ইরানে পারমাণবিক স্থাপনায় মার্কিন হামলা, মহাখুশি ইসরাইল

বিশ্বজুড়ে উদ্বেগ-নিন্দা

আমার সংবাদ ডেস্ক প্রকাশিত: জুন ২৩, ২০২৫, ১২:০৪ এএম

কূটনীতিই একমাত্র পথ, শান্তিই একমাত্র আশা : জাতিসংঘ মহাসচিব

হামলা ইরানের পারমাণবিক হুমকি ‘হ্রাস করেছে’ : যুক্তরাজ্য

  • কূটনীতিতে সমাধান খোঁজার আহ্বান বিশ্ব সম্প্রদায়ের 
  • হামলার দীর্ঘস্থায়ী পরিণতির হুঙ্কার ইরানের

 ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে গত কিছুদিনের সংঘাত নতুন পর্বে পৌঁছাল। শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটির বিরুদ্ধে তেল আবিবের অভিযানে ওয়াশিংটন সঙ্গী হওয়ায় সামনের দিনগুলোতে পুরো অঞ্চলজুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। নাতাঞ্জ, ইস্ফাহান ও ফোরদোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলা নিয়ে তাই বিশ্বনেতাদের বেশিরভাগের মুখেই উদ্বেগ ও নিন্দার সুর শোনা গেছে। তারা উত্তেজনা প্রশমনে সব পক্ষকে সংযত হওয়ার পুরনো আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করার পাশাপাশি কূটনীতির মাধ্যমে সমাধান খোঁজার কথাই বলছেন বলে বার্তা সংস্থা রয়টার্স ও আল জাজিরার প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে।

কূটনীতিই একমাত্র পথ, শান্তিই একমাত্র আশা —জাতিসংঘ মহাসচিব :  ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের ঘটনায় ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন আন্তোনিও গুতেরেস।

তিনি একে আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সরাসরি হুমকি অভিহিত করে বলেন, এমনিতেই সঙ্কটাপন্ন একটি অঞ্চলে এই ঘটনা উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিল। ‘সংঘাত দ্রুত নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে, যা সাধারণ নাগরিক, এই অঞ্চল এবং পুরো বিশ্বের জন্য ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে।’ আমি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে আহ্বান জানাই, তারা যেন উত্তেজনা প্রশমিত করে এবং জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের অন্যান্য বিধান অনুযায়ী নিজেদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়। এই সংকটময় সময়ে বিশৃঙ্খলার দুষ্টচক্র এড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এই পরিস্থিতির কোনো সামরিক সমাধান নেই। সামনে এগোনোর একমাত্র পথ কূটনীতি। শান্তিই একমাত্র আশা, বলেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব।

কূটনীতিই পারে টেকসই সমাধান দিতে —নিউজিল্যান্ড : নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইনস্টন পিটার্স বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে চলমান সামরিক কর্মকাণ্ড খুবই উদ্বেগজনক। আরও উত্তেজনা বৃদ্ধি এড়ানোই এখন সবচেয়ে জরুরি। কূটনৈতিক প্রচেষ্টার প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানাচ্ছে নিউজিল্যান্ড। আমরা সব পক্ষকে আলোচনায় ফিরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। আরও সামরিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে কূটনীতির পথই দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই সমাধান দিতে সক্ষম, বলেছেন তিনি।

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার —মেক্সিকো : মেক্সিকোর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সোশ্যাল মিডিয়া এক্সে দেয়া পোস্টে বলেছে, শান্তির লক্ষ্যে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতে জড়িত পক্ষগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সংলাপ শুরুর জন্য মন্ত্রণালয় জরুরি আহ্বান জানাচ্ছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির সাংবিধানিক নীতিমালা ও শান্তিপ্রিয় অবস্থানের প্রতি অবিচল থেকে, আমরা আবারও অঞ্চলটিতে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানাই। ওই অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান পুনঃপ্রতিষ্ঠা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত।

চিলি, ভেনিজুয়েলা, কিউবার নিন্দা : এক্সে কিউবান প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াজ-কানেল বলেছেন, ‘আমরা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের বোমা হামলার তীব্র নিন্দা জানাই, যা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতকে বিপজ্জনকভাবে আরও উত্তপ্ত করে তুলেছে। এই আগ্রাসন জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের মারাত্মক লঙ্ঘন এবং এটি মানবজাতিকে অপূরণীয় এক গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।’ চিলির প্রেসিডেন্ট গ্যাব্রিয়েল বরিকও যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলাকে ‘বেআইনি’ অ্যাখ্যা দিয়েছেন। ‘চিলি যুক্তরাষ্ট্রের এই হামলার তীব্র নিন্দা জানায়। ক্ষমতা থাকা মানেই সেই ক্ষমতা মানবজাতি যে নিয়মকানুন নিজেই নির্ধারণ করেছে তা লঙ্ঘন করার অধিকার দেয় না। যদি সেটা যুক্তরাষ্ট্রও হয়, তাও,’ এক্সে বলেছেন তিনি। 

