অসময়ে চোখ রাঙাচ্ছে ডেঙ্গু

মো. মাসুম বিল্লাহ প্রকাশিত: মে ৩০, ২০২৩, ১১:৩৮ পিএম
  • কাজে আসছে না কোনো উদ্যোগ নাগরিকের ক্ষোভ প্রকাশ
  • শনাক্তের ৬২ ভাগ দক্ষিণ সিটিতে
  • ডেঙ্গু হটস্পট যাত্রাবাড়ী এলাকা
  • পাঁচ মাসে আক্রান্ত ১,৯২৭ জন
  • ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্ত ৮৪ জন

অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পানি প্রবাহের সিস্টেম ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে
—বলছেন বিশেষজ্ঞরা

আব্দুল মালেক রিপন। বাড়ি ফেনী সদর উপজেলায়। প্রচণ্ড জ্বর নিয়ে গত এক সপ্তাহ আগে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে একদিন পর জানতে পারলেন, তার ডেঙ্গু হয়েছে। ডাক্তাররা জানালেন, রক্তের প্লেটলেট কমে গেছে। যেকোনো সময় রক্তের প্রয়োজন হতে পারে। ডাক্তারের নির্দেশনা অনুযায়ী তিনজন ডোনারও ঠিক করে রাখে পরিবার। অবশেষে ভর্তির পঞ্চম দিন ডাক্তাররা জানালেন, শারীরিক অবস্থা উন্নত হয়েছে— রক্তের প্রয়োজন নেই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর চাপ বাড়ছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকা ডেঙ্গু হটস্পট হয়ে দাঁড়িয়েছে। শনাক্তের ৬২ শতাংশ দক্ষিণ সিটিতে। গত পাঁচ মাসে আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৯২৭ জন। এখনই হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা।

সতর্কতার বার্তা দিচ্ছেন স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে বিশেষ বার্তা। এদিকে নগর পরিকল্পনায় কোনো উদ্যোগেই সফল না হওয়ায় ক্ষোভ নাগরিকদের। তারা বলছেন, এমনি ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর মধ্যে এবার মৌসুমের আগেই ঝুঁকি শুরু হয়ে গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানী ঢাকাসহ সিটি শহরগুলোতে মশার উৎপাত কোনোভাবেই থামছে না। যদিও স্থানীয় সরকার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বছরজুড়ে এডিস মশা নিধন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে। তবে সাধারণ মানুষ মশার যন্ত্রণায় ত্রাহি অবস্থার মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করছেন বলে অনেকেরই অভিযোগ। তারা বলছেন, বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার নিয়ে যেখানে চলাই দায় হয়ে পড়েছে, এ অবস্থায় ডেঙ্গুজ্বরে কর্মক্ষম ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ায় সাধারণ মানুষকে চিকিৎসাসেবা নিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হচ্ছে। 

নিরূপায় আব্দুল মালেকের মত অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন ডেঙ্গুজ্বরে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও ৮৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ২৪৬ জনে। তবে এ সময়ে  ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের ইনচার্জ ডা. মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। গত সোমবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৮৪ জনের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৬১ জন ও ঢাকার বাইরের ২৩ জন। এ বছর ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন এক হাজার ৯২৭ জন। এর মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে এক হাজার ২৯৬ জন ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৩১ জন। অন্যদিকে ১ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন এক হাজার ৬৬৮ জন। তাদের মধ্যে ঢাকায় এক হাজার ৭৯ জন ও ঢাকার বাইরে ৫৮৯ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়নি। তবে ১ জানুয়ারির থেকে এ পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৩ জন। বিদায়ী বছরে অর্থাৎ ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন। বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ডেঙ্গুতে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। একই সঙ্গে আলোচ্য বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটি দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। একই বছর দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১০৫ জন। এ অবস্থায় সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। 

তারা বলছেন, সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা ও দায়িত্ব অবহেলার কারণে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণহীন। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এডিস মশা নিধন কর্মসূচি সারা বছর অব্যাহত রাখতে হবে। জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বর্ষাকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে, যার ফলে ডেঙ্গুর মৌসুম দীর্ঘ হচ্ছে। সাধারণত সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমার কথা থাকলেও গত বছর নভেম্বর পর্যন্ত তা দীর্ঘায়িত হয়েছে। সমপ্রতি এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করে ঢাকাবাসীকে ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ থেকে সুরক্ষা দিতে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের কাছ থেকে দায়িত্বশীল ভূমিকা প্রত্যাশা করেন বলে জানিয়েছেন করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। মেয়র ব্যারিস্টার শেখ তাপস বলেন, ঢাকা শহরে গণপূর্ত অধিদপ্তর, রেলওয়ে, ওয়াসা, পুলিশ, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরসহ শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অধিদপ্তর ও বোর্ড ইত্যাদি অনেক সংস্থার অনেক আবাসন ও স্থাপনা রয়েছে। নির্মাণাধীন প্রায় শতভাগ ভবনে মশার লার্ভা পাই। বিশেষ করে চৌবাচ্চাসহ অন্যান্য যেসব অবকাঠামো করা হয়, সেখানে পানি জমে থাকে। উৎস নিধনই সারা বিশ্বে স্বীকৃত ও কার্যকর পদ্ধতি উল্লেখ করে শেখ তাপস বলেন, এডিস মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগ হয়ে থাকে। যা অনেক সময় প্রাণহানি ঘটায়। সে জন্য আমাদের মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বড় অংশই হলো এই ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ করা, এডিস মশার বিস্তার রোধ করা। সে লক্ষ্যে যে কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি তার অন্যতম হলো উৎস নিধন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পাওয়া তথ্যমতে, চলতি মে মাসের ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত, যা গত পাঁচ বছরের মে মাসে সর্বোচ্চ। ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এলাকার বাসিন্দারা। দেশের মোট শনাক্তের ৬২ শতাংশই এ সিটিতে। এ ছাড়া ঢাকা উত্তরে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ঢাকার বাইরে ২১ দশমিক ৯ শতাংশ। চলতি বছর এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার। এরপরই রয়েছে কেরানীগঞ্জ, কাজলা, উত্তরা, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, মুগদা ও জুরাইন। মুগদা মেডিকেলের পর এ বছর ডেঙ্গু রোগী ভর্তির দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এরপর আছে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতাল। সরকারি এই তিন হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হওয়ার প্রবণতা বেশি। 

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের (সিডিসি) লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম জানান, চলতি বছরে বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সে জন্য আগাম সতর্কতা ও প্রস্তুতির প্রয়োজন। গত বছরের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ এবং এ বছরের সঙ্গে তুলনা করে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও এখনো বর্ষা মৌসুম শুরু হয়নি। সে জন্য আমরা মনে করি, আগাম সতর্কতা এবং প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ডেঙ্গুর এবার যে ধরন দেখা যাচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ গত বছরের তুলনায় বাড়বে। বিশেষ করে ঢাকার বাইরে এবার ডেঙ্গুর প্রকোপ বৃদ্ধি পাবে। ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়ণ। এ ছাড়া আছে পানি প্রবাহের সিস্টেম এবং জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। সব মিলিয়ে ভয়াবহতা বৃদ্ধির শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের মধ্যে।