বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করেছে, তবে নবজাতক মৃত্যুহার এখনো একটি বড় সমস্যা। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় নানা অগ্রগতি সত্ত্বেও জন্মের সময় শিশু মৃত্যুর হার কমানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। উন্নত চিকিৎসা সুবিধা, দক্ষ প্রসূতি সেবাদানকারী, ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নীতি বাস্তবায়নের অভাবের কারণে প্রসবকালীন ও জন্ম-পরবর্তী জটিলতায় বহু নবজাতক প্রাণ হারাচ্ছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর এক লাখের বেশি শিশু জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়, যার মধ্যে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ নবজাতক জন্মের প্রথম মাসেই মারা যায়। শিশুমৃত্যুর এই উচ্চ হার মূলত প্রসবকালীন জটিলতা, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা এবং সংক্রমণজনিত রোগ এর কারণে হয়ে থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের নবজাতক মৃত্যুহার দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশ উদ্বেগজনক। উন্নত সেবার অভাবে অনেক শিশুর মৃত্যু হচ্ছে, যার অন্যতম কারণ হলো- অপর্যাপ্ত প্রসূতি সেবা, স্বাস্থ্যকেন্দ্রে দক্ষ ধাত্রী ও চিকিৎসকের অভাব, জন্মের পর সংক্রমণজনিত সমস্যার দ্রুত চিকিৎসা না পাওয়া, প্রসবকালীন কম ওজন ও অপরিণত জন্ম, সম্প্র্রতি ইউনাইটেড নেশনস ইন্টার-এজেন্সি গ্রুপ ফর চাইল্ড মরটালিটি এস্টিমেশনের (ইউএন আইজিএমই) প্রকাশিত দুটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দেশে বছরে ৬৩ হাজারের বেশি মৃত শিশু প্রসবের ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতি ৪১ জন শিশুজন্মের ক্ষেত্রে একজন মৃত শিশু প্রসবের ঘটনা ঘটেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় সর্বোচ্চ। প্র
তিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মা ও নবজাতকের যত্নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। ১৯৯০ সাল থেকে অগ্রগতি অর্জিত হলেও, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে মৃত সন্তান প্রসবের রেকর্ড বাড়ছে। যাতে অবিলম্বে গুরুত্ব দেয়ার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়।
ইউএন আইজিএমই চাইল্ড মরটালিটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে ১ লাখেরও বেশি শিশু তাদের পঞ্চম জন্মদিনের আগেই মারা গেছে। এসব মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই হয়েছে শিশুর বয়স ২৮ দিন হওয়ার মধ্যেই। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) সম্পর্কিত লক্ষ্য পূরণে বাংলাদেশকে অবশ্যই প্রতি বছর অতিরিক্ত ২৮ হাজার নবজাতককে বাঁচাতে হবে, যা মাতৃ ও নবজাতকের উন্নত যত্নের জরুরি প্রয়োজনের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের ওআইসি রিপ্রেজেটেটিভ ফারুক আদ্রিয়ান দুমুন বলেন, অপ্রতিরোধ্য জটিলতা যেমন অপরিণত জন্ম, সন্তান প্রসবের সময় জটিলতা সেপসিস ও নিউমোনিয়ার মতো সংক্রমণের মতো জটিলতায় বাংলাদেশে প্রতিবছর এক লাখেরও বেশি নবজাতক মারা যায়, যা তাদের বেঁচে থাকা ও বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।
তিনি বলেন, আমরা লাখো শিশু ও মাকে বাঁচাতে পারি, যদি আমরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দিতে আরও বিনিয়োগ করি এবং সব পর্যায়ে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীদের, বিশেষ করে ধাত্রী মায়েদের সংখ্যা বাড়াতে পারি, তাদের সঠিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারি যাতে প্রতিটি নবজাতক যেন একটি নিরাপদ হাতে জন্মগ্রহণ করতে পারে।
আন্দ্রিয়ান আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে ইউনিসেফ মাতৃ ও শিশুর মৃত্যু রোধে মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার ও অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
