যাত্রী ছাউনি থেকেও নেই

রায়হান উদ্দিন তন্ময় প্রকাশিত: অক্টোবর ৬, ২০২২, ০১:৩৬ এএম

নিরাপদে বাসে উঠতে রাজধানীতে রয়েছে দেড় শতাধিক যাত্রী ছাউনি। তদারকির অভাবে এসব যাত্রী ছাউনি থেকেও যেন নেই। কারণ এর কোনোটি ভাঙাচুরা ও ময়লার ভাগাড়। অপরিচ্ছন্ন থাকায় দখলে নিয়েছে পাগল-ভবঘুরেরা। নিয়মিত বসছে মাদকসেবীদের আড্ডা। কোথাও ব্যবহার হচ্ছে গাড়ি পার্কিংয়ে। আর নিয়মিত বসছে ভাসমান দোকানপাট। আবার ফুটপাতের মধ্যেও নির্মিত হয়েছে যাত্রী ছাউনি।

এছাড়াও প্রায় সবকটিতে সেঁটে দেয়া রুচিহীন পোস্টার-বিজ্ঞাপনে নষ্ট হচ্ছে এর সৌন্দর্য। কোনটিতেই থামছে না নগরীর বাস। সব মিলিয়ে যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করেই দায় সারছে দুই সিটি কর্পোরেশন। কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাবে এর সুফল ভোগ করতে পারছেন না যাত্রীরা।

নগরবাসী বলছেন, রোদ-বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ও বাসে উঠতে-নামতে যাত্রী ছাউনি কোনো কাজেই আসছে না। সেখানে বসার মতো নেই কোনো পরিবেশ। ছাউনি থাকলেও কোথাও কোথাও নেই চেয়ার বা থাকলেও তা ময়লা-আবর্জনায় ঠাসা। এগুলো দেখভালের দায়িত্ব কার— প্রশ্ন যাত্রীদের।  

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সঠিক স্থানে যাত্রী ছাউনি নির্মাণ-সংস্কার ও দখলমুক্তসহ যাত্রীদের ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। ছাউনিগুলোতে রুটের ম্যাপ দেয়া, সেখানে কোন গাড়ি কখন আসবে সে তথ্য দেয়ার ব্যবস্থাসহ আরও কিছু সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। যাত্রী ছাউনিতে যেন বাসগুলো থামে সে জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তা নিশ্চিত করতে হবে।

সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীতে জনসংখ্যা বাড়লেও নেই পর্যাপ্ত যাত্রী ছাউনি ও ফুটপাত। বিপুলসংখ্যাক জনসংখ্যার বিপরীতে নামমাত্র ছাউনি আছে ১৫০ থেকে ১৬০টি। এর মধ্যে দুই সিটি কর্পোরেশন নির্মাণ করেছে ১০০টির মতো।

আর ৫০ বা ৬০টি নির্মাণ করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এছাড়াও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ের অধীনে নির্মিত হয়েছে ১৯টি যাত্রী ছাউনি। এসব ছাউনিতে অবস্থানের জন্য যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে ওয়াইফাই, ফোন চার্জসহ নানা সুবিধা দেয়ার কথা থাকলেও এর কোনোটিই সেসব ছাউনিতে দেখা যায়নি। নগরিতে যে ছাউনিগুলো রয়েছে তার অধিকাংশ ভাঙাচুরা কিংবা ময়লা আবর্জনায় ঠাসা। কোথাও আবার দখল করে গড়ে তুলা হয়েছে দোকানপাট, সবকটিতেই নিয়মিত বসছে ভাসমান দোকান। দিনের বেলায় দখল নিচ্ছে ভবঘুরেরা, আর সন্ধ্যা হলেই বসে মাদকসেবীদের আড্ডা। বৃষ্টিতে এগুলো একেবারেই অকার্যকর, নেই দাঁড়ানোর মতো অবস্থা।

পাশাপাশি ছাউনিগুলোতে নানান রকম অরুচিকর পোস্টার সাঁটানো রয়েছে। নারীসহ সবাই পড়ছেন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। সব মিলিয়ে ছাউনিগুলোর অবস্থা খুবই নাজুক। তাই তো কর্তৃপক্ষের সঠিক তদারকির অভাবে ইচ্ছে থাকলেও এর সুফল ভোগ করতে পারছেন না নগরবাসী। আবার যাত্রী ছাউনি থেকে বাসে যাত্রী উঠানো-নামার কথা থাকলেও কেউই মানছে না এ নিয়ম। চালকরা যাত্রী তুলছেন নিজের মতো করে। আর যাত্রীরাও নিজের সুবিধামতো স্থানে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। ফলে সড়কজুড়ে তৈরি হচ্ছে যানজট। সেই সাথে ঘটছে দুর্ঘটনা। দাঁড়ানোর পরিবেশ বা ব্যবস্থা না থাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দায়ী করছে রাজধানীবাসী।

সরেজমিন আরও দেখা যায়, ঝিগাতলা, ধানমন্ডি-১৫, গুলিস্তান, মৌচাক মোড়, খিলক্ষেত নয়— রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ যাত্রী ছাউনিই অব্যবস্থাপনায় রয়েছে। মেরামত আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অধিকাংশই নষ্ট হয়ে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

