বাড়ি পালানো শিশুদের জন্য করণীয়

ড. মতিউর রহমান প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৩, ০৬:৩৮ পিএম

সবুজ শ্যামল বাংলাদেশের সমাজে লোকচক্ষুর আড়ালে অনেক পরিবারে প্রায়শই এমন একটি অন্ধকার ও নীরব সংকট দেখা দেয় যা কোনো চিহ্ন রেখে যায় না কিন্তু হূদয় ভেঙে দেয় এবং ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে। বাংলাদেশে বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা শিশুদের কথা বলা হচ্ছে যা একটি হূদয়বিদারক ঘটনা এবং যা অবিলম্বে আমাদের মনোযোগ এবং পরিবর্তন আনতে সমন্বিত প্রচেষ্টার দাবি রাখে। 

বিশ্বের অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশে শিশুদের বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার বিষয়টি নতুন নয়। এটি একটি দুঃখজনক বাস্তবতা যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে টিকে আছে, আর্থ-সামাজিক কারণ, সাংস্কৃতিক নিয়ম এবং পর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তা জালের অভাবের কারণে। এদের সঠিক সংখ্যাও কারো জানা নেই। প্রতি বছর কত শিশু বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় তার সংখ্যাও জানা নেই। 

কারণ এ বিষয়টি নিয়ে ভাবা হয় খুব কমই। এই শিশুরা অনেক কারণে প্রায়শই তাদের কৈশোরকালীন বছরগুলোতে, তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় যার প্রতিটি গল্প অনন্য তবে হতাশার সুতোয় গাঁথা। এই সমস্যাটি সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হলো এই শিশুরা কেন পালিয়ে যায় তা বোঝা। এটা হালকাভাবে নেয়া কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এটা ভয়, অবহেলা, দুর্ব্যবহার, বা বাড়িতে অসহনীয় পরিস্থিতি থেকে জন্ম নেয়া একটি মরিয়া কাজ। দারিদ্র্য, বাংলাদেশে একটি বিস্তৃত সমস্যা, যা অনেক পরিবারকে বেঁচে থাকার জন্য প্রতিদিন সংগ্রাম করতে বাধ্য করে। যখন পিতামাতারা তাদের সন্তানদের খাবার, আশ্রয় বা শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারে না, তখন এটি হতাশা সৃষ্টি করে বা হতাশা সৃষ্টির জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে। 

কিছু ক্ষেত্রে, এই শিশুরা তাদের নিজের বাড়িতে শারীরিক, মানসিক বা এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। তারা যে অসহ্য যন্ত্রণা এবং অপমান সহ্য করে তা তাদের পালাতে বাধ্য করতে পারে। অন্যান্যের মতো, একটি উন্নত জীবনের সম্ভাবনা তাদের অজানাতে প্রলুব্ধ করে। তারা শহরগুলোকে আশার আলোকসজ্জা হিসেবে কল্পনা করে, এমন জায়গা যেখানে স্বপ্নগুলো সত্য হয় এবং কষ্টগুলো পিছনে ফেলে দেয়া যায়। তবুও, এই স্বপ্নগুলো প্রায়শই শহরের রাস্তায় জীবনের কঠোর বাস্তবতার নিচে চুরমার হয়ে যায়। একবার এই শিশুরা তাদের বাড়ি থেকে সেই দুর্ভাগ্যজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, তারা পারিবারিক ভালোবাসার উষ্ণতা থেকে দূরের একটি জগতে প্রবেশ করে। রাস্তা তাদের আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে সেসাথে তাদের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রও। যানজটযুক্ত রাস্তা এবং জনাকীর্ণ বস্তিসহ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার রাস্তায় বেঁচে থাকা কোনো ছোট কীর্তি নয়। এই শিশুরা অসংখ্য বিপদের সম্মুখীন হয়। 

সেইসাথে ক্ষুধা, অসুস্থতা, শোষণ এবং যৌন সহিংসতার ক্রমাগত হুমকিও তাদেরকে ঘিরে থাকে। পিতামাতার দিকনির্দেশনা এবং যত্নের অনুপস্থিতি তাদের বিভিন্ন ধরনের শোষণের ঝুঁকিতে ফেলে। মানব পাচারকারী এবং অসাধু ব্যক্তিরা তাদের দুর্বলতার শিকারি হয়, তাদের প্রলুব্ধ করে শিশুশ্রম, পতিতাবৃত্তি, এমনকি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে। এই শিশুরা অদৃশ্য শিকারে পরিণত হয়, শোষণের চক্রে আটকা পড়ে যা সারাজীবন না হলেও বছরের পর বছর ধরে চলতে পারে। সমাজের মধ্যে সচেতনতা এবং উদাসিনতার অভাব পরিস্থিতিকে আরও বাড়িয়ে তোলে। অনেক লোক পলাতক শিশুদের দুর্দশাকে উপেক্ষা করে, তাদের ক্ষুদ্র অপরাধী বা উপদ্রব হিসেবে চিহ্নিত করে। এই উদাসিনতা অবহেলার চক্রকে স্থায়ী করে, এই শিশুদের জন্য একটি স্থিতিশীল জীবনে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া আরও কঠিন করে তোলে। এই সমস্যা সমাধানে সরকারের সক্রিয় ভূমিকা দরকার। 

