দেশের উপকূলীয় ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের একাধিক জেলা টানা ভারী বৃষ্টিপাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ফেনী, কক্সবাজার, নোয়াখালী, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও বান্দরবানে সড়ক তলিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে পড়েছে। কোথাও কোথাও নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে, আবার কোথাও খাল-বিল উপচে শহরের ভেতরে পানি জমে জনদুর্ভোগও সৃষ্টি করেছে।
এদিকে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে পানি প্রবাহিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, টানা বর্ষণ আরও অন্তত ৪৮ ঘণ্টা চলবে। এতে করে পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানির সাথে মিলে উপকূলীয় জেলাগুলোতে আকস্মিক বন্যা দেখা দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে মুহুরী নদীর পানি ঢুকে পড়েছে। তলিয়ে গেছে রাস্তা ও ধানক্ষেত। বাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রামের শতাধিক বাড়িতে পানি ঢুকেছে। অন্যদিকে সকাল থেকে ফেনী শহরের কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। তবে শিক্ষা বোর্ড থেকে পরীক্ষা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো প্রজ্ঞাপন জানা যায়নি। টানা ভারী বৃষ্টিতে বন্যার আশঙ্কায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
ফেনী আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান বলেন, গত সোমবার বিকাল ৩টা থেকে মঙ্গলবার বিকাল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ফেনীতে ৪০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। এটি চলতে মৌসুমের জন্য সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। আরও দুইদিন ফেনীতে মাঝারি ও ভারী বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবুল কাশেম বলেন, পরশুরামের উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের সিলোনিয়া নদীর উপর একটি ভাঙন দেখা দিয়েছে। এই ভাঙন দিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করছে।
বরিশাল শহরের রুপাতলী, চকবাজার, কাউনিয়া, নথুল্লাবাদ, কাশিপুর ও বটতলা এলাকায় নালা ও খাল উপচে সড়কে পানি উঠে গেছে। গত দুই দিনে টানা বৃষ্টিতে শহরের অধিকাংশ নিচু এলাকায় হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি জমে আছে।
বরিশাল সরকারি কলেজ, বিএম স্কুল ও হাসপাতাল চত্বরও জলাবদ্ধতায় বিপর্যস্ত। বাসিন্দাদের অভিযোগ, শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থার দুর্বলতা এ জলাবদ্ধতাকে ভয়াবহ করে তুলেছে। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফারুক হোসেন বলেন, এটা শুধু বৃষ্টি নয়, দীর্ঘদিন ধরে ড্রেন, খাল-নালা বন্ধ থাকার ফল। শহর যেন পানিতে ডুবে আছে।
কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কসহ উপকূলীয় বহু এলাকা হাঁটু থেকে কোমর সমান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। বাসস্ট্যান্ড, কক্সবাজার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও আদালত চত্বরও জলাবদ্ধতায় অচল হয়ে পড়েছে। জেলার অর্ধশতাধিক গ্রামে ইতোমধ্যে জলাবদ্ধতা তৈরি হওয়ায় দুর্ভোগে পড়েছে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। পাহাড়ঘেরা রামু ও মহেশখালীতে পাহাড়ধসের আশঙ্কায় শতাধিক পরিবারকে সরিয়ে নিয়েছে প্রশাসন। কক্সবাজার আবহাওয়া অফিস সূত্র জানায়, সোমবার একদিনেই ১২৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে।
নোয়াখালীর সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ ও সেনবাগে সড়ক উপচে পানি ঢুকে পড়ায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে অন্তত ২০টি গ্রামের সঙ্গে উপজেলা সদরের। চরাঞ্চলের বহু নিচু এলাকা জোয়ারের পানির সঙ্গে বর্ষার পানিতে তলিয়ে গেছে। অন্তত ১০টি কাঁচা-পাকা সড়ক ভেঙে গেছে। স্থানীয় প্রশাসন পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে সমন্বয় করে মেরামত শুরু করেছে। বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পানি ঢুকে পড়েছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম শহরের নিচু এলাকাগুলোতে জলাবদ্ধতা এখন পুরোনো চিত্র হলেও এবার বৃষ্টির তীব্রতায় পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। পোর্ট কানেক্টিং রোড, আগ্রাবাদ, হালিশহর এলাকায় বাসাবাড়ি ডুবে গেছে। লক্ষ্মীপুর সদর, রামগঞ্জ ও রায়পুর উপজেলায় পুকুর, খাল ও ডোবা উপচে উঠেছে গ্রামীণ সড়কে। বান্দরবানে পাহাড়ি ঢলে নদী-খালের পানি দ্রুত বাড়ছে। স্থানীয় প্রশাসন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পাহারার ব্যবস্থা করেছে।
পরিস্থিতি বিবেচনায় জেলা প্রশাসন বরিশালসহ অন্যান্য জেলায় ৭০টির বেশি আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে বলে জানা গেছে। খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধ সরবরাহ শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে। এরই মধ্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাস অনুযায়ী, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খাল, জলাধার ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনাই এ দুর্যোগকে আরও জটিল করে তুলেছে।