টেলিগ্রামে দেয়া পোস্টে ভেনিজুয়েলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান গিল ইরানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসনের নিন্দা ও অবিলম্বে সব বৈরী তৎপরতা বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। ইসরাইল রাষ্ট্রের অনুরোধে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা, ফোরদো, নাটাঞ্জ ও ইস্ফাহানে মার্কিন সামরিক বাহিনীর বোমা হামলার দৃঢ় ও সুস্পষ্ট বলিভারিয়ান প্রজাতন্ত্র ভেনিজুয়েলা, বলেছেন তিনি।

সংযত হতে বলছে সৌদি আরব : ‘ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানে ঘটে যাওয়া ঘটনা, বিশেষ করে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার বিষয়টি সৌদি আরব গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে,’ বলেছে সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিবৃতিতে তারা ‘সংযত হতে’, উত্তেজনা কমিয়ে আনতে এবং উত্তেজনার আরও বৃদ্ধি রোধ করার আহ্বান জানিয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়কে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ অর্জনের লক্ষ্য প্রচেষ্টা জোরদারেরও অনুরোধ করেছে।

সংঘাত বিস্তৃত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ল —ওমান : যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে তেহরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে সাম্প্রতিক আলোচনাগুলোতে মধ্যস্থতা করা ওমান নাতাঞ্জ, ফোরদো ও ইস্ফাহানে মার্কিন হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে। তারা একে ‘বেআইনি আগ্রাসনমূলক কর্মকাণ্ড’ অ্যাখ্যা দিয়ে দ্রুত এবং পূর্ণাঙ্গভাবে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে। ওমান গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের এ কাজ সংঘাত বিস্তৃত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দিল বলে আশঙ্কা করছে। এটি আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘ সনদের ‘সুস্পষ্ট লঙ্ঘন’ও, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র এমনটা বলেছেন বলে জানিয়েছে ওমানের বার্তা সংস্থা।

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বনাশা পরিণতি ডেকে আনতে পারে— কাতার : কাতার বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর সৃষ্ট বিপজ্জনক উত্তেজনা আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ‘সর্বনাশা পরিণতি’ ডেকে আনতে পারে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে মধ্যপ্রাচ্যে চলমান পরিস্থিতির ‘অবনতিতে’ নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে সব ধরনের সামরিক কর্মকাণ্ড অবিলম্বে বন্ধ করে সমস্যার সমাধানে আলোচনার টেবিলে ও কূটনৈতিক পথে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে।

আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি —ইরাক : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলায় গভীর উদ্বেগ ও নিন্দা প্রকাশ করে ইরাক বলেছে, এই সামরিক উত্তেজনা আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করছে।

উত্তেজনা প্রশমন, আলোচনা ও কূটনীতি দেখতে চায় অস্ট্রেলিয়া : ‘আমরা পরিষ্কারভাবে বলে আসছি যে, ইরানের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এখনই যে শান্তির উপযুক্ত সময়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের এমন বক্তব্যও লক্ষ্য করেছি আমরা। ‘এই অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি খুবই অস্থির। আমরা উত্তেজনা প্রশমন, সংলাপ ও কূটনীতির জন্য আমাদের আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করছি,’ বলেছেন অস্ট্রেলিয়া সরকারের এক মুখপাত্র।

যুক্তরাষ্ট্রের হামলা ইরানের পারমাণবিক হুমকি ‘হ্রাস করেছে’ —যুক্তরাজ্য : ইরানের পরমাণু স্থাপনায় মার্কিন হামলার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। তিনি বলেছেন, এই হামলা তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থেকে আসা ‘হুমকি হ্রাস করেছে’। এক্সে দেয়া এক পোস্টে স্টারমার বলেন, ‘ইরানকে কখনোই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করার সুযোগ দেয়া যাবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি এখনও অত্যন্ত অস্থির এবং এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা ইরানকে আহ্বান জানাই আলোচনার টেবিলে ফিরে আসতে এবং এই সংকটের কূটনৈতিক সমাধানে পৌঁছাতে।’

মহাখুশি ইসরাইল : ‘অভিনন্দন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের মহান ও ন্যায়পরায়ণ শক্তি দিয়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে নিশানা করার আপনার সাহসী সিদ্ধান্ত ইতিহাস বদলে দেবে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক শাসনব্যবস্থাকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্র পাওয়া থেকে বিরত রাখতে কাজ করেছেন,’ বলেছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

এর দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি থাকবে —ইরান : ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তার দেশের তিন পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার জবাব দেয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হয়েও ইরানের শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর উপর হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘ সনদ, আন্তর্জাতিক আইন ও পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি (এনপিটি) সুস্পষ্টভাবে লঙ্ঘন করেছে। ‘আজকের সকালের ঘটনা চরমভাবে নিন্দনীয় এবং এর দীর্ঘস্থায়ী পরিণতি থাকবে। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রেরই অত্যন্ত বিপজ্জনক, আইনবহির্ভূত ও অপরাধমূলক এই আচরণ নিয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত।’ জাতিসংঘ সনদ ও সেখানে দেয়া আত্মরক্ষার বিধান অনুসারে, ইরান তার সার্বভৌমত্ব, স্বার্থ এবং জনগণকে রক্ষায় সব বিকল্প খোলা রাখছে,’ এক্সে লিখেছেন তিনি।