যদিও শিশুদের সুরক্ষার জন্য সরকার নীতিমালাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে তবুও সমাজের সবচেয়ে দুর্বল শিশুদের সুরক্ষার জন্য এখনো অনেক কাজ করা বাকি আছে। এইসব বাড়ি পালানো শিশুদের কাছে পৌঁছানোর জন্য শিশু সুরক্ষা নীতি এবং পরিষেবাগুলোকে শক্তিশালী এবং প্রসারিত করতে হবে। সমস্যা সমাধানের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো পলাতক শিশুদের জন্য আশ্রয় এবং পুনর্বাসন প্রদান। বেসরকারি সংস্থা এবং সরকারি সংস্থাগুলোকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপনের জন্য সহযোগিতা করা উচিত যেখানে এই শিশুরা আশ্রয় পেতে পারে, চিকিৎসাসেবা পেতে পারে এবং শিক্ষার সুযোগ পেতে পারে। এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে কেবল অস্থায়ী আশ্রয় হিসেবে কাজ করা উচিত নয় তবে এই শিশুদের সমাজে পুনঃএকত্রিত করার জন্য প্রয়োজনীয় সংস্থান এবং কর্মসূচির নিয়ে কাজ করা উচিত। শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধি একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যা বাংলাদেশে পলাতক শিশুদের চক্র ভেঙে দিতে পারে। 

যখন শিশুরা মানসম্পন্ন শিক্ষার সুযোগ পায়, তখন তারা আশা, দক্ষতা এবং উন্নত ভবিষ্যতের সুযোগ লাভ করে। সুতরাং, পরিস্থিতি নির্বিশেষে সব শিশু যাতে শিক্ষার সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা উচিত। এর মধ্যে রয়েছে এমন নীতি বাস্তবায়ন করা যা স্কুলে উপস্থিতিকে উৎসাহিত করে এবং পরিবারকে তাদের সন্তানদের স্কুলে রাখতে সহায়তা করে। তাছাড়া এই শিশুদের জন্য কাউন্সেলিং এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া উচিত। তাদের ভয়ানক অভিজ্ঞতার মানসিক ক্ষত গভীর হতে পারে এবং তাদের মানসিক সুস্থতাকে সম্বোধন করা তাদের শারীরিক চাহিদা পূরণের মতোই গুরুত্বপূর্ণ। 

পেশাদার পরামর্শদাতা এবং সমাজকর্মীরা এই শিশুদের নিরাময় এবং তাদের জীবন পুনর্গঠনে সহায়তা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। শিশু পাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রচেষ্টা আরও জোরদার করতে হবে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত পলাতক শিশুদের উদ্ধার ও সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং শিশু পাচার ও শোষণের সাথে জড়িতদের কঠোর শাস্তির বিধান করা। অধিকন্তু, পাচারের বিপদ এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপের রিপোর্ট করার গুরুত্ব সম্পর্কে সমপ্রদায়কে শিক্ষিত করার জন্য সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো উচিত। সরকারি পদক্ষেপের পাশাপাশি, বাংলাদেশে পলাতক শিশুদের সমস্যা মোকাবিলায় বেসরকারি সংগঠনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সংস্থাগুলোর প্রায়শই সবচেয়ে প্রান্তিক শিশুদের কাছে পৌঁছাতে এবং তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের জন্য প্রয়োজনীয় নমনীয়তা এবং স্থানীয় জ্ঞান থাকে। 

