ঐতিহ্যের নিদর্শন চুয়াডাঙ্গার ঘোলদাড়ী শাহী মসজিদ

ইসলাম রকিব ও আব্দুল্লাহ হক, চুয়াডাঙ্গা প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২২, ০১:২২ এএম

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের  এক অনন্য নিদর্শন চুয়াডাঙ্গার ঘোলদাড়ী শাহী মসজিদ। হাজার বছরের ঐতিহ্য জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার ঘোলদাড়ী শাহী জামে মসজিদ। মসজিদটি তৎকালীন বৃহত্তর কুষ্টিয়া (কুষ্টিয়া-চুয়াডাঙ্গা-মেহেরপুর) জেলার প্রথম জামে মসজিদ হিসেবে পরিচিত।

স্থানীয়দের ধারণা, সম্ভবত ১০০৬ (বাংলা ৪১৩ সন) সালের দিকে হজরত খাইরুল বাশার রহ. ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আলমডাঙ্গা উপজেলায় ঘোলদাড়ী গ্রামে মসজিদটি নির্মাণ করেন।

ইতিহাসবিদদের মতে, ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির নদীয়া বিজয়ের অনেক আগে ঘোলদাড়ী মসজিদটি নির্মাণ করা হয়েছিল।  হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে আজো দাঁড়িয়ে আছে এ মসজিদ।

ইতিহাস পর্যালোচনা করে জানা যায়, প্রথম শতাব্দীর কোনো এক সময় হজরত খাইরুল বাশার রহ. নদীপথে আলমডাঙ্গায় আসেন। আসার সময় ঘোলদাড়ী এলাকায় শেষ হয় নদীর কূল। সে সময় ঘোলদাড়ী এলাকায় কিছু বাড়িঘর ছিল। ইসলাম প্রচারের জন্য ঘোলদাড়ী গ্রামে আস্তানা গড়েন তিনি। এখান থেকেই তিনি ইসলাম প্রচার-প্রসারের কাজ শুরু করেন। এসময় তিনি এ গ্রামে  
একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। এটিই বর্তমানে ঘোলদাড়ী শাহী জামে মসজিদ হিসেবে পরিচিত। হজরত খাইরুল বাশার ওমজ রহ.-এর মৃত্যুর পর এ মসজিদ প্রাঙ্গণেই তাকে দাফন করা হয়।

রক্ষণাবেক্ষণের কারণে আজ তার কবরটিও বিলীনের মুখে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে ঘোলদাড়ী জামে মসজিদ সংলগ্ন লোকালয়ে ভয়াবহ আগুন লাগলে সমস্ত গ্রাম ভস্মীভূত হয়ে যায়। এ ঘটনার পর গ্রামের লোকজন অন্যত্র সরে গেলে মসজিদটি গভীর জঙ্গলে ঢাকা পড়ে, হয়ে যায় ধ্বংসপ্রায়।

এরপর উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আলমডাঙ্গা উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও চুয়াডাঙ্গা প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সাহিত্যিক মরহুম মকবুলার রহমান নিজ উদ্যোগে জঙ্গল পরিষ্কার করে ধ্বংসপ্রায় মসজিদটি পুনরায় নামাজ আদায়যোগ্য করেন। পরে সরকারি অনুদানে মসজিদটি সংস্কার করা হয়।

এসময় ঘোলদাড়ী গ্রামের মৃত আ. কাদেরের ছেলে আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী মসজিদের নামে ৮৮ শতক জমি ওয়াক্ফ করে দেন। পাইকপাড়া গ্রামের নিয়ামত আলী, সবুর উদ্দীন, গাজির উদ্দীনসহ এলাকার মুরব্বিরা জানান, এ মসজিদের প্রকৃত জমির পরিমাণ ১৪১ বিঘা। মসজিদটি এ অঞ্চলের হাজার বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষর হলেও এটি রক্ষণাবেক্ষণে নেই কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।

বছর কয়েক আগে এলাকাবাসীর উদ্যোগে মসজিদ সংস্কার করা হয়। একাধিকবার সংস্কার ও এর সামনের অংশ বর্ধিত করায় অসাধারণ নির্মাণশৈলীর এ মসজিদটির প্রাচীন রূপ বুঝতে কিছুটা অসুবিধা হয়। তা ছাড়া মসজিদের চারপাশে গাছপালা বড় হয়ে যাওয়ায় এক নজরে পুরো মসজিদটি দেখাও যেত না।

আইলহাঁস ইউপি সদস্য বেল্টু হোসেন বলেন, আমি ইউনিয়ন পরিষদের নতুন সদস্য। আগে এ মসজিদের উন্নয়নে আমার কোনো অবদান না থাকলেও মসজিদের বিষয়ে জেলা পরিষদের কাছে আমি আবেদন করেছি, মসজিদের প্রাচীরসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করা হবে।

এলাকার মুরব্বি ও মসজিদের মুসল্লি নিজাম উদ্দীন (৮২) জানান, এখানে এক সময় জঙ্গল ছিল এবং বাঘ-ভাল্লুক দেখা যেত, এর মধ্যেই এলাকার মানুষ মসজিদটিতে নামাজ আদায় করতেন।

ঘোলদাড়ী জামে মসজিদটির নির্মাণশৈলী যেকোনো ব্যক্তিকে আজো মুগ্ধ করে। তিন গম্বুজবিশিষ্ট এ মসজিদটির স্থাপত্যশিল্প দারুণ নান্দনিক। মসজিদের চার কোণের থামের ওপর রয়েছে চারটি ছোট মিনার। রয়েছে দুই পাশে দু’টি দরজা আর দক্ষিণ দিকে একটি জানালা। মসজিদটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে পাতলা ইট, টালি ও চুন-সুড়কি।

এছাড়া রয়েছে ছয়টি কুঠুরি। মসজিদের ভেতরের দেয়ালে আঁকা আছে নানা ধরনের লতাপাতা ও ফুল। অবাক হলেও সত্য যে, মসজিদের গাঁথুনির সময় চুন-সুড়কির সাথে মেশানো হয়েছিল মসুর ডালও। মসজিদের শিলালিপিটি প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। তারপরও স্থাপত্য ও নির্মাণশৈলী দেখে অনুমান করা যায়, মসজিদটি ১০০৬ সালের দিকে তৈরি। মসজিদের ভেতরে বর্তমানে দুই কাতার ও বাইরে তিন কাতার করে সালাত আদায় করেন মুসল্লিরা।

ঘোলদাড়ী জামে মসজিদ সম্পর্কে স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা বলেন, ‘মসজিদটির নির্মাণশৈলী দেখে মনে হয় ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বাংলা বিজয়ের আগে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এ ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি একসময় হারিয়ে যেতে পারে। এটি রক্ষায় প্রশাসনের উদ্যোগ প্রয়োজন। কারণ এ মসজিদটি ইতিহাসের একটি নিদর্শন।

এ ব্যাপারে আলমডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রনি আলম নূর বলেন, ঘোলদাড়ী মসজিদটি হাজার বছরের একটি পুরনো মসজিদ। মসজিদটি যদি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর অধিগ্রহণ করে রক্ষণাবেক্ষণ করে, তবেই এটির ইতিহাস জানতে পারবে দেশবাসী এবং এটি হয়ে উঠতে পারে একটি পর্যটন এলাকা। এ ব্যাপারে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে দ্রুত পদপেক্ষ নেয়া হবে।