দাবদাহে অতিষ্ঠ জনজীবন

মহিউদ্দিন রাব্বানি প্রকাশিত: জুন ৪, ২০২৩, ১১:৩৫ পিএম
  • অতিরিক্ত গরমে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যু
  • প্রাথমিক বিদ্যালয় চার দিন বন্ধ 

* বৃষ্টির অপেক্ষায় বিদ্যুৎ বিভাগ
* মধ্যরাতে লোডশেডিং তীব্র হয়
* ঘুমহীন রাত কাটায় নগরবাসী
* গ্রামের মানুষের ভোগান্তি বেশি

জ্বালানি সাশ্রয় করে উৎপাদন কমানো হচ্ছে। এটা তো পরিকল্পিত লোডশেডিং। এটা অবিচার
—অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম 
জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি  বিশেষজ্ঞ, ক্যাব

সারা দেশে চলমান দাবদাহে জনজীবনে হাঁসফাঁস অবস্থা। এমন অস্বস্তিকর অবস্থার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে লোডশেডিংও। গত বছর এলএনজি আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর শিডিউল লোডশেডিং ঘোষণা করা হয়েছে। এতে গ্রাহক পূর্ব থেকে জানত কখন বিদ্যুৎ যাবে কিংবা আসবে। কিন্তু চলমান লোডশেডিংয়ে এমন কোনো পূর্বঘোষণা নেই। যখন-তখন বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এতে চরম বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে গ্রাহকদের। 

এদিকে তীব্র দাবদাহের কারণে দেশের সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণি কার্যক্রম ৫ জুন থেকে ৮ জুন পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। গতকাল রোববার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এ ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণা অনুযায়ী আজ সোমবার থেকে সপ্তাহের শেষদিন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান ও পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। অর্থাৎ এ চার দিন শিশুদের বিদ্যালয়ে যেতে হবে না। এ বিষয়ে দেয়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশব্যাপী তীব্র দাবদাহের কারণে কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিবেচনা করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তার আগে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে তীব্র তাপপ্রবাহে ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলতে নেমে হিটস্ট্রোকে মাঠেই রিয়া আক্তার (১০) নামে এক শিশু শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। এরপরই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে। নিহত রিয়া আক্তার কালিহাতীর ছুনুটিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী টাঙ্গাইল জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ জানান, প্রচণ্ড গরমে খেলতে গিয়ে মেয়েটি মারা গেছে। খেলায় সদর উপজেলার আরও এক শিশু শিক্ষার্থী মাঠে বমি করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর আগে মুন্সীগঞ্জে দাখিল পরীক্ষাকেন্দ্রে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। গত ১১ মে সকাল পৌনে ১০টার দিকে উপজেলার পঞ্চসার দারুস সুন্নাত ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা পরীক্ষা কেন্দ্রে এ ঘটনা ঘটে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। অস্বস্তিকর গরমের সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ। তাপমাত্রা বাড়তে থাকায় এই পরিস্থিতি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে, তা কেউ বলতে পারছেন না। তবে চলতি মাসে বর্ষা শুরু হলে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমবে বলে প্রত্যাশা বিদ্যুৎ বিভাগের। লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ রাজধানীসহ সারা দেশের মানুষ। রাজধানীর মাতুয়াইলের বাসিন্দা বেসরকারি বেলাল হোসেন জানান, নগরে প্রচণ্ড গরমে অতিষ্ঠ জীবন। তার ওপর ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের তীব্রতা। ফলে  রাতেও শান্তিতে ঘুমানো যায় না। মধ্যরাতে বিদ্যুৎ চলে যায়। তিনি বলেন, শহরের কর্মজীবী মানুষরা বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ১০-১১টা বেজে যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমাতে যায় ১২-১টার দিকে। ঠিক তখনই বিদ্যুৎ চলে যায়। আবার এক ঘণ্টা পর আসে। ঘুম কিছুটা গভীর হওয়ার আগে ২টার দিকে আবার বিদ্যুৎ চলে যায়। এরপর আধঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। কদিন ধরেই এমন অবস্থা চলছে। ঘুমাতে পারছেন না কেউ। রাজধানীর বাসিন্দার চেয়েও লোডশেডিংয়ে বেশি ভুগছে গ্রামের মানুষ। তাদের অনেকেই বলছেন, লোডশেডিং বুঝি না। বিদ্যুৎ বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টায় ২-৩ ঘণ্টাও থাকে না। বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, গত ৩ জুন দুপুর ১২টায় প্রায় ১৪ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে ১১ হাজার ৬৭৪ মেগাওয়াট। চাহিদার তুলনায় কম উৎপাদন হয়েছে দুই হাজার ২৪৭ মেগাওয়াট। পিডিবি আজকের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে দিনের বেলা ১৩ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট আর রাতে ১৫ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট।

