদের আশা-ভরসার জায়গা হলো, দেশের কৃষি ও কৃষক। আনন্দের বিষয় হলো এদেশের সোনা ফলা মাটি এটা বলতে পারবে, তার সন্তানরা না খেয়ে মরবে না। অতীতের তুলনায় এবার বাম্পার ফলন হয়েছে বাংলাদেশে।

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো ১৯৭৪ সালে খাদ্যাভাবে পড়েছিল পুরো দেশ। সে সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খালি জায়গায় চাষাবাদ করতে মানুষকে উৎসাহিত করেছিলেন। ফলে ১৯৭৫ সালে দেশে ভালো ফসল হয়েছিল, একপ্রকার বাম্পার ফলনও বলা যায়।

পরবর্তীতে ১৯৮৮ সালের বন্যা দুঃখের সঙ্গে বয়ে নিয়ে আসে সোনার ফসল ফলানোর জন্য নদীর তেজদীপ্ত পলি। এতে ১৯৮৯-৯০ সালে ফসল কিছুটা ভালো ফলে। ৯০ দশকের শুরুর দিক থেকে দেশের কৃষিতে আধুনিকতার সংমিশ্রণ ঘটে। কৃষির সঙ্গে যুক্ত হয় উন্নত প্রযুক্তি ও কৃষকের কষ্ট লাঘবকারী বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। ফলে নতুন যুগে নতুন রুপে শুরু হয় বাংলাদেশের কৃষিযাত্রা।

দীর্ঘ একটি সময় পেরিয়ে পুরো বিশ্বে মুদ্রাস্ফীতি, খাদ্য ঘাটতি, পরিবেশের নানা প্রকার দূষণ ইত্যাদি নেতিবাচক বিভিন্ন বিষয় এড়িয়ে পাওয়া গেল এক সুখবর, বোরো ধানের উৎপাদন দেশে রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বে তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী দেশের খেতাব অর্জন করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

এই আনন্দঘন মুহুর্তে দাঁড়িয়ে কৃষি সংশ্লিষ্ট মহলকে উদ্দেশ্য করে আমি বলতে চাই, কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে। তাই দেশ বাঁচাতে কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। যে সরকার কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে ব্যর্থ তাদের তুলনা করা চলে ২০০ বছর আগের নীলকরদের সঙ্গে। শান্তিপ্রিয় এই বাংলাদেশে আমরা তেমন শাসক চাই না। আমাদানি নির্ভরতা কমাতে উদ্যোগ নিতে। আমদানি কমাতে দেশের কৃষকদের ফসল চাষে উৎসাহিত করতে হবে। সকল ফসলের প্রয়োজনীয় ব্যালেন্স নিশ্চিত করতে হবে।

সাম্প্রতিক সময়ে সয়াবিন তেলের বাজার নিয়ে যে তেলেসমাতিকাণ্ড ঘটেছে তার পুনরাবৃত্তি যেন আর না হয় সেজন্যও সরকারসহ সকল পক্ষকে প্রস্তুতি গ্রহন করতে হবে। বর্তমানে সকল ধরনের খাদ্য পণ্যের অসহনীয় মাত্রায় মূল্য বাড়ছে। বাজার থেকে আমরা চাল ৫০ থেকে ৬০ টাকায় ক্রয় করলেও আমাদের কৃষকরা তার অর্ধেক দামও পান না। অথচ এর একটি বিরাট অংশ ঢোকে মধ্যস্বত্বভোগী আর দালালদের পেটে। এই সিন্ডিকেট ভাঙা জরুরি।

সময় এসেছে, কৃষকের কষ্ট-সাধনার মূল্য দেওয়ার। দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত উর্ধগতির এ সময়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে কৃষকের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

ফলে দেশের অভ্যন্তরে চালের দাম সহনীয় মাত্রায় থাকার পাশাপাশি অধিক উৎপাদনে মনোযোগী হবে কৃষকরা। এতে করে কমবে আমদানি নির্ভরতা। বাঙালির আবহমান ঐতিহ্য, সংস্কৃতিজুড়ে ভাতের রয়েছে একটি গ্রহণযোগ্য অবস্থান। কৃষি প্রধান এই দেশে যেখানে ধান উৎপাদনে আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কথা সেখানে আমরা নিচ্ছি চাল আমদানির নাম।

দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করা হয়েছে, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। যদিও দেশের কৃষি উৎপাদন পরিসংখ্যানে উঠে আসছে এর ভিন্ন চিত্র। গত পাঁচ অর্থবছরে প্রধান খাদ্যশস্য চালে আমদানিনির্ভর থাকতে হয়েছে বাংলাদেশকে।

সরকারি পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সন্নিবেশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এ পাঁচ বছরে চালের ভোগ ও ব্যবহার হয়েছে উৎপাদনের চেয়ে বেশি। স্থানীয় উৎপাদন দিয়ে চাহিদা পূরণ করতে পারেনি বাংলাদেশ। বরং চালের জন্য আমদানিনির্ভরতা দিনে দিনে বেড়েছে।

অভ্যন্তরীণ তথ্য বলছে, দেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদন হয়েছে। তবে এ সময় চালের মোট ভোগ ও ব্যবহার ছিল প্রায় তিন কোটি ৬৫ লাখ টন। সে মোতাবেক গত অর্থবছরে দেশে চালের ঘাটতি ছিল প্রায় সাড়ে ৬ লাখ টন। আগের অর্থবছরে ২০২০-২১ এ ১৫ লাখ টন ঘাটতি ছিল।

গণমাধ্যমে উঠে আসা তথ্য বলছে, গত পাঁচ অর্থবছরে চাল উৎপাদন এবং ভোগ ও ব্যবহারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ সময়ের পুরোটাই চালের ঘাটতি মোকাবেলা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। আর কত ঘাটতি মোকাবেলা করবে বাংলাদেশ? নতুন উৎপাদন কৌশল আদৌ অবলম্বন হবে কিনা? কিংবা হলেও কবে নাগাদ তা শুরু হবে - এমন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে ভোক্তা মহলে।

সর্বপরি চালসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমাদানি কমিয়ে আনার পাশাপাশি উৎপাদনে নজর দিতে হবে। দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে জনশক্তি হিসেবে কাজে লাগানোর এখনই সময়। আমদানি কমিয়ে উৎপাদনে মনোযোগ কল্পে সরকারসহ সকল পক্ষকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে।

লেখক: তরুণ কলামিস্ট
zihadhossainrahat@gmail.com