কমছে না ডেঙ্গুর প্রকোপ

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২২, ০৩:১৩ এএম

সারা দেশেই মোটামুটি শীতের আমেজ দেখা দিয়েছে। কিন্তু শীত মৌসুম চলে এলেও ডেঙ্গুর প্রকোপ কমছে না। চলতি বছরে অন্যান্য সময়ের তুলনায় ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যু তুলনামূলক বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫৫ হাজার ৬০৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৩৫ হাজার ৫২৮ জন ও ঢাকার বাইরে ২০ হাজার ৭৯ জন।

একইসময়ে সারা দেশে ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৫৩ হাজার ৩৭৫ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ছাড়প্রাপ্ত রোগীর সংখ্যা ৩৪ হাজার ২০৮ জন ও ঢাকার বাইরে ১৯ হাজার ১৬৭ জন। চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট ২৪৪ জন মারা গেছেন। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই সময়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ২৮ হাজার ২৬৫ জন ও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১০৫ জন।

যদিও দেশের বেশিরভাগ হাসপাতালের তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পায় না। প্রতিবছর যেখানে নভেম্বর মাসে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা কমতে শুরু করে, সেখানে এ বছর নভেম্বরের ২৫ দিনে ১০১ জনের মৃত্যুই হয়েছে। এর আগে ডেঙ্গুতে সর্বোচ্চ ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল ২০১৯ সালে। এদিকে, এর আগে অক্টোবর মাসের শেষে বা নভেম্বর মাসের শুরুতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে পারে বলে আশা করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে সে আশা পূরণ হয়নি। পরে আশা করা হয়, নভেম্বরের শেষে কমবে ডেঙ্গুর সংক্রমণ। কিন্তু সে আশা আর পূর্ণ হচ্ছে না।

বিগত বছরগুলোতে দেখা গেছে, অক্টোবরের মাঝে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমে যায়। কিন্তু এবার ওই একই সময়ে এসে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও প্রকট হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বৃষ্টি হলে বাড়ে ডেঙ্গুবাহী মশার পরিমাণ। আবার পরিবেশের তাপমাত্রা বাড়লে মশার শরীরে ভাইরাসের স্থায়িত্ব বাড়তে পারে। এ কারণে শীতে তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত কম থাকায় সংক্রমণ কমে।

এর আগের বছরগুলোতে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরে বৃষ্টিপাত এবং অক্টোবরে তাপমাত্রা কমা শুরু হলেই কমে যেত ডেঙ্গুর সংক্রমণ। তবে এবার তার উল্টোটা দেখা যাচ্ছে। রাজধানীতে দীর্ঘদিন ধরেই তেমন বৃষ্টি না থাকলেও তুঙ্গে রয়েছে ডেঙ্গু সংক্রমণ।

এ নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, এই মাসের শেষের দিকে কমে যাবে ডেঙ্গু সংক্রমণ। শীতের সময় বৃষ্টিপাত কম হবে, এতে ডেঙ্গু মশার জন্ম কমে যাবে।

অন্যদিকে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, এবার ভেঙ্গুর ধরন বদলেছে। সাধারণত অক্টোবরের পর ভাইরাসটির প্রকোপ থাকে না। কিন্তু এবার অক্টোবরের পর নভেম্বরেও বেশি মৃত্যু হচ্ছে। শীতে বৃষ্টিপাত কম হয়, বংশবিস্তার করতে পারে না এডিস মশা। সে ক্ষেত্রে শীতের তীব্রতা বাড়লে আশা করছি ডেঙ্গুর প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে আসবে। এজন্য আগামী এক সপ্তাহ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তিনি আরও বলেন, দেশে আসলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ স্থায়ী হতে শুরু করেছে। এজন্য সারা বছরই এডিস মশা নিধন ও মশার উৎপত্তিস্থল ধ্বংসে কর্মসূচি রাখতে হবে। এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে এডিস নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক প্রয়োগের পাশাপাশি নতুন উপায় খুঁজছে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ওলবাকিয়া নামে ব্যাকটেরিয়া সংযোজিত পুরুষ মশা এনে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ করার চিন্তা করছেন তারা। অপরদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণের কার্যকর উপায় নিয়ে গবেষণা দরকার। প্রয়োজনে তিনি গবেষকদের অর্থায়ন করতে রাজি আছেন।

ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জোবায়দুর রহমান জানান, এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে ওলবাকিয়া সংযোজিত পুরুষ মশা পালন ও এ বিষয় নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে অস্ট্রেলিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্ট ও জিওলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগের সঙ্গে দূদফা বৈঠক করেছেন।

তিনি বলেন, তারা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাদের টিম বাংলাদেশে আমাদের উত্তর সিটির একটা অংশে ওলবাকিয়া পদ্ধতির ওপর একটা পাইলটিং করতে চাচ্ছে। আমরা রাজি হয়েছি। এ পদ্ধতি সম্পর্কে জোবায়দুর রহমান বলেন, এটা পুরুষ মশাকে জম্মদানে অক্ষম করার করার পদ্ধতি। ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া যখন প্রকৃতিতে ছাড়া হবে, তখন মূলত স্ত্রী অ্যাসিড মশার সঙ্গে মিলিত হবে, যারা ডেঙ্গু ছড়ায়। এ মিলনের ফলে স্ত্রীর আর বাচ্চা উৎপাদন হবে না। ফলে আস্তে আস্তে স্ত্রী মশাগুলো যখন মারা যাবে, তখন ডেঙ্গু একেবারে কমে যাবে।

এ বিষয়ে, কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞানের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। বলেন, গবেষণা করা সিটি কর্পোরেশনের কাজ নয়। তাদের উচিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণায় সহযোগিতা করা, যেটা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে।

এডিস নিয়ন্ত্রণে ওলবাকিয়া পদ্ধতির বিষয়ে তিনি জানান, তার বিশ্বাস, বিদেশ থেকে মশা এনে বাংলাদেশে পালন ও স্ত্রী মশাকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে এসিডের জম্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি বাংলাদেশে সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম।

তিনি বলেন, নতুন প্রযুক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ভালো বিষয়। ওলবাকিয়া পদ্ধতি সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তবে বাংলাদেশে যেকোনো একটি ছোট জায়গায় পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। আর একটি বিষয় হচ্ছে- ওলবাকিয়া ইনফেক্টেট মশা বাংলাদেশে না এনে, দেশীয় গবেষকদের নিয়ে নিজস্ব ল্যাবে পরীক্ষা করে দেশীয় মশায় এ ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করিয়ে প্রকৃতিতে ছাড়া হোক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সচেতনতার অভাবেই এবার বেড়েছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ। যথাসময়ে চিকিৎসকের কাছে না আসা এবং অবহেলার কারণে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ঘটছে। ভাইরাসের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এডিস বাহক মশার জিনোটাইপ পরিবর্তন ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি করছে বলে মনে করছেন তারা।