বাংলাদেশে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) প্রতিনিধি ডা. আহমেদ জামশিদ মোহামেদ বলেন, মৃত শিশুর জন্ম ও প্রতিরোধযোগ্য শিশু মৃত্যু বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষের জন্য একটি হূদয়বিদারক বাস্তবতা হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশ বিগত দশকগুলোতে মাতৃস্বাস্থ্য ও শিশু স্বাস্থ্য সেবায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। তারপরেও মানসম্মত ও সময়োচিত সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়ে গেছে। এই প্রবণতা বদলে দেয়া এবং মর্মান্তিক ক্ষতি বন্ধে আমাদের অবশ্যই এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।
তিনি বলেন, গর্ভকালীন ও সন্তান প্রসবকালীন সেবা বিষয়ে ডব্লিউএইচও’র পরামর্শসমূহ এবং এর লেবার কেয়ার গাইড এবং গ্লোবাল স্ট্রটেজি ফর উইমেন’স, চিলড্রেন’স অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট’স হেলথ-এ সরকার ও অংশীদারদের জন্য এ বিষয়ে স্পষ্ট এবং তথ্য-প্রমাণভিত্তিক করণীয় সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ অর্জনের জন্য আর মাত্র পাঁচ বছর বাকি আছে। তাই মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা উন্নততর করতে আমাদের কার্যক্রম ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। জামশিদ বলেন, ইউনিসেফের সঙ্গে সমন্বিতভাবে ডব্লিউএইচও প্রতিরোধযোগ্য শিশু মৃত্যু ও মৃত শিশুর জন্মের অবসানের লক্ষে অবিলম্বে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে। সরকারের জোরালো অঙ্গীকার, প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় টেকসই বিনিয়োগ এবং বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা ও সর্বোত্তম চর্চা অনুসরণের মাধ্যমে আমরা এই বেদনাদায়ক ক্ষতি প্রতিরোধ এবং প্রতিটি শিশুর জন্য একটি স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারি। ইউনিসেফ জানায়, বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যু ও মৃত সন্তান প্রসবের উচ্চ হারের পেছনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যেমন ঘরে শিশুর জন্ম (৩০ শতাংশ), আকারে ছোট ও অসুস্থ নবজাতকের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সেবার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকা এবং দক্ষ সেবাদাতা/ধাত্রীর ঘাটতি। এছাড়াও মা ও নবজাতকের অন্যান্য ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে উপজেলা পর্যায়ে ২৪/৭ মানসম্পন্ন সেবার অভাব, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পর্যায়ে প্রসবের পর অপর্যাপ্ত সেবা এবং অনিয়ন্ত্রিত বেসরকারি খাত, যার ফলে এসফেকশিয়া (জন্মকালীন শ্বাসরুদ্ধতা), অপরিণত বয়স এবং সংক্রমণজনিত প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু ঘটে। এসব কারণে বার্থ অপরিণত শিশুর জন্ম ও সংক্রমণের মতো প্রতিরোধযোগ্য জটিলতাতেও শিশুমৃত্যু ঘটছে। একই সঙ্গে, মানসম্মত গর্ভকালীন ও সন্তান প্রসবকালীন সেবার ঘাটতি এবং গর্ভধারণকালে অন্যান্য অসুস্থতাজনিত পরিস্থিতিতে যথাযথভাবে প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণে বাংলাদেশে উচ্চ হারে মৃত শিশুর জন্ম হচ্ছে, যা এসডিজি লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে অন্তরায়। তহবিল ও প্রয়োজনীয় অন্যান্য সম্পদের ঘাটতি এসব সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলছে এবং তা শিশু মৃত্যু কমিয়ে আনার অগ্রগতিকে ম্লান করে দিচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে নবজাতক মৃত্যুহার কমাতে বেশ কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। যেমন- সরকারি হাসপাতালগুলোতে নবজাতক, পর্যাপ্ত ওষুধ ও আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করে প্রসূতি ও নবজাতক সেবার মানোন্নয়ন করা। গ্রামাঞ্চল ও শহরাঞ্চলে প্রসূতি চিকিৎসক, নার্স ও ধাত্রী নিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন। এতে প্রসবকালীন সেবার মান উন্নত হবে। গর্ভবতী নারীদের নিয়মিত চিকিৎসা পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার গ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে। এছাড়া, ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প আয়োজন করে সচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। সর্বোপরি, নবজাতক ও মাতৃসেবার মানোন্নয়নে সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি করা উচিত।