এটা খুবই দুঃখজনক যে ন্যায়বিচার, সংস্কার ও বৈষম্য নিরসনের দাবিতে পরিচালিত একটি গণঅভ্যুত্থানের পথিকৃৎরাই বর্তমানে অপরাধচক্রের হোতা হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে। বিশেষ করে সম্প্রতি বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস) নেতার উন্মুক্ত চাঁদাবাজির ঘটনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
এছাড়াও সদ্য গঠিত গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী ছাত্রদের নেতৃত্বে গঠিত দল এনসিপি নেতাদের বিরুদ্ধেও চাঁদাবাজি, ফ্যাসিবাদের দোসরদের পুনর্বাসন, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অনৈতিক রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা নেওয়ার অভিযোগ মানুষের মুখে মুখে।
এছাড়াও দীর্ঘকাল ফ্যাসিবাদের রোষানলে থাকা বিএনপি এক বছরেই যেন অপরাধচক্রের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। ইতোমধ্যেই বিএনপির হাতে দেড় শতাধিক প্রাণহানি ঘটা যেন আসন্ন ফ্যাসিবাদের ইঙ্গিত বহন করে।
সম্প্রতি সংঘটিত চাঁদাবাজি কাণ্ডে আটক হয় বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদের ৫ নেতা। আওয়ামী লীগ নেত্রী ও সাবেক সংসদ সদস্য শাম্মী আহমেদের বাসায় চাঁদাবাজি করার অভিযোগে তাদের আটক করা হয়। প্রথমবার ১০ লাখ টাকা নেওয়ার পর দ্বিতীয় কিস্তিতে আরো টাকা নিতে আসলে আটক হন তারা। ৫০ লাখ টাকা চাঁদা দাবির এ ঘটনায় সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন বাগছাসের শীর্ষনেতা জানে আলম অপু।
সারাদেশে আন্দোলনের নাম ভাঙ্গিয়ে, সমন্বয়ক পরিচয়ে, সংগঠক পরিচয়ে, রাজনৈতিক নেতা পরিচয়ে চাঁদাবাজি, জুলুম, নির্যাতন, আধিপত্য বিস্তারের ঘটনা ঘটছে অহরহ। যার কিয়দাংশই হচ্ছে প্রকাশিত।
কিন্তু এসব ঘটনা কি নিতান্তই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাকি বাংলাদেশেরঐতিহাসিক রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের ফল?
আমরা ইতিহাস ঘাটলেই দেখতে পাই এসব ঘটনা শুধু কিছু নির্দিষ্ট অভিযোগেই সীমাবদ্ধ নয় বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটি গভীর মেরূকরণ ও স্ট্রাকচারাল প্যাটার্নকেই ইঙ্গিত করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্ররাজনীতি দ্বিধারবিশিষ্ট ছুরির মত।
১৯৪৭ এর স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৫২'র ভাষা আন্দোলন, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, ৮৯ এর এরশাদ বিরোধী আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২৪ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখেছে ছাত্ররা। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই আন্দোলন পরবর্তী সময়ে তারা হয়ে উঠেছে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী। দুর্নীতি, পেশিশক্তির ব্যবহারসহ সকল অন্যায় অবিচারের পৃষ্ঠপোষকতা করে এসেছে এই ছাত্ররাই। একাত্তর পরবর্তী সন্ত্রাসী মুজিববাহিনীর খুন, গুম, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি তার অন্যতম উদাহরণ।
চব্বিশের আন্দোলনের অন্যতম প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র ও আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক গুলশানের চাঁদাবাজি কাণ্ডের পর সংগঠনের অভ্যন্তরীণ হয়রানি, হুমকি, বলপ্রয়োগ, চাঁদাবাজিসহ প্লাটফর্মের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ সামনে তুলে ধরেছেন এবং উক্ত প্লাটফর্মকে 'মানি মেকিং এন্টারপ্রাইজ' আখ্যা দিয়েছেন।
সংস্কার, পরিবর্তন, ন্যায়বিচার ও নৈতিকতার দাবিতে পরিচালিত আন্দোলন কীভাবে মানী মেকিং এন্টারপ্রাইজ এ পরিণত হয় তা বিশ্লেষণ করতে হলে আমাদের তৃণমূলের রাজনীতির ইতিহাসে চোখ বুলানো প্রয়োজন। তৃণমূলের রাজনীতিবিদদের একটি বড় অংশই রাজনীতিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। শুধু তৃণমূলই নয় অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের নেতাদের রাজনীতি ভিন্ন কোন পেশা নেই বা অর্থনৈতিক উৎস নেই। ফলে তৃণমূল থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় নেতা পর্যন্ত অর্থের জোগান দিতেই রাজনীতি হয়ে পড়ে শাসন শোষণের হাতিয়ার। শুরু হয় চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, আধিপত্য বিস্তারের নামে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন। অন্যায় জণপরিসরে প্রকাশিত হলে তাকে দল থেকে বহিষ্কারের মাধ্যমে চোখে ধুলা দেওয়া হয়। কিন্তু আদতে সত্যিকারের সংস্কার কোন দলের কার্যবিধিতে গুরুত্ব পায় না। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে বিচারের আওতামুক্ত রাখা হয় সকল অপকর্মের হোতাদের।
রাজনৈতিক দুষ্টচক্রের হোতাদের যখন অসীম ক্ষমতায়িত করা হয়। প্রশাসন, পুলিশ স্টেশনে যখন তাদের বাধছাড়া প্রবেশাধিকার থাকে তখন একজন আদর্শহীন অপরাধচক্রের হোতা যে রাজনৈতিক ক্ষমতার মাধ্যমে প্রশাসনিক ও বিচারিক কাঠামোকে ধ্বংস করে ফেলবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
চব্বিশের আন্দোলন পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত স্মারক হিসেবে থাকবে কিনা তা নির্ভর করছে জনগণের ও রাষ্ট্রীয় নেতৃত্বের নৈতিক মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের উপর।
সত্যিকার অর্থে নৈতিক মনস্তাত্ত্বিক আমূল পরিবর্তন ছাড়া ক্ষমতার হাতবদল শুধুমাত্র আদর্শিক দেউলিয়াত্ব ও নব্য ফ্যাসীবাদেরই জন্ম দিতে পারে।
লেখক: শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
***মতামত লেখকের নিজস্ব
ইএইচ