এদিকে শনিবার সকালে সাভারের বিরুলিয়ায় ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠান শেষে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি অংশ বন্ধ আছে। আগামী ৫ জুনের পর (আজ) আরেকটি অংশও জ্বালানি সংকটের কারণে বন্ধ হয়ে যাবে। এছাড়া এলসি খুলতে দেরি হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কয়লা আমদানি করতে আরও অন্তত ২০ থেকে ২৫ দিন সময় লাগবে। কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশে লোডশেডিং বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় এক হাজার ৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং চলছে।

এদিকে বর্ষা না আসা পর্যন্ত আবহাওয়া এমনই থাকবে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা এখন রেকর্ড করছে প্রতিদিন। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী দেশের চার জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। সে সঙ্গে ছয় বিভাগ ও তিন জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, রাজশাহী, নওগাঁ, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং মৌলভীবাজার, চাঁদপুর ও নোয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষের ভোগান্তি বেশি। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বলছে, গতকাল সন্ধ্যা ৬টার দিকে সর্বোচ্চ দুই হাজার ৪০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করেছে তারা। মধ্যরাতে সরবরাহ কমে যায়; কিন্তু চাহিদা কমে না। তাই বাধ্য হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিং করতে হয় তাদের। রাজশাহীতে গত বৃহস্পতিবার থেকে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে লোডশেডিং। রাজশাহী আবহাওয়া অফিস বলছে, রাজশাহীতে সর্বশেষ বৃষ্টি হয়েছে ১০ দিন আগে। এরপর থেকে তাপমাত্রা বাড়তে থাকে। দিনাজপুরে গত কদিনে অসহনীয় রোদ আর গরম বাতাসে অস্থির হয়ে পড়েছে জনজীবন। রাতে ভ্যাপসা গরম চলছে। এর মধ্যে দিনে পাঁচ থেকে ছয়বার লোডশেডিং হচ্ছে। প্রতিবার অন্তত এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। গত এক সপ্তাহে জেলায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিনাজপুর শহরের বিতরণ সংস্থা নেসকো বলছে, চাহিদা ৩৭ মেগাওয়াট, সরবরাহ হচ্ছে ২৫ মেগাওয়াট। আর জেলার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি বলছে, বিদ্যুতের চাহিদা ১১০ মেগাওয়াট, সরবরাহ হচ্ছে ৬০ থেকে ৭০ মেগাওয়াট। টানা তাপপ্রবাহে চুয়াডাঙ্গার বাসিন্দারাও লোডশেডিংয়ে ভুগছেন। একই পরিস্থিতি নীলফামারীতেও। শহরের বাবুপাড়া নিবাসী স্কুলশিক্ষক লিনা দে বলেন, ‘এমনিতেই গরমে টেকা মুশকিল হয়ে পড়েছে, তার ওপর বিদ্যুতের আসা-যাওয়ায় অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি।’

কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, খরচ কমিয়ে, ডলার বাঁচিয়ে, জ্বালানি তেল সাশ্রয় করে উৎপাদন কমানো হচ্ছে। এটা তো পরিকল্পিত লোডশেডিং। দুই হাজার মেগাওয়াটের কথা বলা হচ্ছে, আসলে লোডশেডিং আরও বেশি হচ্ছে। না হলে তো মধ্যরাতে লোডশেডিং হওয়ার কথা নয়। আর এতে বেশি ভুগছে গ্রামের মানুষ, এটা অবিচার।