পাশাপাশি ফুটপাতের মধ্যেও নির্মাণ করা হয়েছে যাত্রী ছাউনি। ফলে ছাউনিতে কেউ বসে থাকলে পথচারীদের চলতে হয় ঘেঁষে। রমনায় ফুটপাতের মধ্যে একটি যাত্রী ছাউনি নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ ফুটপাতটি মাত্র আট ফুট চওড়া। ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে পথচারীদের চলাচল। এ ফুটপাতে যাত্রী ছাউনির সামনে রেলিং তোলার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে রেলিংটি ভেঙে দেয় কর্তৃপক্ষ। এমন অপরিকল্পিত আরও কয়েকটি যাত্রী ছাউনি দেখা গেছে।

যেমন— ফকিরাপুলের কালভার্ট রোডে বাস চলাচল না করলেও তৈরি করা হয়েছে দুটি যাত্রী ছাউনি। বাসাবোর রাস্তার ছাউনটিও কোনো কাজে আসেনি। দীর্ঘদিন রক্ষণাবেক্ষণ বা সুষ্ঠু তদারকির অভাবে নষ্ট হচ্ছে দেশের সম্পদ। শুধু এ তিনটি নয়, এমন আরও ৪৬টি যাত্রী ছাউনি নগরের বিভিন্ন এলাকায় স্থাপন করেছে কৃর্তপক্ষ। তবে দক্ষিণ সিটি মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, পরিকল্পিতভাবেই এসব স্থাপনা করা হচ্ছে। নগরীতে নতুন রুট চালু হলে নাগরিকরা এর সুফল পেতে শুরু করবেন।

নগরীর কয়েকটি বাসচালক বলছেন, মৌচাক মোড়ের যাত্রী ছাউনিতে কেউ অপেক্ষা করে না। সবাই মোড়ে মোড়ে অপেক্ষা করে। তাই যাত্রী ছাউনিতে তারা বাস থামান না। পথচারী ও যাত্রীরা বলছেন, মাদকসেবী ও ভবঘুরেরা শুয়ে বসে থাকে, তাই যাত্রী ছাউনিতে বসার পরিবেশ নেই। আবার কোনো কোনোটিতে ময়লায় ঠাসা। অপরিচ্ছন্ন, বিভিন্ন অরুচিকর পোস্টার -বিজ্ঞান সাঁটানো রয়েছে— এগুলো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে। অনেক যাত্রী ছাউনিতে চেয়ার নেই। অথচ আমরা নিয়মিত সরকারকে কর পরিশোধ করছি। কিন্তু সে অনুযায়ী কোনো সুফল পাচ্ছি না।

ধানমন্ডি থেকে নিয়মিত যাতায়াতকারী রুবেল মিয়া আমার সংবাদকে বলেন, বৃষ্টি এলেই আমাদের এখানে যে ছাউনিগুলো রয়েছে সেগুলোতে পানি পড়ে। আর তপ্ত রোদেও সেখানে দাঁড়ানোর মতো অবস্থা থাকে না। ছাউনি থেকে কখনোই যাত্রী তোলা হয় না। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে আমরা এর কোনো সুফল পাচ্ছি না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ট্রাফিক সদস্য এ প্রতিবেদককে জানান, যাত্রী ছাউনিগুলো যদি পরিচ্ছন্ন থাকে ও বসার পরিবেশ থাকে তাহলে যাত্রীরাও সেখানে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে পারতেন; কিন্তু তা না হওয়ায় আমরাও যাত্রীদের কিছু বলতে পারি না। তা ছাড়া সব জায়গায় তো বাস বে নেই। ফলে যেখান সেখান থেকে যাত্রীরা বাসে উঠছে। এতে দুর্ঘটনাও ঘটছে।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘দুই সিটি কর্পোরেশন যেসব যাত্রী ছাউনি তৈরি করেছে সেখানে বাস থামে না। মোড়ে মোড়ে বা যেখানে-সেখানে নগরীর বাসগুলো থামছে; কিন্তু যাত্রী ছাউনিতে থামছে না। মনিটরিংয়ের অভাবে এমনটি হচ্ছে। যে যাত্রী ছাউনিগুলো রয়েছে সেগুলো অবৈধ পার্কিং, দখল, দোকান গড়ে উঠেছে। এগুলো দখলমুক্ত করার পাশাপাশি যাত্রীদের ব্যবহার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। তাই দুই সিটিকে সর্বদা তদারকি করতে হবে। এছাড়া যাত্রী ছাউনিতে যেন বাসগুলো দাঁড়ায় এবং যাত্রীরা যেন এখান থেকেই বাসে উঠতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে।

এছাড়াও যাত্রী ছাউনিতে রুটের ম্যাপ দেয়া, সেখানে কোন গাড়ি কখন আসবে সে তথ্য দেয়ার ব্যবস্থা করা। সেখানে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা রাখা। যেমন— ইন্টারনেট, সুপেয় পানির ব্যবস্থা রাখা। সিটি কর্পোরেশনের যে যাত্রী ছাউনিগুলো আছে কিংবা যেগুলো তৈরি করবে সেগুলোতে আরও কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করতে পারে।

এছাড়াও পুলিশের কিছু দায়িত্ব থাকবে— যাত্রী ছাউনিতে বাস থামছে কি-না। আর মালিকদের দায়িত্ব থাকবে চালকদের মোটিভেটেড করা, যাতে সেখানে চালকরা বাস থামায়। এ ছাড়াও পুলিশের কিছু দায়িত্ব থাকবে— যাত্রী ছাউনিতে বাস থামছে কি-না। আর মালিকদের দায়িত্ব থাকবে চালকদের মোটিভেটেড করা, যাতে সেখানে চালকরা বাস থামায়।’

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল) মোহাম্মদ আরিফুর রহমান ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেলের) তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. বোরহান উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করতে কয়েকবার কল দেয়া হলেও তাদের পাওয়া যায়নি।