সরকারি সংস্থা, এনজিও এবং সম্প্রদায়ের নেতাদের মধ্যে সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা পলাতক শিশুদের জন্য একটি ব্যাপক নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করতে পারে। পারি ফাউন্ডেশন নামক একটি বেসরকারি মানবসেবামূলক সংস্থা দীর্ঘদিন থেকে বাড়ি থেকে পালানো শিশুদের পরিবারকে খুঁজে বের করে তাদেরকে পরিবারের হাতে তুলে দিতে সহায়তা করছে। এই মহতি কাজের জন্য পারি ফাউন্ডেশন প্রশংসার দাবি রাখে। আমাদেরও উচিত পারি ফাউন্ডেশনের মতো বেসরকারি সংগঠনগুলোকে সহায়তা দিয়ে তাদের এই মহৎ কাজের পাশে থাকা। পলাতক শিশুদের বিষয়টি যে বিচ্ছিন্ন নয় তা স্বীকার করা অপরিহার্য ; এটি দারিদ্র্য, সামাজিক অসমতা এবং প্রয়োজনীয় পরিষেবাগুলোতে প্রবেশাধিকারে অভাবের মতো বৃহত্তর চ্যালেঞ্জগুলোর সাথে জড়িত। 

সত্যিকার অর্থে এই সমস্যাটির সমাধান করার জন্য, আমাদের অবশ্যই এমন একটি সমাজের দিকে কাজ করতে হবে যেখানে সব শিশু তাদের পরিবার এবং সমপ্রদায়ের মধ্যে উন্নতি করতে পারে। দারিদ্র্যবিমোচন কর্মসূচি, সামাজিক নিরাপত্তা জাল এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন উদ্যোগগুলো পলাতক শিশুদের চক্রের অবসান ঘটাতে একটি সামগ্রিক পদ্ধতির গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। উপরন্তু গণমাধ্যম উল্লেখযোগ্যভাবে এই সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে পারে এবং কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করতে পারে। সাংবাদিক এবং মিডিয়া আউটলেটগুলো পলাতক শিশুদের গল্পের ওপর আলোকপাত করতে পারে, তাদের অভিজ্ঞতাকে মানবিক করতে পারে এবং নীতি পরিবর্তন এবং সরকারি পদক্ষেপের জন্য চাপ দিতে পারে। এইসব অবহেলিত শিশুদের জন্য একটি বার্তা দেয়ার মাধ্যমে, মিডিয়া জনগণের সহানুভূতিকে অনুঘটক করতে পারে এবং উদ্ধার ও পুনর্বাসনের জন্য সহায়তা সংগ্রহ করতে পারে। বাংলাদেশে পলাতক শিশুদের দুর্দশা একটি হূদয় বিদারক সংকট যা অবিলম্বে মনোযোগ ও পদক্ষেপের দাবি রাখে। 

এই শিশুরা হতাশা দ্বারা চালিত হয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বিপজ্জনক যাত্রা শুরু করে যা প্রায়ই আরও দুঃখকষ্ট এবং শোষণের দিকে নিয়ে যায়। এই সমস্যাটি মোকাবিলা করার জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যার মধ্যে সরকারের হস্তক্ষেপ, সুশীল সমাজের সম্পৃক্ততা এবং এই দুর্বল শিশুদের অধিকার ও মঙ্গল রক্ষার জন্য একটি সম্মিলিত অঙ্গীকার অন্তর্ভুক্ত রাখা। 

আমাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে পলাতক শিশুদের ভাগ্য আমাদের সমাজের বৃহত্তর চ্যালেঞ্জগুলোকে প্রতিফলিত করে, দারিদ্র্য এবং অসমতা থেকে শিক্ষা এবং সামাজিক পরিষেবাগুলোতে প্রবেশাধিকারের অভাব পর্যন্ত। এই চক্রটি ভাঙার জন্য আমাদের অবশ্যই তাদের দুর্দশার মূল কারণগুলো মোকাবিলা করতে হবে এবং এমন একটি বাংলাদেশের দিকে কাজ করতে হবে যেখানে প্রতিটি শিশু শিক্ষা, দক্ষতা, স্বাস্থ্যসেবা এবং একটি আশাপূর্ণ ভবিষ্যৎসহ একটি নিরাপদ এবং মর্যাদাপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে উঠতে পারে। 

সুতরাং, এখনই উদ্যোগ নেয়ার সময়। আমরা বাড়ি থেকে পালানো একটি প্রজন্মের শিশুদের পেছনে ফেলে দিতে পারি না, তাদের স্বপ্ন ভেঙে যায় এবং তাদের সম্ভাবনা নষ্ট হয় এমন কাজও করা উচিত নয়। আমাদের সম্মিলিত দায়িত্ব হলো বাংলাদেশের প্রতিটি শিশু যাতে রাস্তার দুর্বিষহ জীবন ও হতাশার হাত থেকে মুক্ত হয়ে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করা। তবেই আমরা সত্যিকার অর্থে এমন একটি সমাজ বলে দাবি করতে পারি যেটি তার সব সদস্যের মঙ্গল এবং মর্যাদাকে মূল্য দেয়, তাদের পরিস্থিতি নির্বিশেষে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী