সম্পদের পাহাড়

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: মার্চ ২, ২০২৩, ১০:২১ এএম
  • তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির সরকারি কর্মচারী সিন্ডিকেট

 সম্পদ অর্জন অপরাধ নয় তবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করাটাই অপরাধ

—গোলাম রহমান

সাবেক চেয়ারম্যান, দুদক

 

নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা সিন্ডিকেটের সামনের  সারির অনুঘটক

—ড. ইফতেখারুজ্জামান

নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

সীমিত বেতন পান তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। অথচ সরকারি চাকরিতে নিয়োজিত এই শ্রেণির কর্মচারীদের একটি বড় অংশ গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। এই শ্রেণির কর্মচারী বনে যাচ্ছেন কোটিপতি। বিলাসবহুল গাড়িতে চড়ার পাশাপাশি মালিক হচ্ছেন প্লট, ফ্ল্যাট, মার্কেট ও খামারবাড়িসহ নামে-বেনামে সম্পদের। অভিযোগ রয়েছে, দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়েই এদের রমরমা অবস্থা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ পথে উপার্জন করেও নিজেকে কলুষমুক্ত রাখতে অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিলেমিশেই দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী। দুর্নীতি দমন কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান এ বিষয়ে আমার সংবাদকে বলেন, ‘কর্মচারী হলেও অনেকেই পারিবারিকভাবে সম্পদের মালিক থাকতে পারেন। তবে যারা পারিবারিকভাবে সম্পদের মালিক নন, যদি দুর্নীতির মাধ্যমে তারাও সম্পদ অর্জন করে সেটি অবশ্যই অপরাধ।’

সরকারি বিভিন্ন দপ্তর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত ১০-১২ বছর সময়ের মধ্যেই এই শ্রেণিতে সম্পদের পাহাড় গড়ে উঠেছে। যা দেশের বিভিন্ন মহলে এখন বেশ আলোচিত। বড় পদে চাকরি করেও ঋণ করা ছাড়া যেখানে একটি বাড়ির মালিক হওয়া যায় না, সেখানে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী কীভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে— এমন প্রশ্ন একাধিক সচিব ও সংস্থাপ্রধানেরও। অনেকেই বলছেন, কর্মচারীরা তাদের ঊর্ধ্বতনের নজরদারিতেই সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে। সুরক্ষাও দিচ্ছেন তারাই। 

অন্যথায় কর্মচারীদের এত সম্পদের মালিক হওয়া সুযোগই নেই। তবে আশ্চর্যের বিষয়— অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়া কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের তৎপরতাও খুবই কম। কয়েকটি ঘটনা থেকে দেখা যায়, উচ্চ আদালতের নজরে এলে ও আদালত থেকে নির্দেশ দিলেই কেবল কিছু ঘটনার তদন্ত হয়, ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়াও জোরদার হয়। অন্যথায় এসব কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নজির খুবই নগণ্য। অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরও নিজ দপ্তরে যেন তাদের জবাবদিহিতার বালাই নেই। আর সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দায়িত্বে রয়েছে; অভিযোগ রয়েছে— তারাও এই শ্রেণির কর্মচারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে উদাসীন। যে কারণে এই শ্রেণিতে অনিয়ম-দুর্নীতি বেড়েছে অতীতের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

এ বিষয়ে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান আমার সংবাদকে বলেন, ‘সাধারণ যারা তাদের বিরুদ্ধে দুদক ব্যবস্থা নেয় না বিষয়টি এমন নয়। দুদকে অসংখ্য অভিযোগ আসে এবং এ সংক্রান্তে দুদকের একটি কমিটিও আছে। সেই কমিটি অভিযোগগুলো পর্যালোচনা করে। আমার সময়ে পরিচালক অনুসন্ধান ছিলেন, অভিযোগগুলো তার কাছে সাবমিট করা হতো। তিনি সিলেক্ট করত এবং পর্যালোচনা করে দেখত দুদকের আইনের আওতায় আসে কি-না। সে হিসেবে গুরুত্ব বুঝেই তদন্ত করা করা হয়। কর্মচারীদের সম্পদের বিষয়ে তিনি বলেন, কর্মচারী হলেও কেউ কেউ পারিবারিকভাবেও সম্পদশালী হতে পারে। আর যারা সম্পদশালী পরিবারের নয় তারাও সম্পদ অর্জন করতে পারে। সেটি অপরাধ নয়। তবে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করাটাই অপরাধ।’

সম্প্রতি আমার সংবাদের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমনি একটি ঘটনা। যেখানে করের এক পিয়ন (শফিকুল ইসলাম) জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সেখানে দুদক তার সম্পদের বিষয়ে তদন্ত করে তাকে ছাড়পত্র দিয়েছে বলে তিনি নিজেই দাবি করেছেন। অথচ তার বিলাসবহুল গাড়ি, তিনতলা বিশিষ্ট খামারবাড়ি, দেশের বিভিন্ন জেলায় ক্রয়কৃত জমি, নিজ গ্রামে পাঁচ বিঘা জমি, কেরানীগঞ্জে দোকানসহ সার্বিক সম্পদ অর্জনের বৈধতার বিষয়ে নিজেই বিশ্বাসযোগ্য তথ্য দিতে পারেননি। অনুসন্ধানে আরও তথ্য পাওয়া গেছে তার। এর মধ্যে তিনি পল্টনের রিসোস ফুল সিটি সেন্টারে করেছেন প্রাইভেট চেম্বার। যেখানে রয়েছে ২০ হাজার টাকা বেতনের কর্মচারী। সার্বিক তদারকি করেন তার ভাই। যার বেতন দেন ২৫ হাজার টাকা। আর তার ব্যক্তিগত গাড়িচালকের বেতনও দেন ২০ হাজার টাকা। থাকেন সেগুনবাগিচায় বিলাসবহুল বাড়িতে। যার ভাড়া তার বেতনের দ্বিগুণ। সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে ফের দুদকে আরেকটি অভিযোগ হয়েছে। আগের অভিযোগে দুদক তাকে যে ছাড়পত্র দিয়েছে, সেটিই যেন এখন তার সম্পদ রক্ষাকবজ। 

একইভাবে ৪০ লাখ টাকা দামের বিলাসবহুল স্যালন গাড়িতে চড়েন রেলওয়ের কর্মচারী সোহাগ। তার বেতন ১৮-২০ হাজার টাকা হলেও গাড়িচালকের বেতন দেন ২৫ হাজার টাকা। রাজধানীতে রয়েছে তার একাধিত প্লট-ফ্ল্যাট। ঢাকার বাইরেও রয়েছে তার বিপুল সম্পদ। সাত বছর আগে চাকরিতে যোগ দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বদলি ও পদায়নের সক্রিয় সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে তিনি হাতাচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। ভাগবাটোয়ারা শেষে যা পাচ্ছেন তা দিয়েই তিনি বনে গেছেন কোটিপতি।

এ ছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে রাজউকের ১৫ কর্মচারীর বিরুদ্ধেও। যাদের বিরুদ্ধে দুদকে মামলা রয়েছে। তবে এসব মামলার তদন্তের গতি ধীর। অধিকাংশকেই আইন স্পর্শ করছে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের এক উপপরিচালক বলেন, তদন্ত চলাকালে এসব বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের চাপ সামলাতে হয় তাদের। যে কারণে তদন্তের গতিও ধীর হয়ে যায়। একটা সময় তদন্তের প্রক্রিয়াও থমকে দাঁড়ানোর উপক্রম হয়। যদিও গণমাধ্যমে ১৫ কর্মচারীর কোটিপতি হওয়ার ঘটনায় দুদককে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ৫ এপ্রিল দুদকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দেন। 

১৫-২০ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করে তারা এত বিপুল সম্পদের মালিক কীভাবে হলেন তা নিয়ে বিষ্ময় প্রকাশ করেই প্রতিবেদনে আসা ১৫ কর্মচারীর বিষয়ে দুদককে তদন্তের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। একই সাথে প্রতিবেদনে উঠে আসা রাজউক চেয়ারম্যানের অসহায়ত্বের বিষয়টিও আদালতের নজরে আসে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংস্থাটির চেয়ারম্যানকে দুই মাস পর লিখিত ব্যাখ্যা দিতে বলেছেন আদালত। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না, তা জানতে চেয়ে দুই সপ্তাহের রুলও জারি করা হয়েছে। এর বাইরে শত শত কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ হলেও কার্যত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া নিয়ে রয়েছে সন্দেহ। অনেকেই বলছেন, দুদক রাঘববোয়াল ব্যতীত কারো বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে তদন্ত করে না।

এসব বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান আমার সংবাদকে বলেন, ‘বিভিন্ন গবেষণায়ও রাজউকের অনিয়ম-দুর্নীতির নানা চিত্র উঠে আসে। এখানে চাকরি করে দুর্নীতির মাধ্যমে বাড়ি-গাড়ির মালিক হওয়াটা একেবারেই স্বাভাবিক।’ তবে সার্বিক বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কেউ এককভাবে দুর্নীতি করে না, তাদের সহযোগিতা করেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একাংশ। অফিস সহকারীসহ নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীরা ওই সিন্ডিকেটের সামনের সারির অনুঘটক। পুরো সিন্ডিকেটই চিহ্নিত করতে হবে। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে না পারলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। পেছনের সুরক্ষাদাতাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।’