সিস্টেম লস কমানোর উদ্যোগ

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: মার্চ ৩০, ২০২৩, ০৫:৩২ এএম
  • প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৮ কোটি ৯১ লাখ টাকা
  •  তিতাসের প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রাহকের প্রি-পেইড মিটার নেই
  •  ঢাকা জেলার ৪১টি থানায় এসব মিটার বিতরণ করা হবে

 

দুর্নীতির সুযোগ রাখার জন্যই সবাইকে মিটারের আওতায় নেয়া হচ্ছে না

—অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম

জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, ক্যাব

 

চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে

—প্রকৌশলী মোবারক হোসেন

প্রকল্প ব্যবস্থাপক

 গ্যাসের অপচয় রোধে নানা উদ্যোগ নিলেও কিছুতেই যেন ঠেকানো যাচ্ছে না সিস্টেম লস। প্রি-পেইড মিটার না থাকায় হরহামেশাই এমন অপচয় হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস। এ ছাড়া গ্যাস চুরি, অবৈধ সংযোগ তো আছেই। সিস্টেম লস ঠেকাতে এবার ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার আবাসিক খাতে গ্রাহকদের জন্য চার লাখ ২০ হাজার প্রি-পেইড গ্যাস মিটার কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। গ্রাহকরা অনেক ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় কাজেও চুলা জ্বালিয়ে রাখেন। অনেকে দীর্ঘ সময় ধরে পানি গরম করে থাকেন। এতে বিপুল প্রাকৃতিক গ্যাসের অপচয় হয়। কেউবা শীত বা বর্ষার সময় ভেজা কাপড় শুকানোর কাজেও চুলা জ্বালিয়ে রাখেন। ম্যাচের একটি কাঠি বাঁচানোর জন্যও অনেক গৃহিণী দীর্ঘ সময় চুলা জ্বালিয়ে রাখেন। এত অপচয়ের মূল কারণ প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাস ব্যবহারে অসচেতনতা। পাশাপাশি অন্য কারণ হলো অপচয় করলে কিংবা বেশি ব্যবহার করলেও অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হয় না। 

এদিকে অনেক গ্রাহকের দাবি, তারা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাননা, তারপরও প্রতি মাসে বিল গুনতে হয়। এটি অন্যায্য ও অযৌক্তিক —দাবি তাদের। সূত্রে জানা গেছে, গৃহস্থালি রান্নায় ব্যবহূত দুই চুলার একজন গ্রাহক মাসে গড়ে কোনোভাবেই ৫০ ঘনমিটারের বেশি গ্যাস ব্যবহার করেন না। অথচ ৭৮ ঘনমিটার ধরে দুই চুলার বিল হিসাব করা হয়েছে এক হাজার ৮০ টাকা। তার মানে প্রতি চুলায় একজন গ্রাহকের কাছ থেকে ২৮ ঘনমিটার গ্যাসের দাম বাড়তি নেয় বিতরণ কোম্পানি। প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী একজন গ্রাহক ৪০ থেকে ৪৫ ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেন। তাদের মাসে বিল দিতে হয় ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা। মিটার ছাড়া একজন গ্রাহক মাসে ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা বাড়তি বিল দিচ্ছেন বিতরণ কোম্পানিকে। শুধু তিতাসের আবাসিক গ্রাহক আছেন সাড়ে ২৮ লাখ। এর মধ্যে সাড়ে ২৫ লাখের বেশি গ্রাহকের প্রি-পেইড মিটার নেই। অর্থাৎ প্রায় ৯০ শতাংশ গ্রাহকের প্রি-পেইড মিটার নেই। এর ফলে এসব গ্রাহকের কাছ থেকে অন্তত ১১৫ কোটি টাকা বাড়তি নিচ্ছে তিতাস। এতে ১১৫ কোটি টাকার গ্যাস অপচয় হিসাবে খাতায় চাপা পড়ে যাচ্ছে।

রান্নার গ্যাসের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার আবাসিক খাতে গ্রাহক পর্যায়ে ‘সিস্টেম লস’ কমানোর উদ্দেশে কেনা হচ্ছে প্রি-পেইড গ্যাস মিটার। ২০২৪ সালের মধ্যে এসব গ্যাস মিটার রাজধানীসহ ঢাকা জেলার ৪১টি থানা এলাকায় আবাসিক খাতের গ্রাহকদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। এর মাধ্যমে সার্বিকভাবে প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবস্থাপনা ও তদারকি সংক্রান্ত ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। সমপ্রতি সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি একনেকে ‘প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন (তৃতীয় সংশোধিত)’ প্রকল্পও অনুমোদন পেয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা যায়, গ্যাস অপচয় রোধ, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও টেকসই গ্যাস ব্যবহার নিশ্চিত করতেই প্রি-পেইড মিটারিং সিস্টেম চালু হচ্ছে। ফলে গ্যাসের অপচয় কমে আসবে এবং গ্রাহকদের নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এসব কারণেই জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ এ প্রকল্পটি গ্রহণ করে ২০১৫ সালে। পরবর্তী সময়ে এ প্রকল্পটিতে এ পর্যন্ত তিনবার সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়। প্রকল্পটির সর্বশেষ সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রকল্পটির কাজের পরিধির পরিবর্তন, এক হাজারটি পিওএস সাপোর্ট সার্ভিস অন্তর্ভুক্ত করা, প্রকল্পের বিভিন্ন অংশের ব্যয় বাড়ানো এবং সর্বশেষ প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় বাড়ানোর জন্যই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে সংশোধনী প্রস্তাব আনা হয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, দেশে আন্তর্জাতিক জ্বালানি কোম্পানিগুলোর (আইওসি) কাছ থেকে প্রায় তিন ডলার করে প্রতি এমএমবিটিইউ গ্যাস কেনা হচ্ছে। ওই হিসাবে প্রতি বিসিএফ গ্যাসের দাম দাঁড়ায় ৩২ কোটি টাকার কিছু বেশি। ফলে সিস্টেম লস হওয়া ২১৮ বিসিএফ গ্যাসের দাম দাঁড়ায় প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, সিস্টেম লসের নামে ওই চুরি কমানো গেলে স্পট থেকে এলএনজি আমদানি করার প্রয়োজন পড়ত না। তারা বলছেন, এসব অপচয় কমানো গেলে দাম বাড়ানোর আর দরকার হয় না। চার লাখ প্রি-পেইড গ্যাস মিটার প্রকল্পটি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের উদ্যোগে নেয়া হয়েছে। তবে বাস্তবায়ন করবে বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) আওতাধীন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড-টিজিটিডিসিএল। 

শুরুতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছিল (প্রথম সংশোধিত) ৪৯৮ কোটি ৯৪ লাখ ৩২ হাজার টাকা। প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধিত প্রস্তাবে ৭৫৩ কোটি ৮৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা এবং সর্বশেষ তৃতীয় সংশোধিত প্রস্তাবে ব্যয় বাড়িয়ে ধরা হয়েছে ৯২৮ কোটি ২৩ লাখ ৩১ হাজার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে দেয়া হবে ৯৭ কোটি ৪৭ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। প্রকল্প ঋণ বাবদ জাইকার কাছ থেকে পাওয়া যাবে ৮০৭ কোটি ২৯ হাজার টাকা। এ ছাড়া সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন থাকবে ২৩ কোটি ৭৫ লাখ ৫৯ হাজার টাকা।

দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশন সূত্র বলছে, ‘প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন (তৃতীয় সংশোধিত)’ শীর্ষক প্রকল্পটি সরকারের চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) মোট ৬৮ কোটি ৯১ লাখ টাকার মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল জিওবি থেকে চার কোটি ২০ লাখ, প্রকল্প সাহায্য বাবদ ৬৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা ও সংস্থার স্ব-অর্থায়ন ধরা হয়েছে ৮৪ লাখ টাকা বরাদ্দসহ অন্তর্ভুক্ত আছে। 

প্রকল্প প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এর আগে জানিয়েছেন, প্রাকৃতিক গ্যাসের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকার আবাসিক খাতে গ্রাহক পর্যায়ে সিস্টেম লস কমানোর উদ্দেশে প্রি-পেইড গ্যাস মিটার কেনা হচ্ছে। প্রি-পেইড মিটারিং সিস্টেমে গ্যাস অপচয় রোধ, দক্ষ, সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও টেকসই গ্যাস ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। প্রকল্পটি একনেকে উপস্থাপনের পক্ষে পরিকল্পনা কমিশনের মতামতে বলা হয়েছে, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও প্রাকৃতিক সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা) অঙ্গ প্রতিষ্ঠান তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (টিজিটিডিসিএল) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ‘প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন’ (তৃতীয় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য একনেকের অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করা হলো।

সূত্র জানায়, গ্যাসের সিস্টেম লস বিগত ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধে সবচেয়ে বেশি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে গ্যাসের যে সিস্টেম লস ছিল তা ২০১৯-২০ থেকে বেড়ে প্রায় পাঁচগুণ হয়েছে। ওই ধারা ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চলমান ছিল। প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন (তৃতীয় সংশোধিত) প্রকল্পের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী মোবারক হোসেন আমার সংবাদকে জানান, জাপানভিত্তিক সংস্থা জাইকার অর্থায়নে প্রকল্পটির কাজ চলছে। এখন তৃতীয় মেয়াদে এক লাখ মিটার স্থাপন করা হবে। এর আগে দুই দফায় তিন লাখ ২০ হাজার মিটার স্থাপন করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, আসন্ন রমজানের ঈদের পরই প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।

চলতি বছর ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিতাসের এই কর্মকর্তা বলেন, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির অর্থায়ন পেলে সব গ্রাহকই প্রি-পেইড মিটারের আওতায় চলে আসবে। এদিকে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. শামসুল আলম আমার সংবাদকে বলেন, ‘তিতাস বিদেশি ঋণ নিয়ে এই কাজ করছে। এতে ভোক্তাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তিতাস চাইলে নিজেদের অর্থায়নে এই কাজ সম্পন্ন করতে পারে। গ্যাসে দুর্নীতি আর চুরির সুযোগ রাখার জন্যই তারা সবাইকে মিটার দিতে ভয় পাচ্ছে।